Ads

একশো আশি ডিগ্রি বাঁক-বিদ্রোহী কবি কে?

।। মনসুর আলম ।।

এই প্রশ্নের উত্তর আমাদেরকে খুবই ছোটবেলায় শেখানো হয়েছে, তবে কত ছোটবেলায় সেটুকু সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। আমরা যারা স্কুলে যাই সবাই মোটামুটি এই প্রশ্নের উত্তর জানি, এটি সাধারণের চেয়েও সাধারণ জ্ঞান। কিন্তু, ধরা খেলাম কলেজে যাবার পর।

 

বাংলার নতুন স্যার এসেছেন। স্যারের সাথে প্রথম ক্লাস। পরিচিতি পর্ব চলছে সাথে টুকিটাকি আলাপচারিতা। স্যারকে প্রথমে দেখেই আমি একটা ধাক্কা খেলাম। এমন স্মার্ট, হ্যান্ডসাম মানুষ বাংলা পড়ায় কীভাবে? আমার মানসপটে বাংলা শিক্ষকের একটি সাধারণ চিত্র আঁকা আছে; বাংলার শিক্ষক হবেন আলাভোলা, অগোছালো, বাউল টাইপের গেটআপ। এরকম আর্মি স্টাইলে খুলি কামড়ে থাকা চুল, জিন্সের প্যান্টের সাথে Lacoste টি-শার্ট আর পায়ে কাউবয় স্টাইলের হাফ বুট পরা দেখে মনে হচ্ছে স্পেশাল ব্রাঞ্চের কোনো চৌকস অফিসার। স্যারকে প্রথমে দেখেই আমার মনে হয়েছে এ তো দেখি কিংবদন্তি গোয়েন্দা ‘মাসুদ রানা’। এই লোক বাংলার শিক্ষক হয় কীভাবে? নিজের চোখকে বিশ্বাসই হচ্ছে না। এরকম স্মার্ট মানুষও বাংলা পড়ে! অনেক পরে, বিশেষকরে বিদেশে এসে বুঝতে পারলাম আসলে মাতৃভাষার শিক্ষকই সবচেয়ে স্মার্ট হওয়া উচিৎ। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভাষা বিভাগ সবচেয়ে বেশি রিসোর্স সমৃদ্ধ হওয়া উচিৎ। সবচেয়ে স্মার্ট শিক্ষক থাকা উচিৎ ভাষা শিক্ষায়। ভাষা জ্ঞান দুর্বল হলে বাকী সব শিক্ষা নড়বড়ে হয়ে যায়।

 

কথা প্রসঙ্গে স্যার জিজ্ঞেস করলেন: আচ্ছা, বলতো বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী কবি কে? পুরো ক্লাস একসাথে গর্জে উঠলো – কাজী নজরুল ইসলাম। স্যার মুচকি হেসে বললেন – হয়নি। এবার পুরো ক্লাস মিনমিন করে প্রতিবাদ করে উঠলো। আমি ভাবছিলাম- আমি গ্রামের ছেলে, আমার জানায় হয়তো ভুল আছে। কিন্তু, এতগুলো শহুরে ছেলেমেয়ে এদেরও জানায় কি ভুল আছে? এটিতো খুবই সাধারণ একটি প্রশ্ন! উঠে দাঁড়ানোর প্রবল ইচ্ছেটা নিবৃত্ত করতে বেশ বেগ পেতে হলো। মনেমনে ভাবছিলাম, এমন স্মার্ট শিক্ষক নিশ্চয়ই ঝুলিতে কিছু আছে। তারচেয়ে চুপ করে শুনি আগে স্যার কী বলেন?

 

মোটামুটি নীরবতা নেমে আসলো ক্লাসরুমে। স্যার ধীরে সুস্থে বললেন- বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী কবি; মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
আবারও ধাক্কা খাবার পালা। আমরা জানি সনেটের জনক মাইকেল। শেলি, কীটস্, পেত্রার্কের মতো কবির লেখা পড়ার অভিজ্ঞতা ওনার ঝুলিতে। উনি বিদ্রোহী কবি হলেন কবে? আবারও মিনমিনে প্রতিবাদ।

 

স্যার বললেন – শোনো, তোমরা যারা সাইন্স নিয়ে পড়ছো তোমাদের সাধারণ গণিতের পাশাপাশি আরেকটি সাবজেক্ট আছে ‘উচ্চতর গণিত’। এটিও একটি উচ্চতর জ্ঞান। তোমরা সাধারণভাবে জানো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আজ উচ্চতর লেভেলে জেনে নাও বাংলা সাহিত্যে প্রথম বিদ্রোহী কবি হচ্ছেন মাইকেল। রেফারেন্স হিসেবে ওনার দুটি রচনা ‘একেই কি বলে সভ্যতা এবং বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ এর উদাহরণ দিলেন। সংক্ষিপ্ত আকারে আরও কিছু আলোচনা করলেন। স্যারের প্রত্যেকটি কথা আমি গোগ্রাসে গিলছিলাম। শিক্ষক এমনই হওয়া উচিৎ। এই বিষয়গুলি আমাদের স্কুল লেভেলেই জানা থাকা উচিৎ ছিলো।

 

এরকম কিছু লুকোচুরি দেখবেন ইংলিশ গ্রামারের Noun, Pronoun, Verb এর ক্ষেত্রেও আছে। যত উপরের ক্লাসে যাবেন এদের নতুন নাম, প্রকৃতি, শ্রেণীবিন্যাস দেখতে পারবেন। অনেক এমএ পাশ ব্যক্তি দেখেছি যাদের Gerund, Participle নিয়ে কোনো ধারণাই নেই। অথচ হাইস্কুল লেভেলেই এই বিষয়গুলি বিস্তারিত আমাদেরকে শেখানোর দরকার ছিলো। আমরা ছাত্রদেরকে বিশেষকরে টিনেজ ছাত্রদেরকে আন্ডারএস্টিমেইট করি। তাদেরকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিষয়বস্তুর গভীরে বিশ্লেষণ করে বুঝাতে চাই না। ক্রিটিক্যাল বিষয়গুলি নিয়ে একধরনের লুকোচুরি খেলা হয়। শিক্ষকদের অনীহা কিংবা অযোগ্যতা কিংবা দুটোই এরজন্য দায়ী হতে পারে। সাতপাঁচ বুঝিয়ে পাঠদান করলে ছাত্রদের আর জ্ঞান অর্জন করা হয় না।
গোঁজামিলে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া একটি জেনারেশকে যখন কোনো চৌকস শিক্ষক বুদ্ধিবৃত্তিক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেন, তাদের জ্ঞানকে ক্রিটিক্যালি এনালাইস করতে যান কিংবা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ফিল্টারিং করতে চান তখন আর এই জেনারেশন সেটি ধারণ করতে পারে না। তাদের জন্য এটি হয়ে যায় উচ্চতর লেভেলের মতো। ফলাফল – বিজ্ঞানের শিক্ষককে লাঞ্ছিত হতে হয়, জেলে যেতে হয়।

লেখকঃ মনসুর আলম, সাহিত্যিক ও প্রবাসী, সাউথ আফ্রিকা।

০৬/০৪/২০২২

 

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ, পরিবার ও নিজেকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য নানা ধরণের

আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi এ লাইক দিন  এবং

আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন ।

আরও পড়ুন