Ads

ইতিহাসে ফিলিস্তিনঃ পবিত্র ভূমির মালিকানা (পর্ব-১)

আসাদ পারভেজ

প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে ভূমধ্য সাগরের তীরে গড়ে উঠে এক কালজয়ী রাষ্ট্র ‘ফিলিস্তিন’। ১২৫ বর্গ কিলোমিটারের পবিত্র ভূখণ্ড জেরুজালেম যার রাজধানী। ঐতিহাসিক নগরটি সভ্যতার আদিলগ্নে ছিল মরুশহর। ‘জেরুজালেম’ নামটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে হাজারো ইতিহাস, ঐতিহ্য, বীরত্ব ও উত্থান-পতনের উজ্বল প্রতিচ্ছবি। লুকিয়ে আছে ধর্মীয় আবেদনে ভরপুর বিশ্বের প্রাণকেন্দ্রের প্রাচীন জনপদের হাজারো বছরের কথা ও কাহিনি। এই প্রাচীন মরুশহরকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর তিন মহান বিশ্বাসের রূপরেখা; ইহুদি, খ্রিষ্টান এবং মুসলিম ধর্ম।
হাল আমলে এসে এই ভূখণ্ডেরই একটা অংশ নিয়ে মানবজাতির বিষফোঁড়া হয়ে আত্মপ্রকাশ করে ‘ইজরাইল’। জায়নবাদী চক্রান্তে দ্বিখণ্ডিত হয় ফিলিস্তিন। ফিলিস্তিনও আগ্রাসী ইজরাইল রাষ্ট্র নিয়ে বিশ্বময় যে দুই মেরুভিত্তিক সংঘাত, হানাহানি এবং বিভীষিকাময় যুদ্ধ- তা এই মরুশহর জেরুজালেমকে কেন্দ্র করেই।

অতীতকালে ফিলিস্তিনের সুনির্দিষ্ট সীমারেখা ছিল না। ১৯৪৯ সালে মিশর, জর্দান, লেবানন ও সিরিয়ার মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী দেশটির সীমানা মোটামুটিভাবে স্থির করা হয়। প্রায় ৩ হাজার বছর যাবৎ ফিলিস্তিন মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্ব রাজনীতি ও সংস্কৃতি এবং ধর্মতত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।

আল্লাহ পাকের আদেশে নবি মুসা আ.মিশরের শাসক ফেরাউনের শোষণ থেকে নিজ অনুসারীদের নিয়ে সিনাই পর্বতের পাদদেশ পর্যন্ত আসেন। দক্ষিণ জেরুজালেমের বেথেলহাম শহরে কুমারী মা মারইয়ামের গর্ভে আল্লাহর নির্দেশে নবি ঈসা আ.-এর জন্ম। মুসলমানদের প্রথম কেবলা আল-আকসা (বাইতুল মুকাদ্দাস) মসজিদ জেরুজালেমের এই পবিত্র মাটিতে। এলাকাটি ইহুদিদের জন্য প্রতিশ্রুত ভূমি, খ্রিষ্টান সমাজে পুণ্য ভূমি ও মুসলিম জাতির নিকট পবিত্র ভূমি।

আনুমানিক খ্রি.পূ. ২১৭০ সালে ইব্রাহিম আ. ‘আল-আকসা’ মসজিদটি নির্মাণ করেন। পরবর্তী সময়ে খ্রি.পূ. ১০০৪ সালে সুলায়মান আ. স্রষ্টার পবিত্র ইবাদত গৃহটির স্থানকে প্রসারিত করে স্থাপত্য তৈরি ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেন। খ্রি.পূ. ৫৮৬ সালে মেসোপটেমিয়ার রাজা নেবুচাদনেজারের হাতে প্রথমবারের মতো আল-আকসা (ফার্স্ট টেম্পল) মসজিদ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তিনি ইহুদি যাজক ও গণ্যমান্যদের বন্দি করে বেবিলনে নিয়ে যান। খ্রি.পূ. ৫১৬ সালে এটি পুনর্নির্মিত হয়। কিন্তু ৭০ সালে রোমান সাম্রাজ্যের সেনাধ্যক্ষ টাইটাস রাজা হেরড কর্তৃক পুন:সম্প্রসারিত স্রষ্টার ইবাদত ঘরটি (আল-আকসা বা সেকেন্ড টেম্পল) দ্বিতীয়বার ধ্বংস পরবর্তী ইহুদিদের আবারও নির্বাসনে পাঠানো হয়। এতে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের প্রাধান্য লোপ পায়। কিন্তু স্বভাব নষ্ট এই জাতির থেকে যাওয়া অংশ তখনও চরম বিশৃঙ্খল জীবনযাপনে ব্যস্ত- তাই-তো চূড়ান্ত রোষানলে পড়ে রোমানদের। ১৩২-১৩৫ সালে কঠোরভাবে দমন করা হলে ফিলিস্তিনে তাদের সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। পরিশেষে তারা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এখান থেকেই যাযাবর ইহুদি জাতির নব অধ্যায়ের সূচনা।

