Ads

ইতিহাসে ফিলিস্তিনঃ পবিত্র ভূমির মালিকানা (পর্ব-৩)

আসাদ পারভেজ

২০০৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ইজরাইল হামাসের কার্যক্রমকে সন্ত্রাসবাদ আখ্যা দিয়ে গাজা ভূখন্ডে সামরিক আগ্রাসন চালায়। ফলে শুরু হয় ইজরাইল ও হামাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ইজরাইলের বিমান ও স্থল হামলায় গাজায় মারাত্মক মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয়। এ অবস্থায় যুদ্ধ বন্ধের জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে কয়েকবার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তারপরও যুদ্ধ বিরতির প্রয়োজনে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি জাতিসংঘ। অতঃপর জাতিসংঘ মহাসচিব বানকি মুন যুদ্ধ বন্ধের জন্য মিশর, ইজরাইল, জর্ডান ও সিরিয়া সফর করেন। তার কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় যুদ্ধ বিরতি হলেও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বাধীনতার পথ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।

জাতিসংঘের তিন ক্যাটাগরির সদস্যপদ রয়েছে
ক. সদস্য রাষ্ট্র, খ. অসদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র, গ. ভোটাধিকার ছাড়া পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র।
২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর ২২টি আরব রাষ্ট্র ও ফিলিস্তিনের পক্ষে জর্ডানের রাষ্ট্রদূত ডিনা কাওয়ার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিন সঙ্কট নিরসনের প্রস্তাব তোলেন। নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের ভোটাভুটিতে প্রস্তাব পাশের জন্য ৯টি ভোটের প্রয়োজন ছিল। দুর্ভাগ্য দেশটির পক্ষে জর্ডান, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, লুক্সেমবার্গ, চাঁদ, চিলি ও আর্জেন্টিনাসহ আটটি দেশ ভোট দেয়। যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া বিপক্ষে ভোট দেয় এবং যুক্তরাজ্য, লিথুনিয়া, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও রুয়াণ্ডা মিলে ৫টি দেশ ভোট দানে বিরত থাকে। ফলে প্রস্তাবটি পাশে ফিলিস্তিন ব্যর্থ হয়। এ সময় যুক্তরাজ্যের সাবেক সিনিয়র ফরেন অফিসিয়াল ও কনজারভেটিভ নেতা ব্যারোনেস সাঈদা ওয়ার্সি বলেন ব্রিটেনকে অবশ্যই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিতে হবে।

নিরাপত্তা পরিষদের উপস্থাপিত প্রস্তাবটিতে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ পূর্ববর্তী সীমানাকে কেন্দ্র করে আলোচনার কথা বলা হয়। স্বাধীন ফিলিস্তিনের প্রস্তাবটি বাতিল হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৩১ ডিসেম্বর বুধবার রামাল্লায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে আইসিসি’র দলিলে স্বাক্ষর করেন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ফিলিস্তিনঃ ২০১৫ সালের ২ জানুয়ারি জাতিসংঘে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত রিয়াদ মনসুর আন্তর্জাতিক অপরাদ আদালতে যোগ দেয়ার জন্য নথিপত্র বান কি মুনের কাছে জমা দেন। ৬ জানুয়ারি রাতে জাতিসংঘ ট্টি টি (চুক্তি) ওয়েব সাইডে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বলেন- আগামী ১ এপ্রিল ২০১৫ সাল থেকে ‘আইসিসি’তে যোগ দিতে পারবে ফিলিস্তিন। জাতিসংঘ মহাসচিবের অনুমতি পাওয়ার সাথে সাথে ফিলিস্তিন আইসিসির ১২৩তম সদস্য দেশ হিসেবে গৃহিত হয়। এতে দেশটির আইনি ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

ইউরোপের দেশ সুইডেনের স্বীকৃতিঃ ২০১৪ সালের অক্টোবরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত প্রথম দেশ হিসেবে সুইডেন ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়। ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সও দেশটিকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে ভোট দেয়। তাছাড়া বেলজিয়াম ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে উদ্যোগ নেয়।

বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রথম দেশ হিসেবে স্বাধীন রাষ্ট্রের ধারণাকে স্বীকৃতি দেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে সুইডেনে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ দূতাবাস খোলতে যাচ্ছে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে সুইডেন ও ইজরাইলের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন দেখা দেয়। ২০১৫ সালের শুরুতে সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারগেট ওয়ালস্ট্রম ইজরাইল সফর করার কথা থাকলেও তা বাতিল করেন। অন্যদিকে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়ার পরই ইজরাইল সুইডেন থেকে তার রাষ্ট্রদূতকে দেশে ফেরত নিয়ে আসে।

সর্বশেষ পদক্ষেপ মেম্বার স্টেটঃ ইউনেস্কো ফিলিস্তিনকে তার পূর্ণ সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৭৩ দেশের মধ্যে ৫২টি দেশ ভোট দানে বিরত থাকলেও ১০৭-১৪ ভোটে ফিলিস্তিন জয় লাভ করে। কথা হলো দেশটিকে জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য পদ লাভ করতে হবে। এর জন্যে নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো প্রয়োগকারী বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের কব্জায় আনতে হবে। স্থায়ী পরিষদের সদস্যদের ভেটো প্রয়োগ বন্ধ করে নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে ৯ সদস্যের ভোট নিশ্চিত করতে পারলেই ফিলিস্তিনের সদস্য পদ লাভ সহজ হয়ে যাবে। কেননা এরপর প্রস্তাবটি যাবে সাধারণ পরিষদে, যেখানে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পেলেই উত্থাপিত প্রস্তাব পাশ হয়ে যাবে।

জাতিসংঘের ১৯৩টি দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশবাদে ১২০টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের সকল দেশই ফিলিস্তিনকে স্বাধীন দেশ হিসেবে বহু আগে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের পক্ষ অবলম্বন করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের পক্ষে ইজরাইলে যাওয়া আইনগত দণ্ডনীয় অপরাধ।

পর্যবেক্ষকের মর্যাদায় ফিলিস্তিন জাতিসংঘের মর্যাদা বৃদ্ধির পরপরই ফিলিস্তিনের নাম পরিবর্তন করা হয়। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রের দাপ্তরিক নাম বদলে করে ‘ফিলিস্তিন’ রাখে। ৩০ নভেম্বর ২০১২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ থেকে State of Palestine রাষ্ট্রের নামফলক পায় দেশটির কর্তৃপক্ষ।

মর্যাদা বৃদ্ধিতে যা হবেঃ ফিলিস্তিন এতদিন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ‘পর্যবেক্ষণ ভূখন্ড’ হিসেবে যোগ দিত। তারা এখন সদস্য নিয়ে এমন পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা পাবে- যা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে পৃথিবীর বৃহত্তম বিশ্ব সংস্থার পরোক্ষ স্বীকৃতি। এর মাধ্যমে পূর্ণ সদস্য হওয়ার পথে বহুদূর এগিয়ে গেল ফিলিস্তিন। ২০০২ সালে পূর্ণ সদস্য রাষ্ট্রের মর্যাদা পাওয়ার আগে সুইজারল্যান্ডও সদস্য নয় এমন পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হিসেবে জাতিসংঘে ছিল। বর্তমানে ফিলিস্তিনের সাথে এমন মর্যাদা ভোগ করছে ভ্যাটিকান সিটি।

