Ads

ইতিহাসে ফিলিস্তিনঃ পবিত্র ভূমির মালিকানা (পর্ব-২)

আসাদ পারভেজ

১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর ইহুদিদের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। ঐ দিন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৮১ (২) প্রস্তাবে অর্থনৈতিক সংযোগসহ ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করার সুপারিশ করে। সেই সাথে উভয় রাষ্ট্রের সীমান্ত নির্ধারণ করা হয়। পরিষদ ১৯৪৮ সালের ১ আগস্ট ব্রিটেনের ম্যান্ডেট শেষ করার সিদ্ধান্তÍÍ নেয়। এবং এ দু’মাসের মধ্যে রাষ্ট্র দুটো প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত পাশ হয়। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে Five- Nations UN Commission গঠন করার কথা। এতে আরো বলা হয় যে, যদি কেউ বিভক্তিকরণ পরিকল্পনাকে জোর করে পরিবর্তন করতে চায় এবং সেটি যদি শান্তির প্রতি হুমকি বলে বিবেচিত হয়, তখন তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নিরাপত্তা পরিষদের সাহায্য নেওয়া হবে। সাধারণ পরিষদের অনুরূপ প্রস্তাবে আরববাসীগণ ক্ষুব্ধ হয়।

প্রথম আরব-ইজরাইল যুদ্ধঃ ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনের উপর ম্যান্ডেটের অবসান ঘটিয়ে সম্পূর্ণ বাহিনী নিয়ে চলে যায়। ম্যান্ডেট অবসানের আগমূহুর্তে ইহুদি জাতীয় প্রশাসনের প্রধান বেন গুরিয়ন তেল আবিবে ‘ফিলিস্তিনের বুকে ইজরাইল’ নামক ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। ঘোষণার ১১ মিনিট পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ইজরাইলকে কার্যত স্বীকৃতির(De Facto Recognition) কথা প্রকাশ করে। ইজরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা আরবলীগের সিদ্ধান্তের একেবারে পরিপন্থী। তাই আরবলীগের সদস্য রাষ্ট্র মিশর, জর্দান, লেবানন, সিরিয়া ও ইরাক থেকে আরব সেনা ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে। অতঃপর ১৯৪৮ সালের ১৫ মে প্রথম আরব-ইজরাইল যুদ্ধ শুরু হয়।

মধ্যস্ততায় জাতিসংঘঃ আরব-ইজরাইল যুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪৮ সালে UNTSO গঠন করে। ২০ মে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সুইডেনের Count Folke Bernadotte কে মধ্যস্ততাকারী হিসাবে ফিলিস্তিনে পাঠায়। কর্তব্য পালনকালে তিনি ইজরাইলী ঘাতকের হাতে নিহত হন। তারপর সেখানে Rulph Bunche-কে পাঠানো হয়। তিনি একই বছরের শরৎকালে মিশর-সিরিয়া ও ইজরাইলের মধ্যে অস্ত্র বিরতির ব্যবস্থা করেন। পরের বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মিশর ও ইজরাইলের মধ্যকার যুদ্ধবিরতি চুক্তি মোতাবেক গাজা এলাকা মিশরকে দেওয়া হয়। কিন্তু সীমারেখা এমনভাবে টানা হয়, যেখানে অনেক আরব গ্রাম ইজরাইলের মধ্যে থেকে যায়। মার্চে লেবানন ও ইজরাইল, এপ্রিলে ট্রান্সজর্দান ও ইজরাইল এবং জুলাই মাসে সিরিয়া ও ইজরাইলের মধ্যে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির বিনিময়ে ফিলিস্তিনের বাকী অংশ পায় জর্দান।

আরবলীগের সাথে ইজরাইলের যুদ্ধ বিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর দেখা যায়, ইজরাইল তার পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি ভূমির অধিকারী। ফলে আরব উদ্বাস্তু নিয়ে নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়। ইজরাইল যে সব আরব ভূমি দখল করে, সেখানকার ফিলিস্তিনি জনগণ পার্শ্ববর্তী আরব দেশসমূহের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করে। ইজরাইলী আক্রমনের ভয়ে ভীত এ ধরণের শরণার্থী সংখ্যা ১৯৪৫ সালেই ছিল ৭ লক্ষ। পরবর্তী সময়ে ইজরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পরবর্তী ফিলিস্তিনের প্রায় ৭০% অধিবাসী স্থানচ্যুত হয়ে পড়ে।