৬৩৬ সালে সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. ও আমর ইবন আল-আস রা.-এর নেতৃত্বে জেরুজালেমের মূল ভূখণ্ড জয়ের জন্য মুসলমানরা অবরোধ করেন। পরে বাইজেন্টাইন সম্রাটের প্রতিনিধি ও স্থানীয় খ্রিষ্টান গির্জার প্রধান যাজক প্যাট্রিয়াক সোফ্রনিয়াস-এর প্রস্তাবনা অনুযায়ী উমর রা.-এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে ৬৩৭ সালে পবিত্র মাটিতে মুসলিম বিজয় রচিত হয়। এরপর উমাইয়া, আব্বাসীয়, ফাতিমীয় ও সেলজুক খিলাফতের অধীনে দীর্ঘ সময় মুসলিম শাসনে পবিত্র নগরটি নিরাপদে ছিল। কিন্তু খ্রিষ্টানদের কারণে ১০৯৫-১২৯১ সাল পর্যন্ত চলমান ক্রুসেডে পবিত্র শহরটি অস্থির হয়ে ওঠে। ক্রসেডের প্রথমদিকে মুসলমানদের নেতৃত্ব দেন সেলজুক সাম্রাজ্যের সিরিয়া প্রদেশের শাসক নুরউদ্দিন জেনগি। এরপর মহাবীর সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবির নেতৃত্বে ১১৮৭ সালে হাত্তিনের যুদ্ধে মুসলিমদের জয় হয়। একই বছরে একর জয়ের পর ২ অক্টোবরে (৫৮৩ হিজরি ২৭ রজব) মহাবীর সালাউদ্দিন বাইতুল মুকাদ্দাসে বিজয়ী বেশে প্রবেশ করেন। আইয়ুবীয় সালতানাতের অধীনে ফিলিস্তিন হয়ে উঠে পৃথিবীর স্বর্গরাজ্য। এই মহাবীরের মৃত্যুর পরও একাধিক ক্রসেডের আয়োজন করে খ্রিষ্টান সমাজ লাভবান হতে পারেনি। শেষ ক্রুসেডে খ্রিষ্টানরা সুলতান বেইবার্সের কাছে শোচনীয় পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়। ফিলিস্তিনের মাটিতে আবারও মামলুক সালতানাতের হাত ধরে আব্বাসীয় খিলাফত পুন:প্রতিষ্ঠা পায়।

১৩৯৯ সালে তৈমুর লঙ ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমি দখলে নেন। কিন্তু ৫ বছর পরেই জেরুজালেমর ক্ষমতা সুলতান ফারাজের হাতে ফিরে আসে। অবশেষে ১৫১৬ সালে আলেপ্পোর কাছে মামলুকদের পরাজিত করে সুলতান প্রথম সেলিম জেরুজালেম জয় করেন। তিনি পরবর্তী বছরের ২০ মার্চ নগরীর চাবি গ্রহণ করে পবিত্র মাটিতে সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। এই জয়ের মধ্য দিয়ে পবিত্র শহর জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ উসমানীয় খিলাফতের অধীনে প্রায় চারশত বছর ছিল।