ফিলিস্তিনের এ মর্যাদা অনাগত দেশটিকে নিম্নোক্ত ফায়দাগুলো দেবে- পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা এবং পূর্ব জেরুজালেমকে নিয়ে গঠিত ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে জাতিসংঘের পরোক্ষ স্বীকৃতি। দ্বিরাষ্ট্রীয় সমঝোতা আলোচনায় ইজরাইলের বিপরীতে ফিলিস্তিনের শক্ত অবস্থান। এখন থেকে ফিলিস্তিনি প্রতিনিধি জাতিসংঘের অধিবেশনের বিতর্কে অংশ নিতে পারবে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যোগ দেওয়ার সুযোগ থাকবে। এমন স্বীকৃতির কারণে ফিলিস্তিন বেশ কয়েকটি অঙ্গ-সংগঠন যেমন: আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত, সেখানে ফিলিস্তিন-ইজরাইল মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারবে।

২৯ নভেম্বর ২০১২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে অসদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ স্বপ্নদ্রষ্টা ইয়াসির আরাফাতের দীর্ঘ সংগ্রামের প্রাথমিক ভিত্তি রচিত হলো। ফিলিস্তিনিদের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস জাতিসংঘের এ স্বীকৃতিকে ‘জন্মসনদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

ট্রাম্পের ডিক্লারেশন- ২০১৭ সাল
বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সকল প্রকার সমালোচনা ও সতর্ক বার্তাকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়ে এবং নৈতিক চরিত্রের চরম অবক্ষয় করে ১৯৪৮ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্টুম্যানের পথেই হাটেন সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। একই রাষ্ট্র একই পথে ৬৯ বছর ৬ মাস ২২ দিন পরে ২৩তম দিনে আবারও জম্ম দিল নব অপকর্ম। এবার তারা ১৮০ কোটি মুসলমানের হৃদয়ে চরম আঘাত করার প্রয়াসে মাঠে নামল। সকল ন্যায় ও সত্যকে পদদলিত করল। মুসলমানদের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণস্থান ‘আল-আকসা’কে কেড়ে নেয়ার চূড়ান্ত পথে চলমান এই ক্রুসেডচক্র।

জ্যারেড কুশনার ও মোসাদের পরিকল্পিত পথে চলতে গিয়ে নির্বাচনী ওয়াদার বুলি টেনে আরববিশ্বসহ মানবতাবাদী পৃথিবীর প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করে ‘পবিত্র জেরুজালেম’ শহরকে শেষ পর্যন্ত ইজরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। একতরফা এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার ক্ষেত্রে তিনি জাতিসংঘ, আরব ও মুসলমান অধ্যুষিত দেশ, এমনকি মার্কিন মিত্রদের আপত্তিও মানেননি। নিজের একগুঁয়েমি সিদ্ধান্তেই অনড় রইলেন। বাংলাদেশ সময় ৬ ডিসেম্বর, ২০১৭ সালের রাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউজের ডিপ্লোমেটিক রিসিপশন রুম থেকে এক বিবৃতির মাধ্যমে বিতর্কিত এ ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে ইজরাইলের তেলআবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে সরিয়ে নেওয়া হবে বলেও জানান।

১৯৪৮ সালে ইজরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর যুক্তরাষ্ট্রই প্রথম জেরুজালেমকে দেশটির রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিল। বিষয়টি পাকাপোক্ত করার জন্য একটি আদেশেও স্বাক্ষর করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম। তিনি বলেন মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেম স্থানান্তর করা হবে। তবে এজন্য স্থান নির্ধারণে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। তিনি আরও বলেন এই স্বীকৃতি ছিল আমার নির্বাচনী অঙ্গীকার। স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, তিনি ব্যাক্তিগত উদ্দেশ্যে দেশের নিরাপত্তা ঝুকির মুখে ফেলেছেন। কিন্তু এহেন কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী জিম ম্যাটিস। মূলত এটি তাদের রাজনৈতিক কৌশল, কেননা ১৯৪৮ সালেও তারা এমন করেছিল।

ট্রাম্পের এমন ঘোষণার খবরে মধ্যপ্রাচ্যে আবারও চরম উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। ক্ষোভে ফেটে পড়ছে মুসলিম বিশ্ব এবং কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বিশ্ব সম্প্রদায়।

