Ads

ইসমাঈল (আঃ) এর গলায় ছুরি চালানোর প্রচলিত অসত্য ও বানোয়াট বয়ান

।। আশরাফ আল দীন ।।

“হজরত ইবরাহীম (আ)-এর বিষয়ে যে গল্প প্রচলিত আছে তা হলোঃ আল্লাহর নবী হজরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর পুত্রের গলায় ছুরি চালিয়েছিলেন, কিন্তু কাটে নি… ইত্যাদি। এ গল্পটি জাল, মিথ্যা এবং যিন্দীকদের বানানো।”

এ কথা বলেছেন ত্রয়োদশ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ সিরিয় মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনুস সাইয়িদ দরবেশ হূত (১২৭৬ হি), আজ থেকে অনেক বছর আগে। (আসনাল মাতালিব, পৃ. ২৮৩-২৮৪; খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, হাদীসের নামে জালিয়াতি)

কেবলমাত্র কিছু গল্পবাজ ও অগভীর জ্ঞানের অধিকারী আলেমের কারণে এখনো এই গল্প নানা ভাবে বিকশিত হয়ে আমাদের সমাজে বিরাজমান! ঈদ-উল-আযহার সময় ঘনিয়ে এলেই আমাদের দেশে মাসজিদে মাসজিদে বয়ান করা হয় (এবং বলা যায়, এই মিথ্যার চর্চা হয়) যে, হযরত ইবরাহীম (আঃ) স্বপ্নে নির্দেশিত হোনঃ

“তোমার সবচেয়ে প্রিয় বস্ত্তটি আল্লাহর নামে কুরবানী কর।” ফলে ইবরাহীম আঃ একের পর এক উট দুম্বা কুরবানী করেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। বরং “প্রিয় বস্তু কুরবানী করা”র আদেশ তিনি বারংবার স্বপ্নে পেতে থাকেন। অবশেষে ইবরাহীম (আঃ) বুঝতে পারলেন যে, বৃদ্ধ বয়সে তিনি যে সন্তান লাভ করেছেন সেই তাঁর কাছে সবচেয়ে প্রিয় এবং এই পুত্রকেই কুরবানী করতে হবে। তাই তিনি তাঁর স্ত্রীকে ও পুত্রকে দাওয়াত খাওয়ার মিথ্যা কথা বলে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যান। সর্বশেষ তিনি পুত্রকে সত্য কথাটি জানান। ইবরাহীম আঃ আপন পুত্র ইসমাঈলের পরামর্শে তাঁকে দড়ি দিয়ে ভাল করে বাঁধেন, যাতে করে ছটফট করতে না পারে। এরপর শুইয়ে তাঁর গলায় বারংবার ছুরি চালান। কিন্তু ছুরি ইসমাইলের গলা কাটতে ব্যর্থ হয়। ছুরির ধার পরীক্ষা করার জন্য তিনি পাথরে আঘাত করলে পাথর দুই টুকরা হয়ে যায়! তারপর তিনি নিজের সন্তানের পরামর্শে নিজের চোখ বেঁধে পুত্রকে জবাই করার চেষ্টা করেন। প্রচলিত এ গল্পটি নানা নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ, কুরআন বিরোধী, জাল, মিথ্যা এবং ধর্ম বিরোধীদের বানানো।

কুরআন কারীমে সূরা ‘সাফ্ফাত’-এ ইবরাহীম (আ) কর্তৃক পুত্রকে কুরবানী করতে উদ্যত হওয়ার বিষয় উল্লেখ করে আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ
رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ. فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلَامٍ حَلِيمٍ. فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَىٰ فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرَىٰ ۚ قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ ۖ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ. فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ. وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ. قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا ۚ إِنَّا كَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ.