সুয়েজ খাল সংকটঃ ১৯৫৬ সালে মিশরের সুয়েজ খাল জাতীয়করণকে কেন্দ্র করে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইজরাইল গোপন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। চুক্তির ক্ষমতাবলে ইজরাইল ২৯ অক্টোবরে মিশর আক্রমণ করে। মিশরের প্রেসিডেন্ট নাসেরও দৃঢ়তার সাথে পাল্টা জবাব দেন। এক্ষেত্রে তিনি অন্যান্য আরব দেশের সমর্থন পান। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছিল যে আরবদের দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু যুদ্ধের তৃতীয় দিনে মার্কিন ইন্ধনে ইজরাইলের সাথে ব্রিটেন ও ফ্রান্স সম্বলিত আক্রমণ চালালে দৃশ্যপট পালটে যায়। যুদ্ধের বিভীষিকাময় সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন মিশরের পক্ষ অবলম্বন করে। ৪ নভেম্বর সাধারণ পরিষদ ৫৭-০-১৯ ভোটে একটি প্রস্তাব পাশ করে। জাতিসংঘ মহাসচিবকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ করে UN Emergency Force গঠন করে তদারকির ব্যবস্থা করতে দায়িত্ব দেওয়া হয়। অবশেষে ৬ নভেম্বর মধ্যরাত থেকে যুদ্ধ বন্ধ হয়।

পিএলওঃ ইজরাইলের দখলদারিত্ব থেকে দেশকে মুক্ত ও মাতৃভূমির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ফিলিস্তিনিরা বিভিন্ন গেরিলা গ্রুপে সংঘবদ্ধ হতে থাকে। ১৯৬৪ সালে এরূপ কয়েকটি সংগঠন নিয়ে অকুতভয় সেনানী ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় পিএলও।
সিক্স ডে ওয়ারঃ ১৯৬৭ সালে মিশর সরকার লোহিত সাগরে ইজরাইলি জাহাজের প্রবেশ বন্ধ করে দেয়। জবাবে ইজরাইল ৫ জুন কায়রো বিমানবন্দরে বোমা বর্ষণের মাধ্যমে ৬দিন ব্যাপী যুদ্ধের সূচনা করে। যুদ্ধে মিশরের পক্ষে জর্ডান ও সিরিয়া অংশগ্রহণ করে। অপরদিকে আবারও যুক্তরাষ্ট্রের মদদে ইজরাইল তড়িৎ গতিতে জর্ডানের পশ্চিম তীর, সিনাই, গাজা, পূর্ব জেরুজালেমসহ সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে। ছয়দিনব্যাপী এই যুদ্ধে ইজরাইল মিশরের পাঁচ হাজার যোদ্ধাকে বন্দি করে। অবশ্য মিশরীয় পাঁচ হাজার যুদ্ধবন্দির বিনিময়ে জর্ডানের কাছ থেকে ইজরাইল মোসাদের গুপ্তচর লোৎসকে ফেরত পায়।

২৪২ নং প্রস্তাব গ্রহণঃ ১৯৬৭ সালের ২২ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ফ্রান্সের সমর্থনে নিরাপত্তা পরিষদ ফিলিস্তিনের ব্যাপারে ২৪২ নং প্রস্তাব গ্রহণ করে। প্রস্তাবের মূল বিষয় হল- দখলকৃত আরব ভূখন্ড থেকে ইজরাইলী সেনা প্রত্যাহার। ১৯৬৭ সালের ৫ জুন যুদ্ধের পূর্ব সীমান্তে সকল পক্ষের প্রত্যাবর্তন। ইজরাইল ও আরব রাষ্ট্রসমূহ একে অন্যকে স্বীকার করে নেওয়া। ফিলিস্তিনের উদ্বাস্তুদের সমস্যার ন্যায় সঙ্গত সমাধান করা। দুর্ভাগ্য যে, প্রস্তাবটি ইজরাইল প্রত্যাখ্যান করে।

