Ads

কাঠমিস্ত্রীর স্বপ্ন যেভাবে পূর্ণ করলেন সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী

আরিফুল ইসলাম মমিন

১০৯৯ সালের কোনো এক সময়ের ঘটনা এটি। বায়তুল মুকাদ্দাস তখন খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের দখলে। সেময় বাগদাদ শহরের এক কাঠমিস্ত্রি বসবাস করতেন। এ কাঠমিস্ত্রি মনের ভালোবাসা দিয়ে কারুকার্যমণ্ডিত একটি মিম্বার তৈরি করেন।মিম্বারটি সৌন্দর্যের কথা লোক মুখে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আর তা দেখতে মানুষ দলে দলে কাঠমিস্ত্রির বাড়িতে আসতে শুরু করে। অনেকেই মিম্বারটি কিনতে চায়। কিন্তু কাঠমিস্ত্রি তা বিক্রি করতে রাজি হয়নি। তার একই জবাব-‘এ মিম্বার বিক্রির জন্য নয়; বরং এটি বানিয়েছি মসজিদে আল আকসার জন্য‘ কাঠ মিস্ত্রির কথা শুনে সবাই হাসতো। অনেকে তাকে পাগল বলে সম্বোধন করতো। কিন্তু কাঠমিস্ত্রি তার সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল-অবিচল।

অনেকদিন পর…

একদিন এক ছোট্ট ছেলে তার বাবার হাত ধরে মিম্বারটি দেখতে এসেছিল। কাঠমিস্ত্রির কাছে তার স্বপ্নে কথাও জেনেছিল। সেদিনই ওই ছোট্ট ছেলেটি প্রতিজ্ঞা করেছিল- সে কাঠমিস্ত্রির স্বপ্ন পূরণ করবে। সেই ছেলেটি আর কেউ নন; তিনি হলেন- বীর সেনাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী। আর তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়ের পর সেই মিম্বারটি এ মসজিদে স্থাপন করেছিলেন।

সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ব্যাক্তিগত জীবনে ছিলেন ধর্মানুরাগী। তিনি যুদ্ধের সময়গুলোতে এবং যেকোনো সফরে একজন ইমামকে সঙ্গে রাখতেন, যিনি তার নামাজের ইমামতি করতেন। ইমাম না থাকলে তিনি উপস্থিত ধর্মপ্রাণ গবেষক ও আলেমদের পিছনেও নামাজ পড়তেন। বলা হয়ে থাকে সালাহউদ্দিন আউয়ুবী মৃত্যুর আগে তিন দিন গভীর কোমায় ছিলেন, এই তিন দিন ছাড়া অন্য কোনো সময় তিনি নামাজ ছেড়ে দেননি।

ইউরোপজুড়ে সালাহউদ্দিনের নানা ঘটনা প্রচলিত ছিল, এখনো আছে। একবার একটা ঘটনা ঘটেছিল এইরকম, এক খ্রিস্টান মহিলার তিন মাসের বাচ্চা চুরি হয়ে যায়, এবং সেই বাচ্চাকে বাজারে বিক্রি করে দেয়া হয়। খ্রিস্টানরা তাকে বলল সুলতান সালাহউদ্দিনের কাছে যেতে। মহিলাটির কষ্ট জানবার পর সালাহউদ্দিন নিজের টাকায় বাচ্চাটি কিনে নেন আবার, এবং মহিলাটিকে ফিরিয়ে দেন। সালাহউদ্দিনের দরবারে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে মহিলার চোখ থেকে। সালাহউদ্দিন একটি ঘোড়ায় করে তাকে নিজের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেন।

ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ ক্রুসেড যুদ্ধে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ছিলেন একজন কিংবদন্তি যোদ্ধা। ক্রুসেডারদের সাথে এই যুদ্ধে তিনি অসীম সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছেন এবং তাদেরকে পরাজিত করে পবিত্র ভূমি জেরুজালেম মুক্ত করেছিলেন। যুদ্ধে জয়লাভ করেও তিনি ইউরোপোর সম্মিলিত শক্তিগুলোাকে ফিরে যেতে দিয়েছিলেন। বিশ্ব এমন সাহসী এবং সহানুভূতিশীল বিজয়ী আর দেখেনি।

ক্রসেডের এই যুদ্ধে খ্রিস্টানদের সম্মিলিত ইউরোপ ও পশ্চিমা শক্তিগুলো এশীয়ার মুসলিম শক্তিগুলোকে উৎখাত করতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সালাউদ্দিন আইয়ুবীর কাছে পরাজিত হয়েছিল।

মাইকেল হ্যামিল্টনের লস্ট হিস্টোরি বইতে লিখেছেন,

১১৯২ সালে আক্রা আক্রমণের সময় ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন সালাহউদ্দিন শত্রু রিচার্ডের চিকিৎসার জন্য নিজের ব্যক্তিগত ডাক্তারদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। জ্বর নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্য পাঠান বরফ, তাছাড়া ফলফলাদিও পাঠান। আরেকটি ঘটনা আমরা জানতে পারি, যখন রিচার্ড নিজের ঘোড়া হারিয়ে বিশাল মুসলিম বাহিনীর সামনে একা দাঁড়িয়ে থাকেন ময়দানে, তখন মুসলিমরা তাকে আক্রমণ করেনি। বরং, সুলতান সালাহউদ্দিন তার জন্য দুটো ঘোড়া পাঠিয়ে দেন যেন সমানে সমানে যুদ্ধ হতে পারে।

মৃত্যুর আগে তিনি সম্পত্তি দান করে গিয়েছিলেন গরীব দুঃখীদের। মাত্র এক স্বর্ণমুদ্রা আর চল্লিশ রৌপ্যমুদ্রা ছাড়া আর কিছুই ছিল না তার বাকি। তার জানাজা-দাফন-কাফনের টাকাটাও হচ্ছিল না। দামেস্কের উমাইয়া মসজিদের বাহিরের বাগানে তাকে দাফন করা হয়। তার অসংখ্য প্রজা হজ্ব করবার সৌভাগ্য ও নিরাপত্তা সালাহউদ্দিনের কল্যাণে পেলেও, সালাহউদ্দিন হজ্ব করবার সৌভাগ্য পাননি, যদিও তার পরিকল্পনা ছিল।

বিশ্ব-বিজয়ী মুসলিম বীর। মিসর ও সিরিয়ার প্রথম সুলতান, আইয়ুবীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। একজন শক্তিশালী শাসক, নির্ভীক ও সাহসী যোদ্ধা। যার শূন্যতা এখনো অনুভব করে মুসলিম বিশ্ব।

আরও পড়ুন