‘‘(ইবরাহীম বলল) হে আমার রব, আমাকে এক সৎকর্ম-পরায়ণ সন্তান দান কর। অতঃপর আমি তাকে এক স্থির-বুদ্ধি পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। অতঃপর সে যখন তার পিতার সঙ্গে কাজ করবার মত বয়সে উপনীত হল তখন ইবরাহীম বলল, বৎস, আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি যবাই করছি, এখন তোমার অভিমত কি বল? সে বলল, হে আমার পিতা, আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। আল্লাহ ইচ্ছা করলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইবরাহীম তার পুত্রকে কাত করে শায়িত করল, তখন আমি তাকে আহবান করে বললাম, হে ইবরাহীম, তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করলে। এভাবেই আমি সৎকর্ম পরায়ণদিগকে পুরস্কৃত করে থাকি।’’ (সূরা সাফ্ফাত ৩৭/১০০-১০৫)

এখানে ঘটনাটি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও নানা মিথ্যা দিয়ে সাজানো ও কুরআন-হাদীসের বর্ণনার বিপরীত কথা গল্প আকারে বর্ণিত হয়েছে দুর্বল কিছু হাদিসে ও কোন কোন তাফসীরে। এ সকল বর্ণনা ও মিথ্যা গল্প আমাদেরকে দৃঢ়তার সাথে পরিত্যাগ করতে হবে।

আরও পড়ুন-সত্য কখনও কখনও কল্পনার চেয়েও ভয়ঙ্কর এবং আকর্ষণীয়

এখানে কয়েকটি বিষয়ের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলোঃ

(ক) কুরআন কারীমে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইবরাহীম আঃ তাঁর পুত্রকে জবাই করতে স্বপ্নে দেখেছিলেন। আমাদের দেশে প্রচলিত আছে যে, ইবরাহীম স্বপ্নে দেখেন যে, ‘তোমার সবচেয়ে প্রিয় বস্ত্তকে কুরবানী কর।’ এ কথাটি ভিত্তিহীন; কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীসে এরূপ কথা বর্ণিত হয় নি।

আরও পড়ুন- নতুন চাঁদ, অবজারভেশন না-কি ক্যালকুলেশন?

(খ) কুরআনে সুস্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইবরাহীম আঃ তাঁর পুত্রকে জানান যে, তিনি তাঁকে জবাই করার স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু প্রচলিত আছে যে, ইবরাহীম আঃ তাঁর স্ত্রীকে ও পুত্রকে দাওয়াত খাওয়া… ইত্যাদি মিথ্যা কথা বলে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যান। … সর্বশেষ তিনি পুত্রকে সত্য কথাটি জানান। এ সকল কথা কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণিত হয় নি। এ ছাড়া এই কথাগুলো নবীগণের মর্যাদার খেলাফ। আল্লাহর খলীল তাঁর স্ত্রী ও পুত্রকে কেন মিথ্যা কথা বলবেন?

(গ) প্রচলিত আছে যে, ইবরাহীম আঃ পুত্র ইসমাঈলকে দড়ি দিয়ে ভাল করে বাঁধেন। এরপর শুইয়ে তাঁর গলায় বারংবার ছুরি চালান….।

এগুলো সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা। কুরআনে তো সুস্পষ্টই বলা হচ্ছে যে, জবাই করার প্রস্ত্ততি নেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আল্লাহর পক্ষ থেকে আহবান এসে যায়। অর্থাৎ কোনো ছুরি চালানোর ঘটনাই ঘটে নি।

হাদীস শরীফেও বর্ণিত হয়েছে যে, জবাইয়ের প্রস্ত্ততি নেওয়ার সময়েই আল্লাহর পক্ষ থেকে বিকল্প জানোয়ার প্রদান করা হয়। (ইবনু কাসীর, তাফসীর ৪/১৬)

মানুষের মনে রেখাপাত করার আশায় অথবা অন্য কোন উদ্দেশ্যে সঠিক ঘটনার সাথে মিথ্যা গল্প জুড়ে দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। যতটুকু কুরআনে এবং সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে সেটুকুই ইসলাম। এর বাড়তিটুকু ইসলাম-বহির্ভূত নিঃসন্দেহে। তাই তা আমাদের পরিত্যাগ করতে হবে। মানুষের মনকে আকৃষ্ট করার লোভে যেসব আলেম এই গল্পগুলো বাড়িয়ে ও বানিয়ে বানিয়ে বলেন তাঁদের অনুরোধ করবো, মিথ্যা চর্চা থেকে বিরত হোন। এতেই ইসলামের কল্যাণ রয়েছে।

(সংগৃহীত ও সম্পাদিত)

লেখকঃ  কলাম লেখক ও উপদেষ্টা, পলিসি রিসার্স সেন্টার, বাংলাদেশ

ফেসবুকে লেখকের প্রোফাইলের লিংক-Ashraf Al Deen

আরও পড়ুন