Ads

ইসলামি স্বর্ণযুগে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মুসলিম নারীদের অবদান

জি.মোস্তফা

ইসলামি সভ্যতার ইতিহাসে শিক্ষা, বিজ্ঞান চর্চা ও প্রযুক্তির উদ্ভাবনে পুরুষদের অবদান সম্পর্কে বিপুল পরিমাণে বিবরণ বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান চর্চায় মুসলিম নারীদের অবদান সেই তুলনায় কম আলোচিত হয়েছে। পুরুষের পাশাপাশি মুসলিম নারীরা চিকিৎসাবিজ্ঞান,গণিত,মহাকাশ বিজ্ঞান,জ্যোতির্বিদ্যা, কাব্য, সাহিত্য,শিল্পকলা,স্থাপত্য, আইন প্রভৃতি বিষয়ের মতো বিজ্ঞান চর্চায়ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
রসূল (স.) নারীদের শিক্ষার জন্য বহুমুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি শুধু স্বাধীন নারীদের জন্যই এ ব্যবস্থা করেননি,এমনকী দাসীদের জন্যও জ্ঞান অর্জন ও শিক্ষা লাভের দরজা উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন।

রসূল (স.) বলেন,”যে ব্যক্তির অধীনে কোনো দাসী থাকে,সে যদি তাকে উত্তমরূপে লেখাপড়া ও শিষ্টাচার শিখিয়ে স্বাধীন করে দেয়,এবং বিবাহ করে সে ব্যক্তি দুটি প্রতিদান পাবে।”(বুখারি,বিবাহ অধ্যায়:বংশ বিস্তারের লক্ষ্যে ক্রিতাদাসীকে মুক্ত করে তাকে বিবাহ করা অনুচ্ছেদ,খন্ড-১১,পৃষ্ঠা-২৮ )

শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীদের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। তারা এক্ষেত্রে অনেক সময় পুরুষদের চেয়েও এগিয়ে থাকে।কাতারের সাবেক চিফ জাস্টিস শেখ যায়েদ বলেন,

“নারীরা দ্বীনি চরিত্র ও উত্তম শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে অগ্রগামী।যদি তারা এমন শিক্ষক-শিক্ষিকা পায় যারা সৎপথের নির্দেশনা দিতে পারেন,তাহলে তারা শ্রবণ ও অনুসরণে সর্বদা প্রস্তুত থাকে।”(রাসূলের (স.) যুগে নারী স্বাধীনতা,আব্দুল হালীম আবু শুককাহ, Wams,ঢাকা ১ খন্ড, পৃ.৪৩)

ইসলামে জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষকে বিভাজন করা হয়নি।বরং নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য জ্ঞান অর্জনকে ফরয ঘোষণা করা হয়েছে।

উস্তাদ প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ বলেন,

“মুসলমানদের জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে কখনোই পুরুষ এবং মহিলাদের মধ্যে কোন বিভাজন করা যাবে না। রসূল (স.) বলেছেন, “জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুমিন নর নারীর জন্য ফরয”। এখানে মহিলা এবং পুরুষের মাঝে কোন পার্থক্য করা হয়নি। একটি সভ্যতা বা একটি উম্মাহ কখনোই এক ডানায় উড়তে পারে না। রসূলে আকরাম (স.) মদিনাকে একটি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করেছিলেন। মহিলা এবং পুরুষ উভয়ই এইখানে একসাথে জ্ঞানার্জন করেছেন। হযরত আয়েশা (রা.) উম্মতের সবচেয়ে বড় আলিমাদের একজন। এমনকি সকল ফকিহ সাহাবিগণ জ্ঞানার্জনের জন্য আয়েশা (রা.)-এর কাছে আসতেন।”

রসূল (স.) এর নিকট সকল সময় নারী পুরুষ কোনো রকম পার্থক্য ছাড়াই সমভাবে জ্ঞান অর্জন করতেন এছাড়াও বিশেষভাবে সপ্তাহের একটি দিন তাদের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন।এ সম্পর্কে উস্তাদ মেহমেদ গরমেজ তার বক্তব্যে বলেন-