রজার্স পরিকল্পনাঃ দ্বিতীয় আরব-ইজরাইল যুদ্ধপরবর্তী ইজরাইল তার অধিকৃত অঞ্চলে ফিলিস্তিনি জনগণের উপর চরমভাবে নিপীড়ন-নির্যাতন শুরু করে। তাদের আগ্রাসী আচরণের বিরুদ্ধে পিএলও প্রতিশোধ গ্রহণে তৎপর হয়। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ১৯৭০ সালের জুন মাসে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়াম পি রজার্স নতুন পরিকল্পনা উত্থাপন করেন। এতে বলা হয় যে, পরোক্ষ আলোচনার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইজরাইল দখলকৃত ভূমি থেকে সরে যাবে এবং মিশর ইজরাইলকে স্বীকৃতি দেবে। পিএলও প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে।

তেল অবরোধঃ ১৯৭৩ সালে ইজরাইল তার অধিকৃত এলাকায় গণহারে বসতি স্থাপন করতে থাকে। সকলপ্রকারের আহ্বান প্রত্যাখান করে আগ্রাসী হয়ে উঠে ইজরাইল। তখন মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত। ১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর মিশরীয় সেনাবাহিনী দৃঢ়তার সাথে দুদিক থেকে ইজরাইলের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায়। যুদ্ধে ইজরাইলকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। তখন আরব দেশগুলো পাশ্চাত্যের ওপর তেল অবরোধ আরোপ করে। অন্যদিকে মিশরকে সিরিয়া ও ইরাক সাহায্য করে। এ যুদ্ধে নিজেদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা গড়ে উঠাই ছিল আরবদের বড়ো সাফল্য।

মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়াঃ বিশ্বজনমতের অভিমত যে, ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্য তথা বিশ্বশান্তি কোনো মতেই সম্ভব নয়। অথচ সকল শান্তি প্রচেষ্টায় বিষয়টি পাশ কাটানো হয়। ১৯৭৩ সালের যুদ্ধের পর আরব দেশগুলোর তেল অবরোধ যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের প্রতি আগেকার মনোভাব পালটাতে বাধ্য করে। মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার দ্বন্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে হেরে যাওয়ার আতঙ্ক মার্কিনদের চেপে ধরে।
যুদ্ধ পরবর্তী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জার Shutle Diplomacy–এর মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। বছরের ২১ ও ২২ ডিসেম্বর জেনেভাতে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা হয়। সম্মেলনে মিশর ও সিরিয়াকে তাদের হারানো এলাকার কিছু অংশ ফেরত দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর মার্কিন মধ্যস্থতায় মিশর ও ইজরাইলের মধ্যে অন্তÍবর্তীকালীন শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির ফলে আরও অধিকৃত এলাকা মিশর ফেরত পায় এবং প্রায় এক দশক পরে সুয়েজ খাল চালু হয়। এই চুক্তিকে পিএলও এবং সিরিয়াসহ আরব রাষ্ট্রগুলো প্রত্যাখ্যান করে।

মিশর কর্তৃক ইজরাইলকে স্বীকৃতিঃ মিশর নিজের মতো করে মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা সমাধান ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নেয়। তা বাস্তবায়নে ১৯৭৭ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ইজরাইল সফর করেন। ইজরাইলের জাতীয় সংসদে তিনি ভাষণ দেন। ভাষণে দু’দেশের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার আবেদনের সাথে ইজরাইলকে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ পূর্ববর্তী সীমানায় ফিরে যাবার অনুরোধ জানান। ১৯৭৮ সালের ১৭ নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মধ্যস্থতায় প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ও ইজরাইলী প্রধানমন্ত্রী মোনাহেম বেগিন এক আলোচনায় মিলিত হন। ক্যাম্প ডেভিডে অনুষ্ঠিত এই আলোচনা সভায় তারা দুটো চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর প্রথমটি হচ্ছে- মিশর ও ইজরাইল এক বছরের মধ্যে শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করবে। অতঃপর ইজরাইল সিনাই থেকে তার দখল সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করবে।