৭০ সালে যাযাবর জীবন গ্রহণ পরবর্তী ঊনবিংশ শতকে এসে সোভিয়েত ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার ইহুদিরা। গবেষণায় দেখা যায়, ১৮৮১ সালে সম্রাট দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের হত্যা পরবর্তী ৩৩ বছরে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পোগ্রমের ফলে ২০ লাখ ইহুদি দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ফলে শতাব্দীর মাঝা-মাঝিতে ইহুদিরা সোভিয়েত ইউনিয়নে গোপনে একত্রিত হয়ে নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক নতুন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা করে; যার নাম- জাইয়নবাদ। শতাব্দীর শেষদিকে এই জাইয়নিজম আন্দোলনকারীরাই ‘ফিলিস্তিনের বুকে ইহুদি রাষ্ট্র’ গঠনের লক্ষ স্থির করে। তখন থেকেই তারা ঝাঁকে ঝাঁকে ফিলিস্তিনের বুকে আসতে থাকে। পবিত্র ভূমিতে তৈরি হয় চরম বিশৃঙ্খলা। তা এড়াতে আরব বনেদি পরিবারগুলোর অনুরোধে জেরুজালেমের মেয়র ইউসুফ খালিদি অটোমান সুলতানের নিকট ইহুদি অভিবাসীদের নিষিদ্ধের আবেদন জানায়। ফলে সুলতান ১৮৮২ সালে অভিবাসী ইহুদিদের নিষিদ্ধ করেন। তারপরও দুনিয়ার নিপীড়িত ইহুদিরা আসতে থাকে ফিলিস্তিনে।

রাশিয়ান ইহুদি পণ্ডিত লিওন পিনস্কার সর্বপ্রথম ১৮৮৯ সালে `Auto Emancipation’ ‘ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। তিনি লিখেন- ‘আমাদের অবশ্যই জীবন্ত জাতি হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে হবে।’ মূলত তিনিই এই লেখনির মাধ্যমে সর্বপ্রথম জাইয়নিজম আন্দোলনের কথা প্রচার করে। তার নেতৃত্বে প্রথমবারের মত জাইয়নের প্রেমিক (Hovevei Zion) নামে ইহুদি সমিতি গঠন হয়। এরপর অস্ট্রীয় ইহুদি চিন্তাবিদ নাথান বার্নবম ১৮৯০ সালে Self Emancipation বইতে জাইয়নিস্ট ও জাইয়নিজম শব্দগুলো নিয়ে আসে। পরিশেষে ১৮৯৬ সালে অস্ট্রীয় ইহুদি সাংবাদিক ড. থিওডর হার্জেল (ইহুদিবাদের জনক) জাইয়নিজমের স্বাভাবিক কাজকে রাজনৈতিক রূপ দেন। পরের বছর তার নেতৃত্বে সুইজারল্যান্ডের ‘বাসল শহরে’ প্রথম বিশ্ব ইহুদি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে `World Zionist Organization’ এবং ‘Federation of American Zionist’-এর মতো সংস্থাগুলো গঠিত হয়।ফিলিস্তিন-ই হবে ইহুদিদের চূড়ান্ত আবাসভূমি- যা একই সভাতে গৃহীত হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অভিশাপ নিয়ে আসে ফিলিস্তিনসহ পুরো মুসলিম জাতির জন্য। এ সুযোগে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীরা ফিলিস্তিনের পবিত্র মাটিতে আরব ও ইহুদিবাদী নামে পরস্পর বিরোধী জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটান। বিংশ্ব শতাব্দির শুরুতে মধ্যপ্রাচ্য ও সুয়েজ খালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী (ব্রিটিশ, আমেরিকা, ফ্রান্স, রাশিয়া) স্বার্থ বড়ো আকার ধারণ করে।

