Ads

ইংল্যান্ড ও ইসলাম: এক অনুসন্ধানী পথযাত্রা-৩

জিয়াউল হক 

আমাদেরকে অকাট্যভাবে এটা প্রমাণ করতে হবে যে, ইংল্যান্ডের যে অঞ্চলে আমরা মসজিদটি বিদ্যমান থাকার কথা বলছি, সেখানে হযরত ইসা আ: এর উম্মতরা এসেছিলেন বা আনা হয়েছিল এবং এখানে তারা বসবাস করেছিল। সেটা অকাট্যভাবে প্রমাণ করা সম্ভব আমাদের পক্ষে।
মুলত তিনজন রোমান সম্রাট; ট্রাজান, হেড্রিয়ান ও সেভেরাস, এরাই মধ্যপ্রাচ্যের বেশকিছু জাতিগোষ্ঠী এবং সিরিয়া’সহ উত্তর আরবের নাবাতিয়ান সাম্রাজ্য থেকে আরবদেরকে ধরে এনেছিলেন। এদের বেশিরভাগই প্যাগান মূর্তিপূজক হলেও অনেকেই ছিলেন হযরত ইসা আ: এর উম্মত।
রোমান সম্রাট ট্রাজান (Trajan ) দক্ষিণ স্পেনের সেভিলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৯৮ খৃষ্টাব্দ থেকে ১১৬ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত এ সাম্রাজ্যের শাসনভার বহন করেন। তাঁর শাসনামলের প্রথম দিকেই তিনি উত্তর আরবের নাবাতিয়ান ((Nabataean Kingdom) সাম্রাজ্য দখল করে রাজ্যটি রোমান শাসনে নিয়ে আসনে। আর সেটাই ছিল রোমান শাসনের অধিনে প্রথম কোন আরব জনপদ। তিনি নাবাতিয়ান এ সাম্রাজ্যটিকে রোমান সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করেন (১)। পরে এই জনপদটিই আরাবিয়া পেট্রা (Arabia Petraea) হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত হয় (আধুনিক জর্ডান ও সিনাই উপত্যকা)।
সম্রাট ট্রাজান পার্থিয়ান সাম্রাজ্য (Parthian Empire), তথা, আধুনিক পারস্য, সেটিসফোন বা আধুনিক বাগদাদ (Ctesiphon), আর্মেনিয়া, মেসেপটোমিয়া এসব অঞ্চলের প্রত্যেকটিতেই তিনি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন এবং রোমান সাম্রাজ্যকে সর্ববিশাল আকৃতিতে নিয়ে যান। রোমে ফেরত যাবার পথে ১১৭ খৃষ্টাব্দে পথেই মৃত্যুবরণ করেন।
নাবাতিয়ান আরবদের সাথে হেজাজ, বিশেষ করে, মক্কার আরবেদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। উত্তর আরবে নাবাতিয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল হযরত ইসমাইল আ: এঁর বংশধরদের হাত ধরে। নেবোজাত (Nebajoth) ছিলেন স্ত্রী রায়লা আর হযরত ইসমাইল আ: এঁর প্রথম সন্তান (২)।
এই নেবোজাতের বংশধরদের হাতেই এখানে একটা শক্তিশালী সমাজ ও সাম্রাজ্য গড়ে উঠে। ইতিহাসে এটাই নাবাতিয়ান সাম্রাজ্য হিসেবে পরিচিত। এরা সিনাই উপত্যকার আশে পাশের অঞ্চলে খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দিতে সমবেত হয়ে এ সাম্রাজ্যটির গোড়াপত্তন করেন (৩)
খৃষ্টপূর্ব ৩১২ খৃষ্টাব্দে বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডারের পরবর্তি শাসক প্রথম এ্যান্টিগোনাস (Antigonus I ) একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিলেন এদের বিরুদ্ধে, তথাপি তিনি রাজ্যটি দখল করতে পারেননি (৪)।
নাবাতিয়রা বিশ্ব ইতিহাসে এক অত্যন্ত সফল ও শক্তিশালী জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। সমাজ, রাষ্ট্র ও সভ্যতা গঠনে তারা ছিল অত্যন্ত চৌকষ দক্ষতার অধিকারী। ধন-সম্পদ ও শক্তি, শিক্ষা-দর্শন ও সংস্কৃতিতে তারা এতোটাই শক্তিশালী হয়ে উঠে যে, খৃষ্টপূর্ব ২৫ সাল নাগাদ দামেশক থেকে হেজাজ পর্যন্ত এই বিশাল ও বিস্তৃত এলাকায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে ফেলে।
এদের দৈনন্দিন জীবনের ভাষা ছিল আরবি। এ্যরামিক ভাষা থেকে এই নাবাতিয়রাই এক এক করে বাইশটি আরবি অক্ষর উদ্ভাবন করে। এদের হাত ধরেই আরবি লেখনপদ্ধতির সুত্রপাত (৫)।
মক্কার বুকে যে কুরাইশ বংশ নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল এবং যে কুরাইশ বংশে প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা. এর জন্ম, সেই কুরাইশ বংশের অন্যতম মূল ব্যক্তি কুসাই, তাঁর সাথে প্রিয় রাসুলুল্লাহ সাঃ এঁর রক্তসম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। রাসুলুল্লাহ সাঃ এঁর দাদার নাম আব্দুল মুত্তালিব। আব্দুল মুত্তালিবের দাদার নাম আব্দে মান্নাফ। আর এই আব্দে মান্নাফের বাবা ছিলেন কুসাই। কুসাই এই নাবাতিয়া সাম্রাজ্যেই বেড়ে উঠেছেন (৬)।
কুসাইয়ের বাবা কিলাবের অকাল মৃত্যু হলে মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে হয় রাবিয়া বিন হারাম বিন জিব্বা’র সাথে। রাবিয়া ছিলেন উত্তর আরবের নাবাতিয়ানের বাসিন্দা। বিধবা ফাতেমার দুই এতিম পুত্রসন্তান ছিল; যোহরা ও যায়েদ। যোহরা সাবালক হলেও যায়েদ ছিলেন শিশু। স্ত্রী ফাতেমাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবার সময় রাবিয়া শিশুপুত্র যায়েদকেও তার মা’সহ সাথে নিয়ে যান।
সেই থেকে যায়েদ মা ফাতেমা ও তার স্বামী রাবিয়ার ত্বত্তাবধানে বেড়ে উঠেন। ‘জন্মকাল থেকেই জন্মভূমি হতে দুরে অবস্থানকারী’ ব্যক্তিকে সে সমাজে ডাকা হতো ‘কুসাই’ বলে। যায়েদও জন্ম থেকেই জন্মভূমি মক্কা হতে দুরে নাবাতিয় সাম্রাজ্যে অবস্থান করায় তাকে কুসাই হিসেবে ডাকা হয় (৭)।
কুসাই যৗবনে পদার্পণ করলে মক্কায় ফিরে নাবাতিয়ান এবং কাহত্বানি আরবদের সহায়তা নিজের আত্মীয় স্বজনকে সংগঠিত করে তৎকালিন শাসক খোজা বংশকে উৎখাত করে সেখানে কুরাইশ বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন (৮)। এটা ছিল ৪৫০ খৃষ্টাব্দের ঘটনা।
এই নাবাতিয় জনপদেই আকাবার অবস্থান। এখানেই সেই বুসরা শহর যেখানে প্রিয় মুহাম্মদ সাঃ বারো বছর বয়সে চাচা আবু তালিবের সাথে বাণিজ্যে এলে পাদ্রি বাহিরা এবং দ্বিতীয়বার পঁচিশ বছর বয়সে বিবি খাদিজার বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে এলে অপর এক পাদ্রি জার্দিস তাঁকে দেখেই আসন্ন নবী হিসেবে চিনতে পেরেছিলেন।
প্রথমবারে বাহিরা আবু তালিবকে এবং দ্বিতীয়বার পাদ্রি জার্দিস বিবি খাদিজার দাস মাইসারাকে তিনি যে আরবদের মধ্যে অচিরেই নবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন, তা জানিয়ে ইহুদিদের হাত থেকে তাঁকে রক্ষার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ঘটনাগুলো ঘটেছিল ৫৮২ ও ৫৯৪ খৃস্টাব্দে মাত্র বারো বা তের বছরের ব্যবধানে।
ঘটনাগুলো অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, ৩২৫-৩২৬ খৃস্টাব্দে বাইজান্টাইনের কন্সটান্টিনেপলে সম্রাট কন্সটান্টিন কর্তৃক হযরত ইসা আ: এঁর উপস্থাপিত শিক্ষার খোল নেলচে পাল্টে দেবার আড়াইশত বছর পরেও সিরিয়া, ফিলিস্তিন জেরুজালেম, তথা আরব এই জনপদে তার তেমন কোন প্রভাব পড়েনি। তখনও এ জনপদে হযরত ইসা আ: এঁর আসল শিক্ষার অনেকটাই অক্ষত ছিল। আর সেই শিক্ষার উপরেই ভিত্তি করে নাবাতিয়ান জনপদের দুই দুই’জন পাদ্রি এক যুগের ব্যবধানেও প্রিয় নবী মুস্তাফা সাঃ কে চিনতে পেরেছিলেন। যখন পৃথিবীতে আর কেউই, এমনকি, তাঁর নিজের জন্মস্থান মক্কা ও হেজাজের বুকেও কেউ তাঁকে তখনও চেনেনি।
এই নাবায়িতান সাম্রাজ্য থেকেই একদল এসেছিলেন ইংল্যান্ডের মাটিতে। সেটাই আমাদেরকে ঐতিহাসিক তথ্যসুত্রে প্রমাণ করতে হবে এবং নাম পরিচিতি খুঁজে বের করতে হবে।
(সকল তথ্যসুত্র মূল গ্রন্থে থাকবে)
(চলবে)
লেখকঃ ইংল্যান্ডের বেসরকারি মানসিক হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ও প্রবাসী লেখক, ইংল্যান্ড 
আরও পড়ুন