দ্বিতীয়টিতে ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে উভয় দেশ এক সাথে কাজ করার অঙ্গিকার করে। ক্যাম্প ডেভিড চুক্তিটি চূড়ান্তভাবে স্বাক্ষরিত হয় ১৯৭৯ সালের ৬ মার্চ। সিনাই অঞ্চলে ইজরাইলের মাঝামাঝি জাতিসংঘের বাফার অঞ্চলও গঠনের ব্যাপারে সম্মতি প্রকাশ করা হয়। এছাড়াও তাদের মধ্যে পরস্পর রাষ্ট্রদূত বিনিময় এবং অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হয়। চুক্তির শর্তানুসারে ইজরাইল পর্যায়ক্রমে সিনাই থেকে তার উপস্থিতি প্রত্যাহার করে নেয়। আরব লীগ ও ওআইসি চুক্তিটি প্রত্যাখ্যান করে। ইজরাইলের সাথে এমন চুক্তির কারণে মিশরকে সংস্থাদুটি থেকে বহিস্কার করা হয়। এই চুক্তি ইজরাইলী অস্তিত্বের প্রতি কোনো আরব দেশের প্রথম স্বীকৃতি। যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিটিকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির জন্য ভবিষ্যতের দিক দর্শন ঘোষণা করে। কিন্তু ১৯৮২ সালে ইজরাইল সরকার লেবানন আক্রমণ এবং ব্রিটেন সুয়েজ খাল দখল করলে মিশরের সাথে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার সমাধানের জন্য একটি আন্তÍর্জাতিক সম্মেলন আহ্বানের কথা বলে জাতিসংঘ। কিন্তু দুই পরাশক্তির স্বার্থের প্রতিবন্ধকতার কারণে এই প্রয়াস ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে ইজরাইলী আগ্রাসন দিনের পর দিন বৃদ্ধি পায়।

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ঘোষণাঃ ১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে পিএলও এবং পিএনসি-র সম্মিলিত প্রধান হিসেবে ইয়াসির আরাফাত স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন। এতে বলা হয় জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর, গাজা ও জেরুজালেম নিয়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হবে।

ফিলিস্তিন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থঃ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজনে মধ্যপ্রাচ্যে ঝেঁকে বসেছে যুক্তরাষ্ট্র। আরব রাষ্ট্রসমূহে বিরোধ সৃষ্টি আর ইজরাইলকে সমর্থন উভয় কাজে পারদর্শী দেশটি। ভূখন্ডের গুরুত্ব বিচারে মধ্যপ্রাচ্যের মাটি পৃথিবী সেরা। সোভিয়েত বিরোধী আন্দোলনে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ সমূহকে যুক্তরাষ্ট্রের দরকার।

আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্যও মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক গুরুত্ব অবহেলা করা যায় না। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্য নীতির সাথে খনিজ তেলের স্বার্থ জড়িত। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও জাপানের মোট প্রয়োজনের ৭৫% তেল মধ্যপ্রাচ্য সরবরাহ করে। যুক্তরাষ্ট্রে ৬০ লক্ষের মত ইহুদি বাস করে। মার্কিন সরকারের সকল ইউনিটে প্রভাবশালী ইহুদি রয়েছে, যারা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে অভ্যন্তরীণ উপাদান হিসাবে কাজ করে।
মার্কিন অস্ত্র ব্যবসার প্রধান কেন্দ্র হলো মধ্যপ্রাচ্য। ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধান হলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অস্ত্রের চাহিদা কমে যাবে। তাছাড়া সোভিয়েত বলয় বৃদ্ধি মানেই মার্কিন ক্ষতি শাধিত হওয়া।