“সপ্তাহের একদিন তিনি মসজিদে নববিকে শুধুমাত্র নারীদের জন্য আলাদা করে রাখেন এবং সেই দিন তিনি তাদেরকে ইসলাম শিক্ষা দেন। তিনি তাদেরকে লেখাপড়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। হযরত আয়েশা রদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা সাহাবিদের মধ্যে সবচাইতে বড় আলিমা ছিলেন। তিনি ২২২০ হাদিস বর্ণনা করেছেন। পুনরাবৃত্তিসহ বিবেচনা করা হলে আয়েশা রদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা পাঁচ হাজারের অধিক হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি কুরআনের কিছু কিছু আয়াত নাযিল হওয়ার সময় সাক্ষী হিসেবে ছিলেন। তিনি কিছু কিছু আয়াতের শানে নুযুল এবং তাফসির করেন এবং এ বিষয়ে পরবর্তীতে মুসলমানরা অনেক অগ্রগামী হন।”

হযরত আয়েশা (রা.) তাফসির,হাদিস,ফিকহ প্রভৃতিশাস্ত্রে অধিক জ্ঞানের অধিকারিণী ছিলেন তা সত্ত্বেও তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওপরও পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন।
সাহাবিদের একটি দল আয়েশা (র.) এর কাছে জিজ্ঞেস করেন,আল-কুরআনের ব্যাপারে আপনার এতো গভীর জ্ঞান দেখে আশ্চর্য হই না,কারণ আপনি রসূলে আকরাম (স.) এর স্ত্রী।নসব বা বংশবিদ্যায় আপনার পারদর্শিতা দেখে আশ্চর্য হই না, কারণ আপনি আবু বকর (রা.) এর কন্যা। কিন্তু চিকিৎসাবিদ্যা কীভাবে অর্জন করলেন? প্রশ্নের জবাবে বলেন,রসূল (স.) যখন ৬ মাস অসুস্থ ছিলেন তখন আরবের প্রখ্যাত চিকিৎসক হারিস ইবনু কালাদাকে মদিনায় নিয়ে আসি।তিনি আমাকে ওষুধের কথা বলতেন আর আমি সেগুলোকে সংগ্রহ করে রসূল (স.) কে দিতাম। এভাবে আমি চিকিৎসাবিদ্যা হারিস ইবনু কালাদার কাছ থেকে শিখেছি।”( ইসলামী জ্ঞানে উসূলের ধারা,প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ,বুরহান উদ্দিন অনূদিত, পৃ.১৩৯)

হযরত আয়েশা,হাফসা,উম্মু সালমা,উম্মু ওয়ারাকা (রা.) পুরো কুরআন মাজিদের হাফিযা ছিলেন।হিন্দা বিনতে উসায়েদ, হারিসা,উম্মু সাদ (রা.) কুরআনের অধিকাংশ অংশ হিফয করেছিলেন। উম্মু সালমা পবিত্র কুরআনের দারস দিতেন।হযরত আয়েশা (রা.) তাফসিরশাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। সহিহ মুসলিমের শেষাংশে তাঁর তাফসিরের কিছু উল্লেখ করা হয়েছে।(উসুদুল গাবা,৫ম খন্ড,পৃ. ৮২)।

কেউ কেউ বলেন, ইসলামি শরিয়াহর বিধানসমূহের এক চতুর্থাংশ হযরত আয়েশা (রা.) এর কাছে পাওয়া গিয়েছে।
(তাবাকাতে ইবনে সাদ,দ্বিতীয় খন্ড,পৃ-৭২১)

হযরত আয়েশা যুক্তিবিদ্যায়ও বিপুল জ্ঞান লাভ করেছিলেন।হাদিসশাস্ত্রে তিনি ছাড়াও আরো অনেক নারী সাহাবি পান্ডিত্যের অধিকারিণী ছিলেন। আতিয়া,আসমা বিনতে আবু বকর,উম্মু হানি ও ফাতিমা বিনতে কায়েস (রা.)বহু সংখ্যক হাদিস বর্ণনা করেছেন।

ফিকহ বিষয়ে হযরত আয়েশা (রা.) এর এতো অধিক ফতোয়া রয়েছে যে,তাতে কয়েকখানা গ্রন্থ হতে পারে,উম্মু সালমা (রা.) এর ফতোয়া সমূহ একত্র করলে একটা রিসালা হতে পারে।হযরত সাফিয়া,হাফসা,হাবিবা,মায়মুনা,ফাতিমা,কায়েস খাওলা,উম্মু দারদা,উম্মু আয়মান (রা.) সহ আরো অনেকে ফতোয়া দিতেন।(যারকানী,আল এলাম, তৃতীয় খন্ড,পৃ-৭২১)

