Ads

ঐতিহাসিক আফগান কেন দানবের নজরে

আসাদ পারভেজ

হাজারো বছরের ইতিহাস সমৃদ্ধ আফগান ভূমি প্রাচীনকাল থেকেই এশিয়া তথা পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান খনন করে জানা যায়, উত্তর আফগানিস্তানে প্রায় ৫০হাজার বছর আগেও মানুষের বসবাস ছিল। খ্রি.পূ. ২০০০ থেকে মধ্য এশিয়ার মানুষ এই অঞ্চলে আসতে থাকে। যখন এলাকাটির নাম ছিল আরিয়ানা তখন আর্যরা ইরান থেকে এসেছিল। যুগে যুগে গ্রেকো-বারট্রিয়ান, কুশান, হেফথালিটিস, কাবুল শাহী, সাফারি, সামানি, গজনবী, ঘুরি, খিলজি, কারতি, মোঘল, হুতাক এবং দুররানি সাম্রাজ্য আফগানিস্তান শাসন করে। এই ভূমি নিয়ে দুইশত বছর মোঘল, উজবেক বুখারা খানাত ও পারস্যের সাফাভি রাজবংশের রাজারা যুদ্ধ করেন। সাধারণত মোঘলরা কাবুল এবং পারসিকরা হেরাত দখলে রাখত। আর কান্দাহরের ক্ষমতা হাত বদল হতো। আফগানিস্তানে সোভিয়েতের ভূমিকা  রয়েছে

১৭০৯ সালে স্থানীয় ঝিলজাই গোত্রের নেতা মিরওয়াইস হুতাক সাফাভিদের পরাজিত করে স্বাধীন আফগানিস্তানের গোড়া পত্তন করেন। ১৭৪৭ সালে আহমদ শাহ দুররানি কান্দাহারকে রাজধানী করে দুররানি সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। তার মৃত্যুর পর পুত্র তৈমুর শাহ দুররানি কান্দাহার থেকে কাবুলে রাজধানী স্থানান্তর করেন। অতঃপর জামাল শাহ, মাহমুদ শাহ, সুজা শাহসহ এই বংশের অন্যরা দেশ চালান। বহু প্রাচীন বাণিজ্য ও বহিরাক্রমণ এই দেশের মধ্য দিয়েই সংঘটিত হয়েছে। শতাব্দী থেকে শতাব্দী এই মাটি মাড়িয়ে চলাচল করতে গিয়ে অনেকেই বসতি স্থাপন করেছে এখানে। আফগান নামে পরিচিত পশতু জাতির দেশে নানা জাতি গোষ্ঠী নিয়ে আজকের আফগানিস্তান।

আধুনিক আফগানিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা দোস্ত মোহাম্মদ। যিনি ১৮২৬ সালে দেশটির আমির হন। পরবর্তী সময়ে বাদশা আমানুল্লাহতুর্কি নেতা কামাল পাশার ধাচে আফগানিস্তানের আধুনিকায়নের কাজ হাতে নেন। সোভিয়েত বলশেভিকদের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে ব্রিটিশরা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। প্রায় ৯ মাস অরাজকতা চলার পর জেনারেল নাদির খান রাজা হন। ১৯৩৩ সালে তিনি নিহত হলে পুত্র জহির শাহ সিংহাসনে বসেন। তিনি চাচাতো ভাই দাউদ খানকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন। একটা সময়ে তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেন- রাজা জহির শাহ। ১৯৭৩ সালে জহির শাহ ইউরোপ সফরে বের হন। এ সুযোগে১৭ জুলাই রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানে রাজতন্ত্রের পতনে প্রজাতন্ত্র হিসেবে আফগানিস্তানের আবির্ভাব ঘটে। সরকার প্রধান হন দাউদ খান।প্রজাতন্ত্রে এসেই দেশটি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

