আয়েশা সিদ্দিকা
দ্যা প্যারাডাইস অন আর্থ বলা হয় কাশ্মীরকে। ঝিলাম নদীর পাশে অবস্থিত এই কাশ্মীর ভ্যালি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই একে পৃথিবীর স্বর্গ বানিয়েছে। আবার মোগলদের স্থাপত্য কাশ্মীরের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
ডাল নাগিন লেক, শালিমার বাগ, নিশাত বাগ, চেশমা শাহী, গুলমার্গ, খিলানমার্গ, পেহেলগাম, লীডার নদী যেন সৌন্দর্যের আঁধার।
কিন্তু বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে সামরিকায়িত এলাকাগুলোর একটি অপার সৌন্দর্যের এই কাশ্মীর ভ্যালি। নিত্যই এখানে ঝড়ছে রক্ত। এখানে মাটিতে কান পাতলেই শোনা যায় দূঃখী মানুষের কান্না। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে উত্তপ্ত ও বিক্ষত জনপদ কাশ্মীর। গত প্রায় ৭১ বছর ধরে কাশ্মীরীরা আজাদির জন্য লড়ছে। তাঁরা নিজের অজান্তেই বিক্রি হয়েছে অন্যের কাছে। কাশ্মীদের গণভোটের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা আজ উপেক্ষিত। এত বছরেও কাশ্মীরের সমস্যার কোনো সুরাহা হয় নি।
শিখ সাম্রাজ্যের পতন
জম্মু ও কাশ্মীরের ১৯৪৭ পূর্ব শাসক বংশ হলো ‘ডোগরা’ রা। গুলাব সিং থেকে এই শাসক বংশের শুরু। ১৮০৮ সালে জম্মু পাঞ্জাবকেন্দ্রিক শিখ সাম্রাজ্য(১৭৯৯-১৮৪৯) এর অধীনে ছিল। মহারাজা রণজিৎ সিং জম্মুর শাসনাভার দিয়েছিলেন রাজপুত গুলাব সিং কে।
শিখ সাম্রাজ্য ছিল লাহোরকেন্দ্রিক। রণজিৎ সিং এর মৃত্যুর পর শিখ সাম্রাজ্যের দায়িত্ব পান তার কনিষ্ঠ পুত্র রাজা দুলিপ সিং। রণজিৎ সিং মারা যাওয়ার পর শিখ সাম্রাজ্য দূর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে ব্রিটিশরা শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। গুলাব সিং তখন জম্মুর রাজা হিসেবে ব্রিটিশদের সহযোগিতা করেছিলেন। ১৮৪৬ সালে ব্রিটিশদের সাথে শিখ সাম্রাজ্যের প্রথম যুদ্ধেই জম্মু ও কাশ্মীর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে আসে।
লাহোর চুক্তি
শিখ রাজা দুলিপ সিং এর পরাজয়ের পর ১৮৪৬ সালের ৯ মার্চ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে শিখ রাজার লাহোর চুক্তি হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে পরাজিত শিখ সাম্রাজ্য কাশ্মীর, জম্মু, হাজারা ইত্যাদি এলাকা যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে কোম্পানিকে সমর্পণ করে। ব্রিটিশরা যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেড়কোটি নানকার শাহী( শিখ রাজ্যের মুদ্রা) দাবি করে। কিন্তু শিখ রাজা এককোটি কম দেন এবং বিনিময়ে কাশ্মীর ও সন্নিহিত এলাকা কোম্পানিকে দেয়
অমৃতসর চুক্তি
একই বছরেই অর্থাৎ ১৮৪৬ সালের ১৬ মার্চ স্বাক্ষরিত হয় দ্বিতীয় চুক্তি যার নাম ” অমৃতসর চুক্তি”। এই চুক্তি হয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে জম্মুর শাসক গুলাব সিং এর। শিখ – ব্রিটিশ যুদ্ধের সময় গুলাব সিং ব্রিটিশদের সহযোগিতা করেন এবং আস্থভাজন হয়ে ওঠেন। যার পরিণতিতে অমৃতসর চুক্তির মাধ্যমে ৭৫ লাখ নানকার শাহীর বিনিময়ে কাশ্মীরের মালিকানা কোম্পানি গুলাব সিং কে দেন।
লাহোর চুক্তি ও অমৃতসর চুক্তির মাধ্যমে কাশ্মীরের জনগণ তাঁদের মতামত ছাড়াই দু’দফা বিক্রি হয়।
ডোগরা রাজবংশ
১৮৪৬ সালে কাশ্মীরে শিখ মহারাজার গভর্নর ছিলেন গোলাম মহিউদ্দীন। তারপর দায়িত্ব পান তাঁর পুত্র ইমাম-উদ-দীন। তাঁর কিছু প্রতিরোধ সত্ত্বেও ব্রিটিশরা অমৃতসর চুক্তির মাধ্যমে কাশ্মীরকে গুলাব সিং এর কাছে বিক্রি করে দেন। এবং তাকে একজন স্বতন্ত্র “মহারাজা” হিসেবে স্বীকৃতি দেন। এভাবেই জম্মু ও কাশ্মীর ডোগরাদের কাছে চলে আসে।
গুলাব সিং থেকে শুরু হওয়া জম্মু ও কাশ্মীরের শেষ মহারাজা ছিলেন হরি সিং।
গুলাব সিং মারা যান ১৮৫৭ সালে আর হরি সিং মারা যান ১৯৬১ সালে। দেখা যায় ডোগরা রাজবংশের শাসন ১০০ থেকে ১১০ বছরকাল স্থায়ী ছিল।
আজাদি সংগ্রামের শুরু
ডোগরা শাসনামলে মুসলমানদের চড়ম দূর্ভোগের স্বীকার হন। গুলাব সিং ইচ্ছেমাফিক করারোপের উপায় হিসেবে জনস্বার্থবিরোধী পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। ১৯৩০ পর্যন্ত রাজার সশস্ত্র বাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসনে হিন্দু রাজবংশীয়দের বাইরে স্থানীয় মুসলমানের প্রবেশাধিকার ছিল না।
১৮৪৬ এ অমৃতসর চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনস্ত “প্রিন্সলি স্টেইট” বা দেশীয় রাজ্য হিসেবে যাত্রা করে জম্মু ও কাশ্মীর। অর্থাৎ ব্রিটিশরা সরাসরি শাসন করত না তবে পরোক্ষভাবে কতৃত্ব থাকত এবং শাসকেরা তাদের অনুগত থাকত। ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশরা প্রথমবার কাশ্মীরে একজন ” রেসিডেন্ট অব দ্যা স্টেইট” নিয়োগ দিলেও মুসলমানদের সুযোগ সুবিদার কোনো উন্নতি হয় নি।
ডোগরা রাজারা প্রশাসন পরিচালনা করেছে মূলত হিন্দু ‘পন্ডিত’ দের দ্বারা। কাশ্মীরে পন্ডিতদের শাসন কায়েম হলে তাঁরা মুসলমানদের নিঃস্ব করে ফেলে। এসময় ১৮৭৭-১৮৭৯ দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে স্থানীয় জনসংখ্যার পাঁচভাগের দুইভাগ মারা গেলেও একজন পন্ডিতও মারা যায় নি।
এভাবেই ক্ষোভ জমতে থাকে মুসলমানদের মনে। ১৯৩১ সালে মহারাজা হরি সিং এর প্রশাসনিক কর্মকর্তাকতৃক জম্মুতে ঈদের খুৎবার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও মহারাজার সৈনিককতৃক কুরআন শরীফের প্রতি অবমাননাকর আচরণের কারণে সমগ্র রাজ্য জুড়েই উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এরই মাঝে আবদুল কাদির নামে এক তরুণ মহারাজার বাসভবনের ধ্বংসের আহ্বান জানালে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১২ জুলাই আবদুল কাদিররের সমর্থনে কাশ্মীর জুড়ে মিছিল শুরু হয়। জনরোষ এড়াতে তাঁর বিচার কার্যক্রম স্থানান্তর করা হয় কারাগারের ভেতর।
১৩ জুলাই বিচার চলাকালে নামাজের ওয়াক্ত শুরু হলে একজন কাশ্মীরী আজান দিতে শুরু করলে গর্ভনরের নির্দেশে তাকে গুলি করা হয়। আজান শেষ করার জন্য একের পর এক মুসলমান দাঁড়িয়ে আজান দেয়। এভাবে আজান সম্পন্ন করতে ২২ জন মুসলমান শহীদ হন।
নির্মমতার সেদিন শোকে ক্ষোভে কাশ্মীর স্তব্ধ হলেও এরপর থেকেই শুরু হয় গণআন্দোলন। প্রতিবছর ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরে শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হয়।
তারপর গড়ে ওঠে “মুসলিম কনফারেন্স “। ১৯৩৯ সালে দলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ” “ন্যাশনাল কনফারেন্স”।শের ই কাশ্মীর খ্যাত শেখ আবদুল্লাহ নেতৃত্বে ১৯৪৬ সালে কাশ্মীর জুড়ে শুরু হয় “কুইট কাশ্মীর” আন্দোলন যা মূলত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ” কুইট ইন্ডিয়া” আন্দোলনের বর্ধিত রুপ। শেখ আবদুল্লাহ মুসলীম লীগের পরিবর্তে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে সমর্থন করতেন।
পুঞ্চ বিদ্রোহ ও পুঞ্চ গণগত্যা
১৯৪৭ সালে পুঞ্চ জেলা থেকেই প্রথম মহারাজা হরি সিং এর বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভের শুরু হয়। পুঞ্চ জেলাটি ‘লাইন অব কন্ট্রোল ‘ ছুঁয়ে গেছে। এখন দু’ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরে, অপর ভাগ ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মুতে। যখন পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পাকিস্তানভুক্ত হচ্ছে তখন মহারাজা হরি সিং এসময় সিদ্ধান্তহীনতার কৌশল নেন।
অন্যদিকে চৌধুরী আব্বাসের পুরোনো দল মুসলিম কনফারেন্স চায় জম্মু ও কাশ্মীর পাকিস্তানভুক্ত হোক। এসময় দাঙ্গার শুরু হলে মহারাজা পুঞ্চে সামরিক উপস্থিতি বাড়ায় এবং শেষে মুসলমানদের সকল ধরনের অস্ত্র সমর্পনের নির্দেশ দেয়। এই সুযোগে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ( আরএসএস) এর জঙ্গি কর্মীরা গণহত্যায় মেতে ওঠে। এই গণহত্যায় দুই লাখেরও বেশি মানুষ মারা গেছে বলে ব্রিটিশ প্রচারমাধ্যম প্রকাশ করেছিল তবে এ নিয়ে এখনও বিতর্ক চলছে।
এর ফলেই প্রথম পাকিস্তান- ভারত যুদ্ধে রুপ নেয়
।
লেখকঃ আন্তর্জাতিক বিষয়ে কলাম লেখক ও ছাত্রী,চতুর্থ বর্ষ (২০১৫-১৬), গনিত বিভাগ