ফারায়েয শাস্ত্রে (উত্তরাধিকার বিজ্ঞান) হযরত আয়েশা,উম্মু সালমা,উম্মু সুলাইম গভীর জ্ঞানের অধিকারিণী ছিলেন।(উসুদুল গাবা,পঞ্চম খন্ড,পৃ-৪৫১)

খানসা,সফিয়া,আতিকা,যয়নব,উম্মু আয়মান,মায়মুনা,রুকাইয়া, (রা.) কবিতা চর্চায় প্রসিদ্ধ ছিলেন। খানসা (রা.) ইসলাম গ্রহণের জন্য মদিনা এলে রসূল (স.) দীর্ঘক্ষণব্যাপী তার কবিতা শোনেন।ভাষাবিদ্যা ও সমালোচনা সাহিত্যে তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিলো না।১৮৮৮ সালে বৈরুত থেকে তাঁর কবিতার একটি বৃহৎ সংকলন প্রকাশিত হয়।(সিয়ারুস সাহাবিয়াত,মাওলানা সাঈদ আনসারী,ইফাবা,১৯৮৬,পৃ-১৩)

আসমা বিনতে সাকান (রা.) বক্তৃতা ও ভাষণে পারদর্শী ছিলেন।

চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচারে রাফিদা আসলামিয়া,উম্মু মুতা,উম্মু কারাশ,হামনা বিনতে জাহাশ,মায়ায,লায়লা,উম্মু যিয়াদ,রুবি, উম্মু আতিয়া,উম্মু সুলাইম (রা.) গণ অধিক দক্ষ ছিলেন।রাফিদা (রা.) এর ক্যাম্প মসজিদে নববির সংলগ্ন এলাকায় ছিলো এবং সেখানে অস্ত্রোচারের কেন্দ্র ছিলো।

রসূল (স.) এর সমকালীন অনেক নারীরাই চিকিৎসাসেবার সাথে জড়িত ছিলেন। যুদ্ধে আহতদের সেবা প্রদানের লক্ষ্যে তারা রসূল (স.) এর সাথে যুদ্ধেও গমন করেছিলেন। নুসাইবা বিনতে কাব আল-আনসারি (র.) ছিলেন মদিনার একজন প্রখ্যাত নারী চিকিৎসক। উম্মু আম্মারা নামে অধিক খ্যাত এই নারী সাহাবি। রসূল (স.) এর মদিনায় হিজরতের পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। উহুদের যুদ্ধের সময় রসূল (স.) কে প্রতিরক্ষার জন্য তার লড়াইয়ের কারণে তিনি ইতিহাসে অধিক পরিচিত।

রুফাইদা বিনতে সা’দ আল-আসলামিয়া (র.) ছিলেন রসূল (স.) এর সমকালীন মদীনার অপর একজন নারী চিকিৎসক। তাকে ‘ইসলামের প্রথম নার্স’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি মূলত তার চিকিৎসক পিতা সা’দ আল-আসলামীর নিকট থেকে চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি চিকিৎসাবিদ্যায় এতই বুৎপত্তি অর্জন করেন যে, রসূল (স.) যুদ্ধে আহত সকল সৈনিককে তার নিকট চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করতেন।

এছাড়া রসূল (স.) এর সমকালীন আরো কয়েকজন নারী চিকিৎসকদের মধ্যে উম্মু সিনান আল-ইসলামি (উম্মু ইমরা হিসেবে পরিচিত), উম্মু মাতায়ি আল-আসলামিয়া এবং উম্মু ওরাকা বিনতে হারিস উল্লেখযোগ্য। মধ্যযুগেও মুসলিম নারীরা বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতার সাথে তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। ইবনু আল-জাওযি, ইবনু আল-খতিব বাগদাদি এবং ইবনু কাসিরসহ প্রমুখ ঐতিহাসিক দশম শতাব্দির একজন নারী গণিতবিদের প্রশংসা করেছেন। সুতাইতা আল-মাহামালি নামের এই নারী গণিতবিদ বাগদাদের এক বিদ্যোৎসাহী পরিবারের সন্তান ছিলেন। তার পিতা ছিলেন বাগদাদের একজন বিচারপতি ও বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিত্ব। গণিতের বিভিন্ন শাখায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এছাড়া একইসাথে তিনি আরবি সাহিত্য, হাদিস এবং আইনশাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। ৩৭৭ হিজরি মোতাবেক ৯৮৭ ঈসায়ীতে তিনি ইন্তিকাল করেন।

