Ads

আমেরিকার রাজনৈতিক দলের সূচনা (পর্ব -০১)

রাজিয়া নাজমী

গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মননে ছিল প্রজাদের সুখী জীবন। তাঁর সেই ভাবনায় রাজনীতির বিষয় হ’ল একটি যৌথ মঙ্গল কামনা করা, এবং যেখানে প্রকৃত ন্যায় নীতি স্পষ্ট দেখা দেয় । তিনি বিশ্বাস করতেন রাজনীতির অস্তিত্ব ছাড়া সকল জনসাধারণের উপকারে মনোনিবেশ করার মতো কোনও উপায় নেই। এবং সেই লক্ষ্যটিকে সামনে রেখেই এটি সংগঠিত করা উচিত।

অ্যারিস্টটল বলেছিলেন “একজন শাসকের জানতে হবে নাগরিকদের জীবন কেমন হয়, তবেই তিনি বুঝতে পারবেন কীভাবে কার্যকর-ভাবে নেতৃত্ব দেওয়া যায়। যে শাসক নাগরিকের প্রয়োজনের সংস্পর্শে থাকে না , সে কার্যকর সরকার বজায় রাখতে পারে না”।

রাজনৈতিক আদর্শবানদের সংজ্ঞা অনুযায়ী রাজনৈতিক দলকে জল ও বিদ্যুৎ সংস্থার মতো জনস্বার্থমুলক সংস্থার সাথে তুলনা করাই হয়ত সঠিক । কারণ জনগণের জন্য এরকম অত্যাবশ্যক পরিষেবা সরবরাহ করার জন্যই তাদেরকে সরকারী নেতৃত্ব এবং গণতন্ত্র রক্ষার্থে নির্বাচন করা হয়।
দার্শনিকদের রাজনৈতিক সংজ্ঞা যাই থাকুক, গোটা বিশ্বের রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি অন্তত পক্ষে একটি নেতিবাচক অনুভূতি রয়েছে , তাহলো হতাশা, ভয় বা রাগ । এবং এই অনুভূতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলগঠনের শুরুতেও ছিল ।

মার্কিন জাতির প্রতিষ্ঠার পরে অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বিভিন্ন দলগুলির উদ্ভব নিয়ে সন্দেহ ছিল । প্রেসিডেন্ট জেমস মনরো ১৮২২ সালে এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন , “অবশ্যই আমাদের সরকার পার্টির অস্তিত্ব ছাড়াই এগিয়ে যেতে এবং উন্নতি করতে পারে। আমি এদের অস্তিত্বকে সর্বদা দেশের অভিশাপ হিসাবে বিবেচনা করেছি। ”

আমেরিকান রাজনৈতিক দলগুলির দীর্ঘ-স্থায়িত্ব এবং অভিযোজন-প্রবণতার বর্ণীল ঐতিহাসিক বিকাশ অনুসন্ধান করলে দেখা যায় রাজনৈতিক দলগুলি অষ্টাদশ শতাব্দীর দলাদলি থেকে উনিশ শতকে এসে একটি রাজনৈতিক মেশিনে বিবর্তিত হয়েছে। এবং অনেকের যুক্তিতে, বিংশ শতাব্দীতে দলগুলি তাদের সংস্কারের যে তরঙ্গের ভিতর দিয়ে গিয়েছে তা থেকেই এর পতনের কাল শুরু হয়েছে ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মূলত দুইটি রাজনৈতিক দলের দেশ হিসাবে বিশ্বে পরিচিত। যদিও স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রের ২৪৫ বছরের ইতিহাসে দুটিরও বেশি রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি রয়েছে তবে বেশিরভাগ আমেরিকান ভোটাররা একবিংশ শতাব্দীতেও ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান এই বড় দু’টির দলের একটির পক্ষেই থাকতে চান।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এবং বিশ্বের অন্যতম প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল ‘ডেমোক্র্যাটিক পার্টী’। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্পেকট্রামে ডেমোক্র্যাটিক পার্টী’কে সেন্টার- লেফট পার্টী হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ১৭৮৯ সালে জাতীয় সরকারের অফিসটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ৪৬ তম প্রেসিডেন্ট পদে ৪৫ জন ব্যক্তি দায়িত্ব পালন করেছেন।

তবে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মধ্যে প্রথম ছয়জন এবং পরবর্তীতে আর চারজন প্রেসিডেন্ট ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান দলের ছিলেন না।
আমরা সকলেই জানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডার বা ফাউন্ডিং ফাদার একজনকে ধরা হয় না। ইংল্যান্ড থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য যারা কাজ করে গেছেন তাদের মধ্যে জর্জ ওয়াশিংটন সহ সাতজনকে যুক্তরাষ্ট্র ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ বা প্রতিষ্ঠাতা পিতা হিসাবে ধরা হয়। যদিও এদের সাথে আর অনেকের নাম যুক্ত আছে তাদের কাজের জন্য। ( এবং ইতিহাস রচয়িতারা ফাউন্ডিং মাদারস’হিসাবে যুক্ত করেছেন ম্যাডাম আব্যাগিল অ্যাডামস সহ অন্য যারা স্বাধীনতার জন্য কাজ করে গেছেন )

যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডারদের মধ্যে পাঁচজন প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এবং প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন যিনি কোন রাজনৈতিক দলেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না তিনি এই পক্ষপাতমূলক রাজনীতির ধারণাকে ঘৃণা করেছিলেন।

জর্জ ওয়াশিংটন তাঁর ফেয়ারওয়েল ভাষণে সহকর্মীদের আমেরিকানদের রাজনৈতিক দলগঠনের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। তিনি বুঝিয়েছিলেন যে রাজনৈতিক দলগুলির এক পক্ষ অন্য পক্ষের উপরে প্রতিশোধের চেতনায় স্বাভাবিক থেকে তীক্ষ্ণ দলীয় মতবিভেদ দেখা দেবে। তার মতে পক্ষপাত মূলত এক ভয়াবহ স্বৈরাচার-বাদ’। তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন যে এই পক্ষপাতিত্ব আন্তঃ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ঘটাবে, জাতিকে বিভক্ত করবে এবং ক্ষমতার অপব্যবহারে স্বৈরাচারের জন্ম দেবে। তিনি এর ভয়াবহ পরিণামের ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্কতা কারণ দেখিয়েছিলেন।

জর্জ ওয়াশিংটনের মত সংবিধানের প্রণেতারা এবং প্রতিষ্ঠাতারাও রাজনৈতিক এজেন্ডা এগিয়ে নেওয়ার জন্য সংগঠিত দলের ভিতরে বিরোধের বিষয়ে ভীত ছিলেন । তারা দলীয় সংঘাতের ভয়ে চেক এবং ব্যালেন্সের একটি সরকার তৈরি করেছিলেন যা কোনও একটি দলকে খুব প্রভাবশালী হওয়ার পথে বাধা দিতে পারে। দলাদলি বা উপদল গঠনের সমস্যা ও সম্ভাব্য সমাধান সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার জন্য জেমস ম্যাডিসনের বিখ্যাত “ফেডারেলিস্ট নং ১০ “mischiefs of faction ” নিয়ে ফেডারেলিস্ট কাগজে প্রকাশিত লেখা আজও আলোচিত।

বিপ্লবী যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে প্রথম আমেরিকান পার্টি সিস্টেমের সূচনা হয় এবং রাজনৈতিক মতবিরোধ নিয়েই এর শুরু হয়েছিল। ১৭৮৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পরে রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটন দলীয় সংঘাতের ভয়ে একটি নিরপেক্ষ “আলোকিত প্রশাসন” তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি তার মন্ত্রীসভায় দু’জন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে ট্রেজারি সেক্রেটারি এবং টমাস জেফারসনকে রাজ্য সেক্রেটারি হিসাবে নিয়োগ করেছিলেন, এই আশায় যে এই দুই মহতী জাতীয় স্বার্থে একসাথে কাজ করতে পারবে। ‘রাজনৈতিক দলবিহীন সরকার’ গঠনে ওয়াশিংটনের দৃষ্টিভঙ্গি স্বল্পস্থায়ী ছিল।
জেফারসনের সাথে হ্যামিল্টনের মতবিরোধ দেখা দেয় । যদিও দুইজনেই জাতির ফাউন্ডার ফাদারস হিসাবে কাজ করেছেন। জেফারসনের স্বপ্নভঙ্গ হয় ওয়াশিংটনের প্রশাসনের উপরেও । বিশেষত এর বৈদেশিক নীতি সম্পর্কে একমত না হতে পারায় জেফারসন ১৭৯৪ সালে মন্ত্রীসভা থেকে বের হয়ে গেলেন।

নতুন জাতির অর্থনৈতিক সঙ্কটের হুমকিকে সংশোধন করার জন্য জেফারসনের দৃষ্টিভঙ্গি হ্যামিল্টনের চেয়ে সম্পূর্ণ পৃথক ছিল। হ্যামিল্টন হুইস্কির উপর বিতর্কিত কর এবং একটি জাতীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠাসহ একাধিক পদক্ষেপের প্রস্তাব করেছিলেন। ভার্জিনিয়ার জেফারসন, যিনি স্থানীয় কৃষকদের পক্ষে ছিলেন, তিনি এই প্রস্তাবটির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। কৃষকরা ফেডারেল সরকার কর্তৃক আরোপিত হুইস্কির উপর শুল্কের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে।
হ্যামিল্টন তখন তার পরিকল্পনার প্রচারের জন্য একদল শক্তিশালী সমর্থকদের একত্রিত করে এমন একটি দল করেছিলেন যা শেষ পর্যন্ত ফেডারালিস্ট পার্টিতে পরিণত হয়েছিল।

ওয়াশিংটন এবং অন্যান্যদের সতর্কতা সত্যেও, নবীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম থেকেই রাজনৈতিক এ্যাসোসিয়েশনগুলি সংবিধান স্বাক্ষর হওয়ার আগেই মূলত দ্বিখণ্ডিত হতে শুরু করেছিল। প্রথম পর্যায়েই দুটি দলমতের উদ্ভব ঘটেছিল -ফেডারালিস্ট এবং অ্যান্টি-ফেডারালিস্ট।
প্রতিষ্ঠাতাদের দ্ব্যর্থক অনুভূতির অভিব্যক্তি সত্ত্বেও, প্রথম রাজনৈতিক দল, ফেডারালিস্ট অনুসারীরা, গ্রেট ব্রিটেন এবং অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশে রাজনৈতিক দল গঠিত হওয়ার তিন দশকেরও অনেক আগে ১৭৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে উদিত হয়।
সেই অর্থে ফেডারালিস্ট পার্টি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাজনৈতিক দল ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের দুইজন ‘ফাউন্ডার ফাদারস’ আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন এবং জন অ্যাডামস এই ফেডারালিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের অধীনে এই দলটি ১৭৮৯ থেকে ১৮০১ সাল পর্যন্ত জাতীয় সরকারে আধিপত্য বিস্তার করে।

ফেডারালিস্টদের আলোচনার বিষয়বস্তু প্রথম দিকে ফেডারালিস্ট পেপারে যথেষ্ট খ্যাতি পেতে থাকে। আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের ছিলেন ফেডারালিস্ট পেপারের পিছনে মূল কণ্ঠ । ফেডারালিস্টরা নিউ ইংল্যান্ডে এর শক্ত ঘাঁটি বজায় রেখে একটি সংখ্যালঘু দল হয়ে ওঠে ।
জেফারসন তার বন্ধু জেমস ম্যাডিসনকে ( ম্যাডিসন ছিলেন আমেরিকান রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, দার্শনিক এবং ফাউন্ডার ফাদারস, যিনি ১৮০৯ থেকে ১৮১৭ সাল পর্যন্ত আমেরিকার চতুর্থ রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ) অ্যালেক্সান্ডার হ্যামিল্টনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, “For God’s sake, my Dear Sir, take up your pen, select your most striking heresies, and cut him to pieces in the face of the public.” ।

ম্যাডিসন ঠিক তাই করেছিলেন। তিনি ‘হেলভিডিয়াসের’ কলম নামে পত্রিকায় লেখা শুরু করেন । তাঁর লেখাগুলি ফেডারেলবাদ বিরোধী আন্দোলনকে উৎসাহিত করতে সহায়তা করেছিল, যা প্রজাতন্ত্র ( রিপাবলিকান ) পার্টির ভিত্তি তৈরি করেছিল। তবে প্রারম্ভিক এই ‘রিপাবলিকান পার্টি’ বর্তমান সময়ের ‘রিপাবলিকান পার্টি’ থেকে পৃথক।

অ্যান্টি-ফেডারালিস্ট পার্টির প্রসার হিসাবে ১৭৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজনৈতিক সংগঠন ডেমোক্র্যাটিক-রিপাবলিকান পার্টি। টমাস জেফারসনের অনুসারীরা তাদের রাজতান্ত্রিক বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গিকে জোর দেওয়ার জন্য রিপাবলিকান নামটি যোগ করেছিলেন।আজকের ডেমোক্র্যাটিক পার্টি মূলত অ্যান্টি-ফেডারালিস্ট পার্টির প্রসার হিসাবে ১৮২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তবে ১৭৯২ সালেই এর শিকড় তৈরি হয়েছিল।এবং সেই শিকড় থেকেই বের হয়ে এসেছে আরেকটি দল যা আজ টিকে আছে রিপাবলিকান পার্টী নামে।

(চলবে)

লেখকঃ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক ও প্রযুক্তিবিদ

ইসলামিক দেশগুলি কতখানি ইসলামিক

আরও পড়ুন