১৯৭৭ সালে সোভিয়েত প্রধান লিওনিদ ব্রেজনেভের ইন্ধনে আফগানিস্তানের মার্কসবাদী দল পারচাম ও খালক একত্রিত হয়ে Peoples Democratic Party of Afganistan গঠন করে। ১৯৭৮ সালের ২৭ এপ্রিল দলটি অভ্যুত্থান ঘটালে দাউদ খান সপরিবারে নিহত হলে পিডিপিএ থেকে নুর মো: তারাকী ক্ষমতায় বসেন। এরপর সোভিয়েত-আফগান মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

একে অপরের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও অখণ্ডতার ব্যাপারে একসাথে কাজ করার বিষয়টি চুক্তিতে নিয়ে আসে। ১৯৭৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর মার্কিনপন্থী উপ-প্রধানমন্ত্রী হাফিজুল্লাহ আমীন প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তারাকীকে সরিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন। একই বছরের২৭ ডিসেম্বর তাকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন পারচাম নেতা বারবাক কারমাল। তিনি পুরোপুরি মস্কোপন্থী ছিলেন।

অপরদিকে আফগানিস্তানে সোভিয়েতের ভূমিকা পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের উৎকন্ঠা তৈরি করে। এ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের নেতৃত্বে পাক-আফগান সীমান্তে সরকার বিরোধীদের নিয়ে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলে। দেশ দুটি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত কয়েক হাজার যোদ্ধাকে আফগানিস্তানে পাঠায়। তাদের নেতৃত্বে আফগানিস্তান অস্থির হয়ে উঠে। এই অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ, জাতীয় সংহতি ও দেশের অখন্ডতা বজায় রাখার জন্য কারমাল সরকার সোভিয়েত বাহিনীর সাহায্য প্রার্থনা করে। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৯৭৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্য প্রবেশ করে।

দেশটি দুটো প্রবল প্রতিবেশি শক্তি রাশিয়া ও চীনের এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দাবার ছকে পরিণত হয়। বিশ্বের প্রচন্ড বিস্ফোরণ মধ্যপ্রাচ্যের নিকটবর্তী হওয়াটাও তার জিও পলিটিক্যাল গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়। এসব কিছুকে ছাপিয়ে যায় বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের উপর দেশটির বিশাল রাজত্ব। পাকিস্তানের সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্র তার ঘাঁটি গাড়ার চেষ্টা চালায় আফগানিস্তানে। ফলে সোভিয়েত-মার্কিন দ্বন্দ্ব প্রকট হয়। স্থল বেষ্টিত অঞ্চলটির প্রাকৃতিক সম্পদ পাইপ লাইনের মাধ্যমে করায়ত্ব করার শক্তিসমূহের মধ্যে গোপন চক্রান্ত, যা নাইন ইলেভেনের জন্ম দিয়েছে।

আফগানিস্তান থেকে রাশিয়ানদের বিতাড়িত করার লক্ষ্যে লাদেনের উত্থানের পেছনে CIA এর ভূমিকা ছিল। সংস্থাটিই মার্কিন উদ্দেশ্য পূরণের জন্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের যোগ-সাজশে তাকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছে। এ সংগঠনগুলো আফগানিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে সংগ্রাম করে। উপজাতীয় গোষ্ঠীগুলো ও মুজাহেদীন সংগঠনগুলোর মধ্যে অভ্যন্তÍরীণ পারস্পরিক বিরোধ প্রকট ছিল, যা কমিউনিস্ট শাসনের বিরোধীতায় এক হয়।

আফগানিস্তান থেকে রুশ সৈন্য প্রত্যাহারের প্রশ্নে ১৯৮৮ সালের ১৪ এপ্রিল জাতিসংঘের ইউরোপীয় সদর দপ্তর জেনেভায় যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী রুশ সৈন্য ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে আফগানিস্তান ত্যাগ করে। এরপর ক্ষমতাসীন মস্কোপন্থী নজিবুল্লাহর সরকার এবং মুজাহিদদের মধ্যে গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয়। ততক্ষণে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়।১৯৯২ সালের ১৫ এপ্রিল মুজাহিদ গেরিলারা নজিবুল্লাহ সরকারকে পরাজিত করে রাজধানী কাবুল দখল করে।

১৯৯২ সালে বুরহান উদ্দীন রব্বানী ও গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার যথাক্রমে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকায় উভয়ের অনুগামী সৈন্যরা যুদ্ধে লিপ্ত হয়।বিশৃঙ্খলার সুযোগে তালেবান বাহিনী মোলা ওমরের নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে কাবুল আক্রমণ করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে।তারা দেশটিতে কঠোর ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করে।

স্নায়ু যুদ্ধোত্তরকালে ভূ-রাজনীতি থেকে ভূ-অর্থনীতির বিষয়সমূহ অধিক গুরুত্ব লাভ করে। বিশেষত মধ্য এশীয় অঞ্চলের জ্বালানী তেল ও গ্যাস পরিবহন পাইপ লাইনের সাথে সম্পর্কিত হয়ে পড়ে। ইরান চায় পাইপ লাইনগুলোকে তুরস্ক অথবা আফগানিস্তান হয়ে নিজ ভূখন্ডের মধ্য দিয়ে পারস্য উপসাগরে নিয়ে যেতে। যাতে মার্কিনী স্বার্থ ব্যাহত হয়। তালেবানরা রাশিয়া ও ইরান উভয় দেশের বিরুদ্ধভাবাপন্ন। দলটির প্রধান ওসামা বিন লাদেন, যার ঐ সময়কার কাজ ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইজরাইলের নিষ্পেষণমূলক তথা মার্কিন স্বার্থ বিরোধী। সবকিছু মিলিয়ে মার্কিন প্রশাসন কাবুল দখলের স্বপ্নে বিভোর হয়।এর জন্য যেতে হবে পেছনে ।

তালেবান মুক্ত কাবুল সরকারের দখলেকিন্তু কান্দাহারের চিত্র ব্যতিক্রম। শহর কান্দাহারে তালেবানের কথাই আইন। সরকারী কোনো নিয়ম-নীতি বা হুমুমত কান্দাহারকে স্পর্শ করে না। বলছি ১৯৯৫ সালের কথা একদিন সকালে কান্দাহারের তালেবান গভর্নর মোল্লা হাসানের কক্ষে ডুকেন ধূসর রঙ্গের ছুট পরিহিত প্রায় ৬ ফুট উচ্চতার এক সুদর্শন বিদেশি। এই ব্যক্তি আর্জেন্টিনার তেল-গ্যাস উত্তোলন ও রপ্তানিকারক কম্পানি ব্রিদাস কর্পোরেশন-এর চেয়ারম্যান কার্লোস বুলঘোরেনি। কয়েক বছর যাবৎ ব্রিদাস কাজ করছে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানির পথ খুঁজতে। মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তানে পাওয়া গ্যাস পাইপ লাইনের মাধ্যমে দক্ষিণে আরব সাগরের তীর পর্যন্ত নিয়ে আসার প্রজেক্ট নিয়ে তারা ব্যস্ত। দেশটির দুইটি খুনি থেকে কয়েক বছর আগে গ্যাস উত্তোলনের অন্তত দুইটি চুক্তি হয়ে আছে। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী এই গ্যাস নিয়ে যেতে হলে আফগানিস্তানকে প্রয়োজন। অথচ আফগানিস্তান তখন এক জীবন্ত আগ্নেয়গিরি।

আফগানিস্তানে পূর্ণাঙ্গ কোনো শাসন ব্যবস্থা নেই। শাসকের অবস্থাও নড়েবড়ে। একেক শহরে একেক বাহিনীর রাজত্ব। কাবুলে আফগানি সরকার, কান্দাহারে তালেবান। এর বাইরেও যুদ্ধে লিপ্ত তৃতীয় আরেকটা গ্রুপ। তারা মস্কোপন্থি কথিত শাসক নজিবুল্লাহর অনুগত। এই গ্রুপটির নেতৃত্ব দিচ্ছে আব্দুর রশিদ দোস্তাম। রশিদের বাহিনী দখল করে আছে গুরুত্বপূর্ণ মাদানি শরীফ। কাজেই ব্যবসা-বাণিজ্য যদি করতেই হয়, তাহলে ব্রিদাস কর্পোরেশনকে সব পক্ষের সাথে বসতে হবে। সে কারণে কোম্পানির চেয়ারম্যান এসেছেন তালেবান গভর্নরের কাছে। কিন্তু মোল্লা হাসান তাকে কোনোরকম সুখবর দেননি। আবার একেবারে ফিরিয়েও দেননি। ব্রিদাস কোনোভাবেই তালেবানকে হাত ছাড়া করতে চায় না।কারণ তাদের ধারণা, এই তালেবানই আফগানিস্তানের পরবর্তী পরাশক্তি। আফগানদের অনুমতি পাওয়া না পাওয়ার অনিশ্চয়তার মধ্যেও ব্রিদাসের লোকজন যুদ্ধবাজ নেতা ও গোষ্ঠীর ধারে ধারে ঘুরেছেন।

আফগানিস্তান এমনই এক জায়গা, যেখানে রাজ পরিবারের লোকেরাই রাজাকে তাড়িয়েছে। কমিউনিস্টরা কমিউনিস্টদের মেরেছে, এখানে রুশদের বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করা মুজাহিদরা আবার নিজেদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে। ধিরে ধিরে কাবুলের চিত্রটাই কেমন জানি হয়ে উঠে। দিনে চালাতো আফগানদের এক গ্রুপ, রাত এলেই শহরের নিয়ন্ত্রণ চলে যেত আরেক গ্রুপের হাতে। এটা মোটেও গল্প নয়। আফগানিস্তানে সত্যিই তেমনটা ঘটেছে।

কান্দাহারের কাজ সেরেই কোম্পানির ছোট্ট বিমানে করে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে ঢুকলেন কার্লোস। বাঘ্রা বিমান বন্দর হয়ে তিনি যখন কাবুলে পৌঁছালেন, ততক্ষণে শহরের বুকে সন্ধ্যা নেমে এসছে। পরের দিন রাব্বানি সরকারের সাথে বৈঠকে আফগান ভূমি ব্যবহারের অঙ্গিকার আদায় করে নেন কার্লোস। গ্যাস পাইপ লাইনের পেপারে মাদারি শরীফের যুদ্ধবাজ নেতা আব্দুর রশিদের দোস্তামের গ্রিন সিগলান আগেই পাওয়া গিয়েছিল। তাহলে বাকী থাকল কেবই তালেবান।

আর্জেন্টিনার কোম্পানি ব্রিদাস এ অঞ্চলে পা রাখার আগেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায়। মধ্য এশিয়ার পাঁচটি মুসলিম প্রজাতন্ত্র স্বাধীন হয়ে যায়। তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান আর কিরগিজস্তান জ্বালানি সম্পদের দিক দিয়ে সম্ভাবনার দেশ হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে। নব্বই দশকের শুরুতে আমেরিকার নিরিক্ষা সংস্থাগুলো কাসপিয়ান অঞ্চলে কি পরিমান জ্বালানি মজুদ রয়েছে তার তথ্য প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, কাসপিয়ান অঞ্চলে তেল১০০ থেকে ১৫০ বিলিয়ন ব্যারেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস ২৩৬ থেকে ২৩৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট মজুদ রয়েছে।

ব্রিদাসের নজরে প্রথমে আসে তুর্কমিনিস্তান। ১৯৯২ সালের জানুয়াতে দেশটির আসকাবাদে আসেন কার্লোস।১৩ তারিখে দেশটির সাথে গ্যাস চুক্তি করে ব্রিদাস। এ কোম্পানি প্রাথমিকভাবে তুর্কমিনিস্তানের গ্যাস রপ্তানি করতে চেয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ায়। বিশেষ করে পাকিস্তান ও ভারতে। ব্রিদাসের পরিকল্পনায় ইরানকে বাদ দিয়ে আফগানিস্তান-পাকিস্তান পাইপ লাইনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ৭৫০ মাইল দীর্ঘ এই পাইপ লাইন পাকিস্তানের মুলতান হয়ে গোয়াটা পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ার কথা রয়েছে। একইভাবে মুলতান হয়ে পরবর্তীতে ভারতের দিল্লি পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা। কিন্তু পাইপ লাইন নিয়ে ব্রিদাস দ্রুত সময়ের মধ্যে মার্কিন কোম্পানি ইউনিকলের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে।