মধ্যযুগে আন্দালুসিয়ার উমাইয়া দরবারের একজন শিক্ষাবিদ ছিলেন লুবনা আল-কুরতুবিয়া। তিনি একাধারে গণিত, কাব্য, ব্যকরণ ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার ওপর বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তার জ্ঞানগত দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার কারণে তিনি খলিফা তৃতীয় আবদুর রহমান এবং তার পুত্র দ্বিতীয় আল-হাকামের দরবারের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে মধ্য যুগ পর্যন্ত ইসলামি বিশ্বে অগনিত মহিলা হাদিস বিশারদ হাদিস শাস্ত্রের বিভিন্ন শাখার ওপর জ্ঞান চর্চা করেছেন। । জনসাধারণকে হাদিসের শিক্ষাদানের মতো বিশাল কাজ আনজাম দিয়ে গেছেন।তারা নিজেরাই ছিলেন এক একজন বড়ো মাপের ইসলামিক স্কলার।

হাদিস বর্ণনাকারী ইমামদের অনেকেই নির্বিঘ্নে মহিলা সাহাবি ও তাবিয়িদের কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন।কারিমা বিনতে মারুযিয়া নামক নারীর কাছ থেকে ইমাম বুখারি হাদিস বর্ণনা করেছেন।ইমাম বুখারি (রহ.) এর উস্তাদদের মধ্যে মহিলা উস্তাদ ছিলেন ৯ জন।

ইবনু তাইমিয়া কৃত আরবাউনা হাদিসান নামক পুস্তকে উল্লেখিত একটি আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে তাঁর শিক্ষকদের দীর্ঘ তালিকার মধ্যে ৪ ছিলেন মহিলা শিক্ষক। তারা হলেন-

১) উম্মু আলখাইর সিতআল আরাব।

২) উম্মু আল আরাব ফাতিমা।

৩) উম্মু আহমাদ জয়নাব।

৪) উম্মু আহমাদ আল মাকদাসিয়া।

ইসলামের ইতিহাসে শিক্ষা বিস্তারে অনেক মুহাদ্দিসাতদের ভূমিকা রয়েছে। চেপে রাখা সেই সব ইতিহাসকে উপস্থাপন করে ৫০ খন্ডের একটি সুবিশাল গ্রন্থ-সিরিজ রচনা করেছেন শাইখ আকরাম নদভী।

তাঁর বিবরণে আট হাজার নারী মুহাদ্দিস এবং ফকিহ সম্পর্কে তথ্য থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। এই প্রসংজ্ঞে উঠে এসেছে সেই সব নারী শিক্ষিকার ভূমিকা। তাদের ছাত্র, এই সব মুহাদ্দিসাত সম্পর্কে সালাফ ইমামদের ধারণা কী ছিলো, এই বিষয় বস্তুগুলো এই বইতে এসেছে।ইসলামের ইতিহাস যারা পাঠ করেন, যারা ইতিহাস চর্চা করেন তাদের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ বই।

স্পেনের মুসলিম নারীদের ভূমিকা

স্পেনের মুসলিম মহিলাগণ ছিলেন উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির অধিকারী।উৎকৃষ্ট রচনার জন্য তাদের অনেকেই সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন।লাবানা,ফাতিমা,আয়িশা,রাজিয়া ও খাদিজা ছিলেন স্পেনের মুসলিম স্কলারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। শিক্ষা ও জ্ঞানের মাহাত্মে লাবানা ও ফাতিমা দ্বিতীয় হাকামের দরবারে ও লাইব্রেরিতে উচ্চপদ অলংকৃত করেছিলেন।বৃদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও ফাতিমা সুন্দর হস্তাক্ষরে খলিফার জন্য অনুলিপি তৈরি করতেন।যৌবণকালে তিনি দুষ্প্রাপ্য পান্ডুলিপির সন্ধানে কায়রো,দামেস্ক ও বাগদাদের বিভিন্ন লাইব্রেরিতে যেতেন। আয়িশা তার সময়ে একজন বিশিষ্ট কবি ছিলেন,তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে দুর্লভ ও মূল্যবান বইয়ের প্রচুর সংগ্রহ ছিলো।খাদিজার একটি ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ছিলো।হাকামের জনৈক ক্রিতদাসী ব্যাকরণ,গণিত ও অন্যান্য বিজ্ঞানে সুশিক্ষিতা ছিলেন।তিনি সুন্দর পত্র লিখতে পারতেন।হাকাম অনেক সময় তাকে দিয়ে পত্র লেখাতেন। ঐতিহাসিক ইবনু আল ফেয়াজ বলেন, একমাত্র কর্ডোভার পূর্ব শহরতলীতেই কুফি হরফে কুরআন মাজিদ নকলের কাজে একশত মহিলা নিয়োজিত ছিলো।আহমদের কন্যা আয়িশা সুন্দর হস্তাক্ষরে কুরআন নকল করতেন।