যুদ্ধের দামামায় কাতরাচ্ছে মিত্রশক্তির সাম্রাজ্য। তখনই ধুরন্ধর ইংরেজ জাতির শয়তানি চক্রান্তে পড়েন আরব জাতীয়তাবাদী নেতা শরিফ হোসেন হাজ্জাজ। তুরস্কের বিরুদ্ধে আরব সমর্থন লাভের জন্য ব্রিটিশরা মিশরে নিযুক্ত তাদের হাইকমিশনার স্যার হেনরি ম্যাকমাহনকে দায়িত্ব দেয়। তিনি শরিফ হোসেনের সাথে বছরব্যাপি যোগাযোগ রক্ষা করেন। পরিশেষে ১৯১৬ সালের ৩০ জানুয়ারিতে ম্যাকমাহন শরীফ হোসেনের নিকট মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে পত্র পাঠান। সেই পত্রে ম্যাকমাহন শরীফ হোসেনের দাবি অনুযায়ী এডেন ব্যতীত সমগ্র আরব উপদ্বীপ, ইরাক, ও বৃহত্তর সিরিয়ার (সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন ও আধুনিক জর্ডান) সমন্বয়ে ঐক্যবদ্ধ একটি আরব রাষ্ট্রের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের সমর্থনের কথা ব্যক্ত করেন। বিনিময়ে আরবরা অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে যুদ্ধে নামবে।

একই সময়ে চরম হঠকারি দেশটি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ফ্রান্সের সাথে গোপনে সাইকিস-পাইকট চুক্তির মাধ্যমে সমগ্র আরব অঞ্চল ভাগের চক্রান্তে লিপ্ত হয়। চুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধ শেষে তিনটি দেশ কনফেডারেশনের মাধ্যমে জেরুজালেম নেওয়ার কথা থাকলেও হঠকারী ব্রিটিশরা তা একাই দখল করে।
শেষ পর্যন্ত শরীফ হোসেন ১৯১৬ সালে ব্রিটিশ চত্রান্তে অটোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সিরিয়া ও ফিলিস্তিন জয় করে নিলে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র সম্পূর্ণরূপে পাল্টে যায়। সে সুযোগে পরের বছর ব্রিটিশ বাহিনী অ্যাডমন্ড এলেনবির নেতৃত্বে দামেস্কের পথে এগিয়ে আসে।

অপরদিকে ধুরন্ধর ব্রিটিশরা ইহুদি নেতাদেরকে নতুন দেশের আশ্বাস দেয়। যুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ সরকার রাসায়নিক উপাদানের অভাবে যুদ্ধে হেরে যাওয়ার উপক্রম হয়। ঠিক সেসময় ড. ওয়াইজম্যান কৃত্রিম উপায়ে এসেটিলিন আবিস্কার করেন। ফলে যুদ্ধের ফলাফল মিত্র শক্তির পক্ষে যেতে শুরু করে। এর প্রেক্ষিতে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব আর্থার জেমস বেলফোর ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটিশ ইহুদি সংগঠনের নেতা লর্ড রথচাইল্ডকে লিখেন-ব্রিটিশ সরকার ইহুদি জনগণের জন্য ফিলিস্তিনে জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অনুগ্রহ সহকারে বিবেচনা করে (His Majesty’s Government View with Favour the Establishment in Palestine of a National Home for the Jewish People)| এটি বেলফোর ঘোষণা হিসাবে পরিচিত।

ব্রিটিশদের এমন আচরণে আরবদের মনে সন্দেহের দানা বাঁধে। তখন ব্রিটিশরা তাদের বোঝাতে সক্ষম হয় যে, স্থানীয় মুসলমানরাই পুরো আরবের ক্ষমতা পাবে। শেষে ১৯১৮ সালের ১ অক্টোবরে ফয়সালের আরব বাহিনীর সহায়তা নিয়ে ব্রিটিশ এলেনবির বাহিনী দামেস্কে চূড়ান্ত আঘাত হানে। একই বছরের ৩০ অক্টোবর তুরস্কের পরাজয়ের ভেতর দিয়ে আরব উপদ্বীপে চারশত বছরের তুর্কি শাসনের অবসান ঘটে। আর তখনই রচিত হয় ফিলিস্তিনের ভাগ্য-ললাটে দুর্ভাগ্যের কালিমা।

বেলফোর ঘোষণার পর পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে বানের স্রোতের মতো আসতে থাকে। ব্রিটিশরা তাদেরকে পুনর্বাসনে সার্বিক সহায়তা করে। তাদের জমি কেনার অধিকার দেওয়া হয়। ধনী শিক্ষিত যাযাবর ইহুদিদের প্রভাবের মুখে গরীব আরবরা জমি, ব্যবসা ও সম্পত্তি হারাতে থাকে।

