Ads

চীনকে পরাস্তকারী পূর্ব তুর্কিস্তান তথা উইঘুরের অচেনা বীর উসমান বাতুর

হাবিবুল্লাহ বাহার

ইতিহাস তার সূর্যসন্তানদের কখনোই ভুলে না। তারা তাদের মহৎ কর্ম ও প্রয়াসের বদৌলতে ভাস্বর হয়ে থাকেন যুগ যুগান্তরে। শক্তি, সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকেন পৃথিবীর সব বিপ্লবীর হৃদয়ের মণিকোঠায়। উসমান ইসলাম উগলু এমনই এক মহান বিপ্লবী ও উইঘুর তরুণ। বাতুর বা সাহসী তাঁর উপাধি। তিনি তার দুর্জয় সাহস, অক্ষয় চেতনা ও আপোষহীন লড়াইয়ের জন্য মহিমান্বিত হয়ে আছেন।

পূর্ব তুর্কিস্তান। প্রাচীন নাম হুইজিয়াং বা মুসলিম অঞ্চল, অধুনা নাম শিনচিয়াং। চার হাজার বছর আগে মধ্য এশিয়ার এ অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করে তুর্কিরা। প্রাচীন কালে স্থাপিত পৃথিবীর ঐতিহাসিক বাণিজ্যপথ সিল্ক রোড এঁকে বেঁকে চলে গিয়েছিল এ অঞ্চলটির মধ্য দিয়ে।

ইসলামের আবির্ভাবের পর আরবের মুসলিম বণিকদের চরিত্র মাধুর্যে বিমোহিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন কিছু সংখ্যক তুর্কি। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে মুসলমানদের সংখ্যা। ৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে এখানকার কুরাখানি শাসক সুতুক বুগরা খান ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ইসলামকে রাজধর্মের মর্যাদা দেন। সেই থেকে এই অঞ্চল মুসলিম সভ্যতা-সংস্কৃতির তীর্থ হয়ে উঠে। তিব্বত, কাশ্মির, চীন, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়াসহ আশেপাশের প্রায় সবগুলো দেশে ইসলাম প্রচার করেছেন উইঘুর ইসলাম প্রচারকেরা।

ঊনবিনশ শতাব্দী। পৃথিবীর শক্তিধর দেশগুলো নেমে পড়েছে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোকে গ্রাস করতে, উপনিবেশ স্থাপন করতে। প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ ও ভৌগলিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিস্তীর্ণ এই ভূখণ্ডের উপর নজর পড়ে সাম্রাজ্য বিস্তারে মরিয়া দুই শক্তি চীন ও রাশিয়া। শতাব্দীকাল ধরে এটি দখলে দুপক্ষের মাঝে চলতে থাকে রক্তাক্ত প্রতিযোগিতা।

অবশেষে ১৮৮১ সালে চীন এটি দখল করে নেয়। দখলের পর থেকে চীন এ অঞ্চলের মানুষের ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা ও পরিচিতি মুছে ফেলার প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। কেড়ে নেয় উইঘুরদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার। প্রতিবাদী জনতার উপর চালাতে থাকে রোমহর্ষক নিপীড়ন। ফলশ্রুতিতে উইঘুর তরুণরা হাতে তুলে নেয় অস্ত্র । শুরু হয় উইঘুর স্বাধীনতা আন্দোলনের, উড্ডীন হয় বিপ্লবের নীল নিশানা।

এ বিপ্লব সর্বোচ্চ গতি লাভ করে যখন ১৯৪০ সালে চীন ও রাশিয়ার সম্মিলিত বাহিনী উইঘুরদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন আরম্ভ করে। ১৮৯৯ সালে আলতাই প্রদেশের কোকতোগাই অঞ্চলে জন্ম নেয়া কাজাক বংশোদ্ভূত উসমান ইসলাম উগলু তথা উসমান বাতুর এ সময় টগবগে যুবক। স্বজাতির উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তাকে ব্যাকুল করে তোলে। স্বপ্নবাজ এ তরুণ অন্য অনেক উইঘুর তরুণ বিপ্লবীর মতো সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন অসম শত্রুর বিরুদ্ধে। উসমান তার চমৎকার অঙ্গসৌষ্ঠব, তীক্ষ্ণ মেধা শক্তি, রণচাতুর্য ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির জন্য অল্প সময়ে বিপ্লবীদের মধ্যমণি হয়ে ওঠেন। বিপ্লবীদের অব্যাহত প্রচেষ্টায় ১৯৪৪ সালে পূর্ব তুর্কিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। নির্মিত হতে থাকে উইঘুর জাতির স্বপ্নসৌধ। কিন্তু এ স্বাধীনতার মহত্ব দীর্ঘ হতে পারেনি। ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্টরা চীনা গৃহযুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার পর পূর্ব তুর্কিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল এ নবীন রাষ্ট্র খুব বেশি দিন টিকে থাকতে পারে নি । অক্টোবরের দিকে পতন ঘটে পূর্ব তুর্কিস্তান রাষ্ট্রের। উইঘুরদের উপর আবার নেমে আসে কেয়ামতের বিভীষিকা।