মুসলিম নারীরা মহাকাশ গবেষণা ক্ষেত্রেও অবদান রেখেছেন। মারিয়াম আল আস্ত্রলাবি সর্বপ্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন Astrolab তৈরি করেন। Astrolab হচ্ছে এমন একটি ডিভাইস যা Satellite Nevigation, মহাকাশের সময় গণনা থেকে অনেক জটিল বিষয়ে প্রতিদিন Astronautics এর অনেক শাখায় ব্যবহৃত হয়।GPS এর মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গার অবস্থান জানতে পারছি এসবের পেছনে Astrolab এর ভূমিকা রয়েছে। তার কাজের কাছে আধুনিক যুগের স্যাটেলাইটও ঋণী।

বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা

বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা মুসলিম নারী ফাতিমা আল ফিহরি।ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ আল-ফিহরিয়া আল- কুরাইশিয়া। মানবজাতির ইতিহাসে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা। আরব্য মহীয়সী এই মুসলিম নারীর প্রতিষ্ঠিত আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়টি মরক্কোর উত্তরাঞ্চলের ফেজ শহরে অবস্থিত।

ইউনেস্কো এবং গিনেস বুক ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের তথ্যানুসারে, বিশ্বের সবচেয়ে পুরাতন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন পর্যন্ত উচ্চশিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন স্কলারও আল-কারাওইনকে সবচেয়ে পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে উল্লেখ করেন।

৮৫৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন ফাতিমা আল-ফিহরিয়া। শুরুতে এটি মসজিদ ছিল। পরবর্তীতে মুসলিম ইতিহাসেই এই প্রতিষ্ঠানটি আধ্যাত্মিক এবং শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে নেতৃত্ব দেয়। ১৯৬৩ সালে মরক্কোর সরকার আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়কে তার আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় পদ্ধতির অংশ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করে।

ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ আল- ফিহরিয়া একজন আরব্য মহীয়সী মুসলিম নারী। বংশ পরম্পরায় তিনি তিউনিশিয়ার ও কাইরাওয়ান শহরের প্রতিষ্ঠাতা উকবা ইবনে নাফে আল-ফিহরি আল-কুরাইশিয়া। তাদের পারিবারিক নামের কুরাইশিয়া অংশ থেকে ধারণা করা হয় তারা ছিলেন কুরাইশ বংশের উত্তরাধিকারী। তিনি তিউনিশিয়ার ও কাইরাওয়ান শহরের অতীত স্মৃতি। মরক্কোর ফেজ শহর এবং তিউনিশিয়া ও মরক্কোর ইতিহাসে অমর হয়ে থাকা এক ব্যক্তিত্ব।

ধারণা করা হয়, ফাতিমা আল-ফিহরি ৮০০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তৎকালীন আফ্রিকার রাজধানী কাইরাওয়ান থেকে বৃহত্তর মরক্কো ইদ্রিসিয়ার রাজধানী ফেজ শহরে হিজরত করেন। সেখানেই একটি মসজিদ নির্মাণ করেন ফাতিমা। যা পরবর্তীতে ধাপে ধাপে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ লাভ করে।

সেখানে জ্ঞানের নানা শাখা-প্রশাখার উপর পাঠদান করা হতো। শিক্ষা সমাপ্ত করে অনেক বড় বড় বিদ্বান বের হতেন, যার আলোর বিকিরণ পৌঁছে যায় মধ্যযুগের সুদূর ইউরোপ পর্যন্ত। যখন ইদ্রিসিয় শাসন আমলে দ্বিতীয় ইদ্রিস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক ফেজ শহরের কথা স্মরণ করা হয়। তখন প্রাসঙ্গিকভাবে কাইরাওয়ানের মহাবিদদের সঙ্গে কারাওইন জামে মসজিদ ও কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা এসে যায়।