আন্তর্জাতিক প্রয়াসঃ ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের প্রচেষ্টা ছাড়াও অনেক আন্তÍর্জাতিক সংগঠন, নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের নিরলস প্রচেষ্টা রয়েছে। মরক্কোর ফেজ সম্মেলন থেকে ওআইসি’র প্রস্তাব; সৌদির বাদশাহ ফাহাদের ৮ দফা প্রস্তাব; মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারকের প্রস্তাব এবং দুই পরাশক্তির উদ্যোগে স্পেনের মাদ্রিদের সম্মেলন। যদিও মাদ্রিদ জর্দান, সিরিয়া ও লেবানন ইজরাইলের সঙ্গে আলোচনায় বসতে অস্বীকৃতি জানালে মাদ্রিদ সম্মেলন ব্যর্থ হয়।

ইজরাইল ও পিএলও পারস্পরিক স্বীকৃতিঃ অসলো শান্তি চুক্তির চূড়ান্ত ফলাফলে ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৯৩ সালে পিএলওও ইজরাইল পরস্পরকে স্বীকৃতি প্রদানে সম্মত হয়। স্বীকৃতির বিষয়টি তিনটি চিঠির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। প্রথম দুটি হচ্ছে আরাফাত ও আইজ্যাক রবিন পরস্পরকে সম্বোধন করে লেখা। অপর চিঠিটি মধ্যস্থতাকারী নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোহান জর্গেন হোলষ্টকে লেখা আরাফাতের চিঠি। ১৩ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউজের দক্ষিণ লনে পিএলওএবং ইজরাইলের মধ্যে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনি স্বায়ত্ত্বশাসন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে ইজরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিমন পেরেজ ও পিএলও-এর পররাষ্ট্র বিষয়ক দফতরের প্রধান মাহমুদ আব্বাস সই করেন।

ইজরাইলী প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন, পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাত, প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর, সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমিকার্টার ও জর্জ বুশ, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় সাড়ে তিন হাজার ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। ক্যাম্প ডেভিড চুক্তিটি যে টেবিলে স্বাক্ষরিত হয়েছিল, ঠিক ১৪ বছর পর একই টেবিলে এই চুক্তিও সই হয়। অসলো চুক্তির বদৌলতে ১৯৯৪ সালে গাজা ও জেরিকোতে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ পুলিশ বাহিনী গঠন করে।

হেবরন চুক্তিঃ ১৯৯৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রবিন পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনি স্বায়ত্বশাসন সম্পর্কিত দ্বিতীয় চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। অত:পর চুক্তি অনুযায়ী ‘প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল অথরিটি’ গাজা ও পশ্চিমতীরে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার অধিকার লাভ করে। এ সময় রামাল্লাকে তারা অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে ব্যবহার করে। ১৯৯৬ সালে স্বশাসিত ফিলিস্তিন প্রথমবারের মতো নির্বাচন আয়োজন করতে সক্ষম হয়। ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাত প্রেসিডেন্ট হন।

১৯৯৬ সালের জুন মাসের নির্বাচনে লিকুদ পার্টি জয়ে কট্টরপন্থী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইজরাইলের প্রধানমন্ত্রী হন। তার ক্ষমতায়নের পর শান্তিপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হতে থাকে। এ অবস্থায় মার্কিন বিশেষ দূত ডেনিশ ব্লুম মধ্যস্থতাকারী হিসাবে আলোচনার নতুন দ্বার উম্মোচন করেন। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি পশ্চিম তীরের হেবরন শহরে ফিলিস্তিনি শাসন সম্প্রসারণের ব্যাপারে ইজরাইল ও পিএলও-এর মধ্যে নতুন একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। শর্ত ছিল চুক্তি স্বাক্ষরের দশ দিনের মধ্যে হেবরনের ৮০শতাংশ এলাকা থেকে ইসরাইলী সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে। ইহুদী বসতি ও সংরক্ষিত সেনা ছাউনী ছাড়া পশ্চিম তীরের সমস্ত এলাকা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

ওয়াই রিভার চুক্তিঃ বর্ধিত হারে আবাসনের নামে জেরুজালেমের ইহুদি ছিটমহলগুলোতে ‘হার হোমা আবাসিক প্রকল্প’ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। ইজরাইল জেরুজালেমকে রাজধানী করার কথা ঘোষণা করে। এমতাবস্থায় ফিলিস্তিন ও ইজরাইলের মধ্যকার শান্তি প্রক্রিয়া হুমকির মুখে পড়ে। মার্কিন বিশেষ দূত ডেনিশ রস শান্তি আলোচনা অব্যাহত রাখেন। অবশেষে বিল ক্লিনটনের উদ্যোগে ১৯৯৮ সালের ২৩ অক্টোবর ম্যারিল্যান্ডের ওয়াই রিভার সম্মেলন কেন্দ্রে নেতানিয়াহু ও ইয়াসির আরাফাত ভূমির বিনিময়ে শান্তি (Interim Memorandum of understanding) চুক্তিতে সই করে।
এই চুক্তির প্রধান বিষয় হলো ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখলকৃত পশ্চিম তীরের ৪০ শতাংশ ভূমি ইজরাইল ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করবে। কিন্তু মাস না যেতেই ইজরাইল তা অস্বীকার করে। ফলে ১৩ শতাংশ ভূমির বিনিময়ে আবারও নতুন চুক্তি (শরম আল শেখ মেমোরেন্ডাম) সই হয়। বিনিময়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী দলগুলো ইজরাইলী বসতির উপর আক্রমন না করার অঙ্গীকার করে।

ফিলিস্তিন পরিস্থিতি আবারও আগেকার অবস্থায় উপনীত হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ব্যক্তিগত উদ্যোগে পুনরায় মধ্যস্ততা শুরু হয়। ১৯৯৯ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে জিতে লেবার পার্টির নেতা ইহুদ বারাক ক্ষমতায় বসেন। তিনি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সাথে ইতোপূর্বে সম্পাদিত চুক্তিগুলোর বাস্তবায়ন করার জন্য নির্বাচনী ইশাতেহারে ঘোষণা দিয়েছিলেন। ফলে তার ক্ষমতায় আগমন মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রতিষ্ঠায় নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়।

রোডম্যাপঃ ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানকল্পে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করা হয়। এই টিম ২০০৩ সালের ৩০ এপ্রিল রোডম্যাপ নামে একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করে। যার কাজ হলো ২০০৫ সালের মধ্যে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন ঘোষণা করা। জাতিসংঘ, ইইউ ও রাশিয়া শান্তি প্রতিষ্ঠায় সম্মত হয়। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার উপর। কিন্তু তাদের অবহেলার কারণে বিষয়টি প্রহসনে পরিণত হয়। ইজরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যার অন্যতম কারণ জেরুজালেম ও উদ্বাস্তু মানুষগুলো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র অনুরূপ ভূমিকা গ্রহণে ব্যর্থ হওয়ায় রোডম্যাপ পরিকল্পনা চরম ব্যর্থ হয়।

ফিলিস্তিনের প্রাসঙ্গিক অবস্থাঃ ফাতাহ ও হামাস ফিলিস্তিনের দুটি শক্তিশালী দল। ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর মাহমুদ আব্বাস দেশটির প্রেসিডেন্ট হন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরাইলের নিকট মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। এরই প্রেক্ষিতে গাজা থেকে ইজরাইলী বসতি উচ্ছেদ কার্যক্রম চলতে থাকে। কিন্তু ২০০৬ সালের ২৫ জানুয়ারীতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে হামাস জয়ী হলে শান্তি প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। কেননা, হামাস যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরাইলের নিকট একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। তারা হামাসকে রাজনৈতিক দল হিসাবে অস্বীকার করে। অপরদিকে হামাস ইজরাইলকে যুদ্ধনীতি দ্বারা মোকাবেলা করতে চায়। নির্বাচনের আগে ইজরাইল ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মাধ্যমে হামাস প্রধানসহ দুই শীর্ষ নেতাকে হত্যা করে। অপরদিকে হামাস ইজরাইলের ভেতর রকেট হামলা করে।
(চলবে)

আগের পর্ব-ইতিহাসে ফিলিস্তিনঃ পবিত্র ভূমির মালিকানা (পর্ব-১)

লেখকঃ গবেষক, কলামিস্ট ও মানবাধিকারকর্মী

আরও পড়ুন