উসমানের নেতৃত্বে উইঘুর তরুণ ‘রা সশস্ত্র বিপ্লব শুরু করে। আলতাই পর্বতমালা থেকে শুরু হওয়া সে বিদ্রোহের দাবানল দ্রুততম সময়ে ছড়িয়ে পড়ে পুরো পূর্ব তুর্কিস্তানে। উসমানের বাহিনীর চোরাগোপ্তা হামলা ও কমান্ডো অভিযানে নাকাল হতে হয় চীনা বাহিনীকে। উসমান মাত্র ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে আলতাই পর্বতাঞ্চলের দুর্যোগময় প্রকৃতি ও সামরিক সীমাবদ্ধতা উপেক্ষা করে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে বছরের পর বছর ধরে লড়ে যান প্রবল শক্তিশালী চীনের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে, মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্যে। স্বল্পভাষী অথচ দ্বিতীয়রহিত ধীমান এ রণবীরকে যমের মতো ভয় পেত চীনা বাহিনী।

পূর্ব তুর্কিস্তানের স্বাধিকার পুনরুদ্ধারের এই বিপ্লবী তৎপরতা প্রায় সফলই হতে চলেছিল। এরই মধ্যে ঘটে গেল অনাকাঙ্ক্ষিত বিপত্তি। অনুচর বেশি এক গুপ্তচর চীনা বাহিনীকে তার অবস্থান জানিয়ে দেয়। উসমান তখন মাত্র দুশ অনুগামী নিয়ে একটা বিশেষ অভিযানে বের হয়েছিলেন।

অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত চীনা বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে একে একে শহীদ হয়ে যান উসমানের অনুগামীরা। উসমানের রাইফেলের সব গুলি শেষ হয়ে আসে। খঞ্জর দিয়ে লড়তে লড়তে আহত উসমান এক সময় ভূমিতে লুটিয়ে পড়েন। দিনটি ছিল ১৯৫১ সালের ২৯ এপ্রিল। উসমান বন্দী হন। তাকে শিরোচ্ছেদ করে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর চেহারায় হাসি ফুটিয়ে তাকবির দিতে দিতে তিনি শাহাদাতকে বরণ করে নেন।

উসমান ইসলাম উগলু ‘র মৃত্যু সংবাদ এসে পৌঁছায় তাঁর মহীয়সী মায়ের কাছে। মহান এক সংগ্রামী ও শহীদের মা হতে পেরে তাঁর গর্বের শেষ ছিল না। নেতার মৃত্যুর পর উসমানের অনুসারীরা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এর ফলে স্বাধিকার আন্দোলন তখনকার মতো থেমে গেলেও উসমান আজো তাঁর সরব ও শক্তিশালী উপস্থিতি ধরে রেখেছে বিপ্লব ও স্বাধিকার আন্দোলনের ক্যানভাসে। উসমানেরা পৃথিবীর সব বিপ্লবীদের প্রেরণার বাতিঘর হয়ে বেঁচে থাকবেন যুগ যুগান্তরে।

তুর্কিস্তান টাইমসে ‘ তুর্কিস্তান আল মানসিইয়া… উসমান বাতুর’ – শিরোনামে প্রকাশিত লেখা অবলম্বনে।

[email protected]

লেখকঃ কলাম লেখক

আরও পড়ুন-

ঐতিহাসিক আফগান কেন দানবের নজরে

জোরুজালেমে রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে হযরত ওমর (রা:) এর অনুভূতি

 

আরও পড়ুন