তারা ফেজ শহরের সুলগ্নে বিশাল কারাওইন উপত্যকাজুড়ে বসবাস করতেন। সে সকল মহাবিদদের মধ্যে ছিলেন ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ আল- ফিহরিয়া। যিনি আমির ইয়া ইয়া বিন মুহাম্মদ বিন ইদ্রিসের শাসনকালে নিজ পিতা কায়রোয়ান ফিকাহ মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ আল-ফিহরি এবং বোন মারিয়ামের সঙ্গে তিউনিশিয়া থেকে ইদ্রিসিয়া সাম্রাজ্যের রাজধানীতে আসেন।

ফাতিমা আল-ফিহরি অন্য আরবদের সঙ্গে তার মূল নিবাস তায়বং থেকে বৃহত্তর মরক্কোতে পালিয়ে আসেন। তারপর দ্বিতীয় ইদ্রিসের শাসনামলে কারাওইন উপত্যকায় বসবাস শুরু করেন। এখানেই তিনি বিয়ে করেন। তবে বিয়ের কয়েক বছরের মাথায়ই ফাতিমাদের পরিবারে দুর্যোগ নেমে আসে। অল্প সময়ের মধ্যেই তার বাবা, ভাই এবং স্বামী মৃত্যুবরণ করেন। বেঁচে থাকেন কেবল এতিম দুই বোন ফাতিমা এবং মারিয়াম।

বাবার রেখে যাওয়া বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির উত্তরাধিকার হন তারা। মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী, পিতার কাছ থেকে পাওয়া সম্পত্তি ব্যয় করার ক্ষেত্রে কন্যারা কারো কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য না। ফাতিমা এবং মারিয়ামও চাইলে এই সম্পত্তি যেকোনোভাবে ব্যয় করতে পারতেন। তবে কোনো বিলাসিতার পেছনে ব্যয় না করে তারা সিদ্ধান্ত নেন, এই অর্থ তারা ব্যয় করবেন ধর্মের জন্য, মানবতার কল্যাণের জন্য। সাজসজ্জার কিংবা বিলাসিতার পণ্য ক্রয় না করে সিদ্ধান্ত নেন, তারা ক্রয় করবেন জনগণের ভবিষ্যত।

ফাতিমার জীবন সম্পর্কে খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকের ঐতিহাসিক ইবনে আবি-জারা যা উল্লেখ করেছেন, এর চেয়ে বেশি বিস্তারিত ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে তেমন কিছু জানা যায় না। ১৩২৩ খ্রিস্টাব্দে কাইরাওয়ানের এক বিরাট অগ্নিকাণ্ড হয়। আর সেই অগ্নিকাণ্ডে সংরক্ষিত নির্ভরযোগ্য সব নথিপত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরেও এখনও এতে প্রায় ৪,০০০ প্রাচীন এবং দুর্লভ পাণ্ডুলিপি আছে। এর মধ্যে আছে নবম শতকে লেখা একটি কুরআন মাজিদ, হাদিসের সংকলন, ইমাম মালিকের গ্রন্থ মুয়াত্তা, ইবনে ইসহাকের লেখা রসুল (স.)-এর জীবনী, ইবনু খালদুনের লেখা কিতাব আল-ইবার এবং আল-মুকাদ্দিমার মূল পাণ্ডুলিপিসহ বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ।

তার পিতা মহাবিদদের মধ্যে একজন ছিলেন। তিনি ছিলেন কাইরাওয়ানের আরুপতিউই সিয়ান। তিনি ছিলেন অনেক ধন সম্পদের অধিকারী। তার দুই মেয়ে ফাতিমা ও মারিয়াম ছাড়া আর কোনো সন্তান ছিল না। তিনি তার দুই মেয়েকে উত্তম রূপে শিক্ষা দিয়ে বড় করেন। যখন তিনি মৃত্যুবরণ করলেন, তখন তার দুই মেয়ে তার সব সম্পত্তির অধিকারী হলেন।

ফাতিমা দীর্ঘকাল ভাবছিলেন, এতো সম্পদ তিনি কোথায় ব্যয় করবেন? এক সময় সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করবেন যা তার মৃত্যুর পর স্মৃতি হয়ে থাকবে। তার ও পৃথিবীবাসীর মাঝে একটি সম্পর্কের সূত্র হয়ে এই আমল পরকালে পাকের হবে। যা থেকে তিনি অনন্তকাল প্রতিদান পেতে থাকবে।

২৪৫ হিজরির রমজান মাসে পিতার উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তি থেকে মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করলেন। প্রতিবেশি এক লোক থেকে আশপাশের এক মাঠ কিনে এর আয়তন দ্বিগুণ করলেন। নিজের জমিও মসজিদের সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন। আন্তরিক আগ্রহের সঙ্গে বিপুল অর্থ তিনি এতে খরচ করলেন। ফলে সুদৃঢ় আলংকারিক কাল কারুকার্য গঠিত একটি মনোমুগ্ধকর মসজিদ হয়ে উঠলো।

ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেন, ফাতিমা আল-ফিহরি মসজিদটি নির্মাণের সংকল্প করার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে রোজা রাখতে শুরু করেন। তিনি মানত করেন, একদিনও রোজা ভাঙবেন না, যতদিন না মসজিদের নির্মাণ কাজ পরিপূর্ণ শেষ হয়ে যায়। এরপর মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে গেলে তিনি মসজিদে গিয়ে সর্বপ্রথম দুই রাকাত শোকরানা নামাজ আদায় করেন।

অনেক ঐতিহাসিক উল্লেখ করেন, এই মসজিদই পরবর্তীতে ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপলাভ করে। যেখানে জ্ঞানের নানা শাখা-প্রশাখার উপর উচ্চতর পাঠদান করা হতো। ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন বলেন, কারাওইনের জামে মসজিদ মরক্কোতে ইসলাম ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে সুদীর্ঘকাল। এরপর এই নেতৃত্বে জ্ঞানের বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ে সুদূর ইউরোপেও।

একসময় কারাওইনের জামে মসজিদ বৃহত্তর মরক্কোর প্রথম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং বৃহৎ আদি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়ে যায়। এভাবেই ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ আল-ফিহরিয়া পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। অবশেষে ২৬৫ হিজরির মোতাবেক, ৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ আল-ফিহরি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর ৯১৮ সালে সরকার মসজিদটিকে অধিগ্রহণ করে এবং একে সরকারি মসজিদ হিসেবে ঘোষণা করে। যেখানে সুলতান নিয়মিত নামাজ আদায় করতে শুরু করেন। দ্বাদশ শতকের দিকে পুনরায় পরিবর্ধনের পর এটি একসঙ্গে ২২,০০০ মুসল্লিকে ধারণ করার সক্ষমতা অর্জন করে।

ফাতিমার প্রতিষ্ঠিত কারাওইন মসজিদ এবং কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কেন্দ্র করে ফেজ হয়ে উঠতে থাকে আফ্রিকার ইসলামী শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র। শুধু মুসলমান নয়, মধ্যযুগের অনেক খ্যাতিমান ইহুদি এবং খ্রিস্টান মনীষীও এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরিয়েছেন। এর ছাত্রদের মধ্যে একজন ছিলেন পোপ দ্বিতীয় সিলভাস্টার। যিনি এখান থেকে আরবি সংখ্যাপদ্ধতি বিষয়ে ধারণা লাভ করে সেই জ্ঞান ইউরোপে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং ইউরোপীয়দেরকে প্রথম শূন্যের ধারণার সঙ্গে পরিচিত করেছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিখ্যাত মালিকি বিচারপতি ইবনে আল-আরাবি, ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুন এবং জ্যোতির্বিদ নূরুদ্দীন আল-বিতরুজি। প্রতিষ্ঠার পরপর ফাতিমা নিজেও কিছুদিন এখানে অধ্যয়ন করেছিলেন।

কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিটিকেও বিশ্বের প্রাচীনতম লাইব্রেরি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই লাইব্রেরিতে বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ রয়েছে। একবার জানিয়েছি, আগুনে পুড়ে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডুলিপি নষ্ট হয়ে যায়। তারপরও এখনো প্রায় ৪,০০০ প্রাচীন এবং দুর্লভ পাণ্ডুলিপি আছে।

ফাতিমা আল-ফিহরি ইন্তেকাল করেন ৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু তার প্রতিষ্ঠিত কারাওইন মসজিদ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং লাইব্রেরি আজও দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে।

লেখকঃ কলাম লেখক 

আরও পড়ুন