কাবুলের আফগান সরকারের সাথে বিশ বছর মেয়াদি চুক্তি সই করে ব্রিদাস। তার আগে পাকিস্তান ও তুর্কমিনিস্তানের মধ্যেও চুক্তি সই হয়।কাবুলের সাথে চুক্তির আওতায় পাইপ লাইন তৈরি, রক্ষণাবেক্ষণ এবং আফগানিস্তানে বিতরণের কথা ছিল। এ চুক্তির ফলে রব্বানি সরকারের কেবল ট্রানজিট ফ্রি বাবদ পাওয়ার কথা ছিল প্রতি বছর ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ বৃহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পৃথিবীর অন্যসব বড়ো বড়ো কোম্পানির সাথেও অংশীদারিত্বের জন্য আলোচনা শুরু করল ব্রিদাস। এসব কোম্পানীর মধ্যে ছিল ইউনিকলও। ইউনিকলের সাথে তুর্কমিনিস্তানের যোগাযোগ হয় ১৯৯৫ সালে। সে বছর তুর্কমিনিস্তানের প্রতিনিধি দল টেক্সাসের হিউসটনে ইউনিকলের সদর দফতরে যায়।

ব্রিদাসের আমন্ত্রণেই ইউনিকলের কর্মকর্তারা সফর করেন ইসলামাবাদ ও আসকাবাদ, উদ্দেশ্য ব্রিদাসের পরিকল্পনা সরেজমিনে যাচাই করে দেখা। যদিও ইউনিকলের কর্মকর্তারা দুই দেশের মাঝখানের দেশ আফগানিস্তান সফর করেনি। কারণ রাশিয়া চলে যাওয়ার পর আগের মতো মাথা ঘামানো প্রয়োজন আছে বলে মনে করেনি‘সিআইএ’। তার জায়গা দখল করে নিয়েছিল পাক গোয়েন্দা সংস্থা ‘আইএসআই’। পরে পাকিস্তানের ভাষ্যই আফগানিস্তানের ভাষ্য মনে করে ইউনিকল। যুদ্ধের নেতা সাপার মুরাদ নিয়াজভ নিজেও চেয়েছিলেন ইউনিকলের মাধ্যমে মার্কিন বিনিয়োগ কাছে টানতে।

সাপার মুরাদ আগের চুক্তিগুলো নিয়ে ব্রিদাসের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। এ অবস্থায় ব্রিদাস বুঝতে পারে ব্যবসা টিকাতে হলে পার্টনারশিপে (কনসলটিয়ামে) যেতে হবে শক্তিধর কোনো দেশের বৃহৎ কোম্পানির সাথে। তাই তারা দৃষ্টি দিয়েছিল ইউনিকলের দিকে। দুই দেশের কর্মকর্তাদের সামনে মার্কিন কোম্পানি ইউনিকল আর সৌদি আরবের টেলটেব কোম্পানির সাথে আলাদা আলাদা চুক্তি সই করেন। এই চুক্তিটাও তাই তুর্কমিনিস্তান থেকে আরও একটি পাইপ লাইন আফগানিস্তান হয়ে যাবে পাকিস্তানের গোয়াটর বন্দর পর্যন্ত। এই পাইপ লাইন দিয়ে মূলত ব্রিদাসের মূল প্রকল্পের প্রাকৃতিক গ্যাস যাবে। চুক্তিতে আফগানিস্তানে গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থাও রাখা হয়। ভারতের বাজার ধরাও আরেক উদ্দেশ্য।

ইউনিকল যে এ অঞ্চলের পেট্টোলিয়াম নিয়ে চক্রান্তের সূচনা করেছে তা ব্রিদাসের ভাবার কথা নয়। সামগ্রিক দিক বিবেচনায় ব্রিদাস বুঝেছিল, সকল কিছু নির্ভর করবে আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতার উপর। আর তালেবানই হবে দেশটির নতুন শক্তি। সে জন্য তারা তালেবান ও পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক মজবুত করতে ভুল করেনি।

ইউনিকল ঝেঁকে বসল তুর্কমিনিস্তানে। তাদের সাথে বিরোধে জড়ালো ব্রিদাস। ১৯৯৬ সালের জুলাইতে ব্রিদাস টেক্সাসের হিউসটনে ১৫ মিলিয়ন ডলারে ক্ষতিপূরণ চেয়ে ইউনিকলের বিরুদ্ধে মামলা করল। এর মধ্যেই কাবুল দখল করে নেয় তালেবান। ভরসা পায় ব্রিদাস। তারা অপেক্ষায় ছিল তালেবান অনুমতির। অন্যদিকে ইউনিকলও তালেবানকে হাত করতে মরিয়া। তালেবান যোদ্ধাদের শক্তিশালী ঘাটি কান্দাহারে অফিস করে ইউনিকল। পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টো সরকারের পতনে নতুন মুসলিম লীগ সরকার এলে তারা যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুকে পড়ে।

তবে তালেবান দুই পক্ষকেই ঝুলিয়ে রাখে। তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকল। ১৯৯৮ সালে ব্রিদাসের মামলা খারিজ হয়ে যায়।

ইউনিকলকে দিয়ে ওয়াশিংটন প্রথমে তালেবানের সাথে ব্যবসা করতে চাইল। ১৯৯৭ সালের শেষ দিকে মার্কিন কোম্পানি ইউনিকল তালেবানের প্রতিনিধি দলকে টেক্সাসের হিউসটনে আমন্ত্রণ করে। যদিও সেই দিন কোনো চুক্তি হয়নি। এ অবস্থাতে আফগানিস্তান হয়ে কাসপিয়ান তেল ও গ্যাসের সম্ভাব্য রোড নির্ধারণে আরও একটি বুশ ঘনিষ্ঠ কোম্পানি এনড্রড পর্দার অন্তরালে কাজে নেমে পড়ে।

২০০১ সালে মার্কিন সরকার আফগান সরকারকে একটি প্রস্তাব দেয়, যেখানে প্রস্তাব মেনে না নিলে বোমা মেরে ধ্বংস করার চূড়ান্ত হুমকি দেওয়া হয়। তার কয়েক মাস পরে নাইন ইলেভেনের ঘটনা আফগানিস্তানে মার্কিন হামলা সহজতর করে দেয়। বুশের আফগান ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন আফগান বংশদ্ভুত জালমে খালিলজাদ। আফগান ও ইরাকে তিনি ছিলেন বুশের দূত। কাজ করেছিলেন ইউনিকলের আফগান পাইপ লাইনে। ‘অপারেশন এন্ড ডিউরিন ফ্রিডম’ অভিযানে তালেবান ও আল কায়েদার পতনের পর ইউনিকলের আরেক উপদেষ্টা হামিদ কারজাইকে আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট করার তদবির করেন এই জালেম খালিলজাদ।

আজকের আফগানিস্তান পৃথিবীর এক জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডলী। গত বিশ বছর ধরে দেশটির মাটি ও মানুষ শুধুই জ্বলছে আর মরছে। এ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ব সম্প্রদায় দেশটির প্রতি যতটা না ন্যায় বিচার করা জরুরি, তার চাইতে মুসলিম বিশ্ব তথা আফগানিদের সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে আরও বেশি।

লেখক: গবেষক, কলামিস্ট ও রাষ্ট্রচিন্তক

লেখকের প্রকাশিত লেখা-

ইতিহাসে ফিলিস্তিনঃ পবিত্র ভূমির মালিকানা (পর্ব-৩)

ইতিহাসে ফিলিস্তিনঃ পবিত্র ভূমির মালিকানা (পর্ব-২)

ইতিহাসে ফিলিস্তিনঃ পবিত্র ভূমির মালিকানা (পর্ব-১)

আরও পড়ুন