ফিলিস্তিনের ঘোরতর আপত্তি ও আরব বিশ্বে টানটান উত্তেজনার মধ্যেই ৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস, সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান, মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ও জর্ডানের বাদশাহ আব্দুল্লাহকে টেলিফোনে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ইচ্ছার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। এই ঘোষণা দিতে ট্রাম্পকে তারাসহ অনেকেই সর্তক করে দিয়েছেন। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা এই পদক্ষেপ ফিলিস্তিন-ইজরাইলের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রক্রিয়ায় ”ভয়ঙ্কর পরিণতি” ঘটাবে। তার অবৈধ ঘোষণার পর কার্যত এখন তাই হয়েছে।

ট্রাম্প কর্তৃক জেরুজালেমকে ইজরাইলের রাজধানী ঘোষণার প্রেক্ষাপটে উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ৯ ডিসেম্বর মিশরের কায়রোতে সন্ধ্যায় শুরু হওয়া ২২ সদস্য রাষ্ট্র আরব লীগের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকটি গভীর রাত পর্যন্ত চলে। বৈঠক শেষে ভোর তিনটায় এক বিবৃতিতে আরব লীগ জানায়, ‘ট্রাম্পের সিদ্ধান্তটির কোনো আইনি তাৎপর্য নেই। এটি উত্তেজনা আরও তীব্র করে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত অঞ্চলটিকে আরও সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত হওয়ার হুমকির মধ্যে ফেলেছে।’ ট্রাম্পের জেরুজালেম ঘোষণাকে বিপজ্জনক অ্যাখ্যা দিয়ে তা বাতিল করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহবান জানিয়েছে আরব লীগ। তা ছাড়া ফিলিস্তিন ও ইজরাইল শান্তি প্রক্রিয়ায় পৃষ্ঠপোষকতার ভূমিকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরব লীগ। বিষয়টি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনার জন্য তোলা হবে বলেও জানায় সংস্থাটি।

ট্রাম্পের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে ইন্তিফাদা (গণ-অভ্যুত্থান) ঘোষণার পর ১২ ডিসেম্বর ২০১৭ সালে ষষ্ঠ দিনের মতো উত্তপ্ত ছিল গাজা উপত্যকা। এ সময় সর্বাত্মক আন্দোলনে নামা ফিলিস্তিনিদের ওপর ইজরাইলি বাহিনীর আগ্রাসন অব্যাহত থাকে। ১১ ডিসেম্বর রাতে গাজার দক্ষিণাংশে হামাস স্থাপনায় বিমান ও ট্যাংক হামলা চালায় ইজরাইলি বাহিনী। তারা বলে, হামাস নাকি তাদের ভূখণ্ডে দুটি রকেট নিক্ষেপ করে। এর পরই তারা হামলা করে। অপরদিকে বিক্ষোভকারীদের সাথে ইজরাইলি বাহিনীর সংঘর্ষ হয়েছে পশ্চিম তীরের রামাল্লা ও বেথলেহেমে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার জামাতা কুশনারের একমাত্র লক্ষ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে ইজরাইল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় করা। তাই শাসনকালের শেষ সময়ে এসে ট্রাম্প অস্থির হয়ে ওঠেন। অবশেষে নানা জল্পনা-কল্পনার পর সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনকে রাজি করাতে সক্ষম হন। ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট আমিরাত ও ইজরাইলের মধ্যে শান্তি চুক্তির ঘোষণা আসে। এক মাসের মধ্যে বাহরাইনও একই পথে হাঁটে।

গোটা মুসলিম বিশ্বকে পাশ কাটিয়ে অবৈধ ইজরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে দেশ দুটি। ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০-এ হোয়াইট হাউজে সই হওয়া চুক্তির দিনটিকে নতুন মধ্যপ্রাচ্যের ভোর হিসেবে ঘোষণা করে ট্রাম্প। নেতানিয়াহু, আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান ও বাহরাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল লতিফ আল জায়ানি নিজ নিজ দেশের পক্ষে চুক্তিতে সই করেন।

