।। আলী ওসমান শেফায়েত ।।
আমরা কজন জানি, পৃথিবীর প্রথম নির্ভুল মানচিত্র যিনি এঁকেছিলেন অথবা বিশ্বের প্রথম স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের কারিগর কে ছিলেন? গুটিবসন্তের টিকা, পরিসংখ্যানের ভিত্তি স্থাপনকারী, আলোক বিজ্ঞান, রসায়ন, বীজগণিত ও ত্রিকোণমিতির জনক কারা ছিলেন? মিল্কিওয়ের গঠন প্রথম কে শনাক্ত করেছিলেন? পদার্থবিজ্ঞানে শূন্যের ধারণাকে কে সুস্পষ্ট করেছিলেন? ফাউন্টেন পেন, উইন্ডমিল, ঘূর্ণায়মান হাতল, পিনহোল ক্যামেরা, প্যারাসুট, শ্যাম্পুর মতো অতি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর আবিষ্কারক কারা ছিলেন? এই প্রতিটি উদ্ভাবনের পেছনে রয়েছে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান—এমন তথ্য আমাদের অনেকের কাছেই অজানা।
আজ যখন মুসলিম বিশ্ব জ্ঞান-বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনী শক্তিতে তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে, তখন এই বিস্মৃতি অনেক মুসলিম শিশু-কিশোর ও সাধারণ মানুষকে হীনমন্যতায় ভোগায়। তারা হয়তো দেখে, বিজ্ঞানের জগতে যাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি, তারা অধিকাংশই অমুসলিম। তাদের মনে প্রশ্ন জাগে, কেন মুসলিমদের মধ্যে তেমন উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞানী নেই?
এই পরিস্থিতির পেছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান। একটি বড় কারণ হলো, ক্রুসেডারদের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ইসলামের স্বর্ণালী যুগকে আড়াল করা এবং মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান ও পরিচয়কে ধোঁয়াশার মধ্যে রাখা। দ্বিতীয়ত, সরল বিশ্বাসে অমুসলিমদের চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিপূর্ণ তত্ত্বগুলো আমরা মেনে নিয়েছি। আমাদের গৌরবময় ইতিহাস, মুসলিম বিজ্ঞানী এবং তাদের আবিষ্কারগুলো কৌশলে পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তৃতীয়ত, বর্তমানে আমরা অনেকেই এই বিষয়গুলো জানার আগ্রহ রাখি না।
অথচ ৭৫০ থেকে ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল ছিল ইসলামের স্বর্ণযুগ—জ্ঞান-বিজ্ঞান, আবিষ্কার, রাজনীতি, বাণিজ্য, দর্শন—সব ক্ষেত্রেই মুসলিম সভ্যতা তখন উন্নতির শীর্ষে অবস্থান করছিল। ঐতিহাসিক জ্যাক যেমন লিখেছেন, “ইসলাম তার ক্ষমতা, শিক্ষা ও শ্রেষ্ঠতর সভ্যতার জোরে বিশ্বে পাঁচ শত বছর আধিপত্য করেছে।”
আরও পড়ুন-
কিন্তু ক্রুসেডারদের উত্তরসূরিরা সুচিন্তিতভাবে মুসলিমদের এই অর্জন ও ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা চালিয়েছে। তারা মধ্যযুগকে ‘অন্ধকার যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছে—তবে সেই অন্ধকার ছিল ইউরোপে, মুসলিম বিশ্বে নয়।
আরও বিস্ময়কর বিষয় হলো, পশ্চিমা বিশ্ব যখন স্বর্ণযুগের মুসলিম বিজ্ঞানীদের গ্রন্থ ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করতে শুরু করে, তখন তারা এক অদ্ভুত কাজ করে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তারা শুধু অনুবাদই করেনি, মুসলিম বিজ্ঞানীদের নাম পর্যন্ত পরিবর্তন করে ফেলে, যাকে তারা ‘ল্যাটিন ভাষায় নাম অনুবাদ’ বলে অভিহিত করে। অথচ নাম কি কখনো অনুবাদ করা যায়? ইবনে সিনার পুরো নাম আবু আলী আল-হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সিনা হলেও ল্যাটিনে তার নাম দেওয়া হয় আভিসেনা (Avicenna)। বীজগণিতের জনক আল খাওয়ারিজমির নাম হয়ে যায় এলগোরিজম (Algorism), আর প্রথম নির্ভুল মানচিত্র অঙ্কনকারী আল-ইদ্রিসীর নাম হয় ড্রেসেস (Dresses)। শুধু এই কজন নন, প্রায় সকল মুসলিম বিজ্ঞানীর ক্ষেত্রেই একই অবিচার করা হয়।
এই পরিবর্তিত নামগুলো শুনে কারও পক্ষে ধারণা করাও কঠিন যে এঁরা মুসলিম ছিলেন। আব্দুল্লাহ, মোহাম্মদ, আবু বকরের মতো সুন্দর ইসলামিক নামগুলোও তাদের সহ্য হয়নি। অথচ মুসলিমরা যখন প্রাচীন গ্রিক ও ভারতীয় দার্শনিকদের রচনা আরবিতে অনুবাদ করেছিল, তখন তো তারা এমন কাজ করেনি। লেখকের আসল নাম পরিবর্তন করার এমন নজির ইতিহাসে বিরল।