১৯৩৩ সালে জার্মানির চ্যান্সেলর হন হিটলার। ক্ষমতা গ্রহণের পর শুরু হয় ইহুদি নিধন। আবারও ফিলিস্তিন অভিমুখে যাযাবর জাতির পথচলা। অতিরিক্ত ইহুদি অনুপ্রবেশের কারণে ১৯২০ ও ১৯২৯ সালের চাইতেও ১৯৩৬-এ ভয়াবহ আরব-ইহুদি দাঙ্গা দেখা দেয়। এ দাঙ্গা পরবর্তী মে মাসে ব্রিটিশ সরকার পিলকমিশন গঠন করে। কমিশনের রিপোর্টে দাঙ্গার জন্য অধিক মাত্রায় ইহুদি অভিবাসন ও আরব ভূমি দখলকে দায়ী করা হয়। তবে হঠকারি সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে তারা ফিলিস্তিনকে তিনভাগে বিভক্ত করারও প্রস্তাব রাখে। আরব নেতারা এই রিপোট প্রত্যাখ্যান করে। কমিশনের রিপোর্টটি এতটাই পক্ষপাতপূর্ণ ছিল যে, স্বয়ং ইহুদি পরিষদের কার্যনির্বাহী সভাপতি বেন গুরিয়ন বলেছিলেন, ‘ইহুদিরা স্বপ্নেও যা আশা করেনি, তা দেওয়ার জন্য পিল কমিশন প্রস্তাব করেছে।’

ঊনবিংশশতকের চল্লিশের দশকে ইহুদিরা আমেরিকার শরণাপন্ন হয়। ১৯৪২ সালে ওয়াইজম্যান নিউইয়র্কের ইহুদি সম্মেলনে মার্কিনদের সাথে বিটমোর প্রোগ্রাম নামে একটি প্রস্তাব পাস করিয়ে নেন। বিটমোর প্রোগ্রামের পাশকৃত প্রস্তাব অনুসারে আমেরিকা ফিলিস্তিনের বুকে ইহুদিদের জন্য বিশেষ আবাসভূমি গড়ে দেবে। ১৯৪৪ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইহুদি সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান প্রায় এক লাখ ইহুদিকে ফিলিস্তিনে গ্রহণের জন্য প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করে। তারা সেইদিন যাযাবর ইহুদিদেরকে পবিত্র ভূমিতে অবৈধভাবে জড়ো করার মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে এক অশুভ বার্তা দিয়েছিল।

জাতিসংঘে ফিলিস্তিন সমস্যাঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে ব্রিটিশরা তৎপর হয়। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে বিষয়টি তারা জাতিসংঘে উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৪৭ সালের ২ এপ্রিল এ সমস্যা সমাধানের পথ বের করার জন্য ব্রিটিশ সরকার জাতিসংঘকে অনুরোধ জানায়। এরপর সমস্যা সমাধানকল্পে জাতিসংঘ United Nations Special Committee on Palestine (UNSCOP) গঠন করে। যার উপর দায়িত্ব দেওয়া হয় ফিলিস্তিন সংক্রান্ত যেকোনো প্রশ্ন তদন্ত করে ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জাতিসংঘে প্রতিবেদন দাখিল করার।তাছাড়া সীমানা নির্ধারণের জন্য ৬ সদস্যের এডহোক কমিটি করা হয়।

১১ সদস্য রাষ্ট্রের UNSCOP -এর রিপোর্ট দুটি পরিকল্পনায় বিভক্ত ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ পরিকল্পনায় জেরুজালেমকে আন্তÍর্জাতিক নগরী হিসাবে আলাদা এবং অবশিষ্ট ফিলিস্তিন নিয়ে আরব ও ইহুদি নামক দুটি রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করা হয়। ভারত, ইরান ও যুগোস্লাভিয়া সমর্থিত সংখ্যালঘিষ্ঠ পরিকল্পনায় আরব ও ইহুদি রাষ্ট্রের সমবায়ে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। যার প্রত্যেকটি অঙ্গরাজ্য স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে।

(চলবে)

পরের পর্ব-ইতিহাসে ফিলিস্তিনঃ পবিত্র ভূমির মালিকানা (পর্ব-২)

লেখকঃ গবেষক, কলামিস্ট ও মানবাধিকারকর্মী

আরও পড়ুন