সৌদি প্রভাব বলয়ের দেশ দুটির সাথে সমঝোতায় পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বুকে ইজরাইলের বিচ্ছিন্ন অবস্থার অবসান হয়েছে।সত্যিকারার্থে চুক্তিটি হয়েছিল চরম বিশ্বাসঘাতকতার মধ্য দিয়ে। তারা একদিকে ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে, অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে শান্তিচুক্তি করে। চুক্তিতে সই করা মুসলিম দেশগুলো হয়ত ভুলে গেছে যে, ফিলিস্তিনের প্রতিটি বালু কণায় মিশে আছে অগণিত মজলুম শহিদের তাজা রক্ত। এতো সব শান্তি চুক্তির পরও ফিলিস্তিনের একবিন্দু মাটি অধিগ্রহে রেখে ইজরাইল রাষ্ট্র নিরাপদে ঠিকে থাকতে পারবে কিনা তা বিজ্ঞদের মনে প্রশ্ন জেগেছে?

গত দুই বছরে ইজরাইলে ভোট হয়েছে চার বার। সর্বশেষ ভোট হয়েছে ২০২১ সালের মার্চ মাসে। দেশটির ক্ষমতার শীর্ষ আসনে দীর্ঘ সময়ে থাকা প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাছাড়া তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগে বিচার চলছে। এসব কিছুকে জনগণের চোখের আড়াল করতে তিনি ফিলিস্তিনে আক্রমণ করার সুযোগ খুঁজেন।

গত ১৩ এপ্রিল আল-আকসার নিকটবর্তী ওয়েস্টার্ন ওয়ালে ইজরাইলি প্রেসিডেন্টের বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল। ঐদিন ছিলো ইজরাইলের মেমোরিয়াল ডে এবং রমজান মাসের প্রথম দিন। প্রেসিডেন্টের বক্তব্য চলাকালে মসজিদের মাইকে আযান দিলে বিঘ্ন ঘটতে পারে ভেবে ইজরাইলি পুলিশ আল-আকসা মসজিদেরে মাইকের স্পিকারের তার কেটে দেয়। যা ছিলো মুসলিম দুনিয়ার জন্য মানহানিকর। এর পরেই জেগে ওঠে ফিলিস্তিনি জনগণ। এমন সব কর্ম কাণ্ডের অপেক্ষায় ছিলো নেতানিয়াহু। করোনাভাইরাসসহ নানা কারণে গত কয়েক বছরে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ে হামাস। তাই গাজায় তাদের জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। তারাও ফিরে দাঁড়ানোর জন্য বিশেষ করে শক্তি প্রদর্শনের অপেক্ষায় ছিলো।

এখন পর্যন্ত ইজরাইলের বিমান হামলায় ৪১জন শিশুসহ ১৪৮জন নিহত হয়েছে। মূলকথা প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। আহত হচ্ছে নারী ও শিশু। আর লাভবান হচ্ছে নেতানিয়াহু। তার্কিস প্রেসিডেন্ট তাইয়্যেপ এরদোগান সৌদি আরব, ইরান, পাকিস্তান, রাশিয়া ও চীনসহ বিশ্বকে সাথে নিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করতে কাজ করে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্য বিশ্ববাসীর- কেননা মার্কিন মদদে ইজরাইল এখনও তার আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য হামাসের রকেট আক্রমণে ইজরাইলের ভেতরে সাইরেন বারবার বেজে উঠার ধ্বনি তাদেরও ঘুম কেড়ে নিয়েছে।

(শেষ পর্ব)

আগের পর্ব-ইতিহাসে ফিলিস্তিনঃ পবিত্র ভূমির মালিকানা (পর্ব-২)

লেখকঃ গবেষক, কলামিস্ট ও মানবাধিকারকর্মী

আরও পড়ুন