তারা শুধু নাম বিকৃত করেই ক্ষান্ত হয়নি, মুসলিম বিজ্ঞানীদের পরিচয় নিয়েও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। কাউকে বলা হয়েছে তিনি আদৌ মুসলিম নন, কারও অবদানকে খাটো করে দেখানো হয়েছে। রসায়নের জনক জাবির ইবনে হাইয়ানের ক্ষেত্রেও একই ষড়যন্ত্র দেখা যায়। কোনো ইউরোপীয় ঐতিহাসিকের দাবি, জাবির ইবনে হাইয়ান ছাড়াও ‘জিবার’ নামে আরেকজন ছিলেন, যিনি নাকি ইউরোপীয়! এমন অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়।
এবার আসা যাক আমাদের প্রসঙ্গে। আমরা কি মুসলিম বিজ্ঞানী ও তাদের আবিষ্কার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছি? তাদের নিয়ে আলোচনা বা লেখালেখি করেছি? আমাদের শিশুরা কি নিউটনের পাশাপাশি নাসিরুদ্দিন তুসি বা আল-ফারাবীর নাম শুনেছে? বিজ্ঞান বিষয়ক বইতে তারা কি কখনো মুসলিম বিজ্ঞানীদের অসাধারণ কাজগুলো সম্পর্কে পড়েছে? এর কারণ হলো, পশ্চিমা চাপানো শিক্ষাব্যবস্থা আমরা অন্ধভাবে গ্রহণ করেছি এবং আমাদের পরাজিত মানসিকতাই এর জন্য দায়ী।
জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা বিস্তারে মুসলমানদের অবদান অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর তুলনায় অনেক বেশি। ইসলামের শুরু থেকেই জ্ঞানচর্চার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মুসলিম দার্শনিকদের সৃজনশীল প্রতিভার ফলেই বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।
চিকিৎসাশাস্ত্র, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, ভূগোলসহ জ্ঞানের প্রায় সকল শাখায় মুসলিমদের অবদান অনস্বীকার্য। কুরআনকে পর্যবেক্ষণ করে মুসলিম বিজ্ঞানীরা মানবতার কল্যাণে বহু মূল্যবান আবিষ্কার করেছেন।
আরও পড়ুন-
চিকিৎসাশাস্ত্রে ইবনে সিনা, আল-রাজী; রসায়নে জাবির ইবনে হাইয়ান; জ্যোতির্বিদ্যায় আল-ফারগানি; গণিতে আল-খাওয়ারিজমির মতো বিজ্ঞানীরা আজও স্মরণীয়। প্রথম স্থায়ী হাসপাতাল স্থাপন এবং চক্ষু চিকিৎসার উন্নয়নে মুসলিমদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মুসলমানদের এই সমৃদ্ধ ইতিহাসকে আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা আজ অত্যন্ত জরুরি। যখন তারা তাদের পূর্বপুরুষদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ঐতিহ্য সম্পর্কে জানবে, তখন তাদের মধ্যে হীনমন্যতা দূর হবে এবং তারা নতুন করে জ্ঞানার্জনে অনুপ্রাণিত হবে। গ্যালিলিও বা নিউটনের পাশাপাশি ইবনে সিনা, আল-বেরুনীর মতো বিজ্ঞানীরাও তাদের আদর্শ হতে পারবেন।
আসুন, আমরা সকলে মিলে আমাদের সোনালী অতীতের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস পুনরুদ্ধার করি এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সেই আলোয় আলোকিত করি। তবেই তারা তথাকথিত তারকাদের বদলে খুঁজে পাবে তাদের সত্যিকারের আদর্শকে।
লেখকঃ লেখক ও কলামিস্ট
লেখাটি ভারতের বাঙালি মুসলিম কমিউনিটির সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা পূবের কলমে পূর্ব প্রকাশিত
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল, আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেইজ মহীয়সী/Mohioshi-তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হ্যাঁ, মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইল-
[email protected] ও [email protected] -এ; মনে রাখবেন, “ধন দৌলত খরচ করলে কমে যায়, কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়”। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকেই দ্বীনি জ্ঞান দান করেন।” (সহিহ বুখারী- ৭১, ৩১১৬, ৩৬৪১, ৭৩১২, ৭৪৬০; মুসলিম- ১০৩৭; ইবনে মাজাহ- ২২১) ।
মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম; আজই আপনি যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে। আসুন, ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ, সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি। আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমীন।