Ads

কেমন ছিল নবিজির রাজনৈতিক প্রজ্ঞা?

।। সাব্বির জাদিদ ।।

কেমন ছিল নবিজির রাজনৈতিক প্রজ্ঞা? পঞ্চম হিজরিতে নবিজি খবর পেলেন, বনু মোস্তালিকের দুর্গপতি হারিস ইবনে জিরার আরব বেদুইনদের সাথে ঘোঁট পাকিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। নবিজির গুপ্তচর বোরাইদা ইবনে হোসাইন এনেছে এই গুরুতর সংবাদ।খবর পেয়েই নবিজি বের হলেন অভিযানে। হারিসের বিষদাঁত এবার না ভাঙলেই নয়। প্রিয় বন্ধু আবু বকরকে দিলেন পতাকা বহনের সম্মান। আর নবিজির অনুপস্থিতিতে মদিনার দায়িত্ব অর্পিত হলো জায়েদ বিন হারেসার চওড়া কাঁধে।

মুসলমানদের আকস্মিক আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল বনু মোস্তালিকের অপ্রস্তুত বাহিনী। এগারো যোদ্ধার লাশ ফেলে দুর্গ ছেড়ে পালাল দুর্গপতি হারিস বিন জিরার। দুর্গপতির অবর্তমানে সৈন্য পরিচালনার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিল হারিসের জামাই মোসাফফা ইবনে সাফওয়ান।কিন্তু দুর্ভাগ্য বনু মোস্তালিকের। তাদের নতুন এই সেনাপতিও নিহত হলো খণ্ড যুদ্ধে। দুর্গপতি পলাতক, সেনাপতি নিহত–আত্মসমর্পণ ছাড়া সাধারণ সৈন্যদের কোনো গতিই রইল না। প্রায় বিনা রক্তপাতের এই যুদ্ধে মুসলমানদের হস্তগত হলো দুর্গের বিপুল সম্পদ– দুই হাজার উট, পাঁচ হাজার বকরি। বন্দী হলো নারী-পুরুষ-শিশু মিলে প্রায় ছয়শত মানুষ।

যুদ্ধের নীতিমালা অনুযায়ী যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সমহারে বণ্টিত হলো মুসলিম সেনাদের মাঝে। বন্দীরা হলো দাসদাসীতে রূপান্তরিত। মুসলিম সেনাপতি আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু অন্যান্য সম্পদের মতো দাসদাসীদেরকেও বণ্টন করে দিলেন সৈন্যদের মাঝে।

আরও পড়ুন- অপূর্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী রসুল মুহাম্মাদ (স:)

মুসলিম বাহিনী যখন বিজয়ের আনন্দে ঝলমলে চেহারায় মদিনায় ফিরছেন, সময়ের লিপিকার তখন অবিনশ্বর কলমে ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায় রচনায় মগ্ন। যুদ্ধের হাঙ্গামায় এক অনিন্দ্য সুন্দরী অভিজাত যুদ্ধবন্দী তরুণীর দিকে কারো আলাদাভাবে নজর পড়েনি। ফলে বণ্টনের সূত্রে এই অভিজাত মেয়েটি সাবেত বিন কায়েস নামক এক সাধারণ সৈন্যের হাতে এসে পড়েছে।

মেয়েটির নাম বারাহ। নাম বারাহ হলেও অচিরেই সে জুয়াইরিয়া নামে পরিচিত হয়ে উঠবে ইতিহাসে এবং অর্জন করবে এই উম্মতের মা নামক এক দুর্লভ মর্যাদার মুকুট।

গতকাল যে বারাহর পরিচয় ছিল দুর্গপতির কন্যা এবং সেনাপতির স্ত্রী হিসেবে, এক রাতের ব্যবধানে সেই বারাহ আজ ‘বিধর্মীদের’ দাসী। বাবা নিখোঁজ। স্বামী নিহত। দুর্গ পদানত। ভরসার সৈন্যবাহিনী বিজয়ী শক্তির করতলগত। হায়! এমন দুঃসহ দিন দেখার আগে যদি তার আয়ু শেষ হয়ে যেত!

বন্দিত্বের কালিমা গায়ে মদিনার পথে চলতে চলতে পরিবারের শোক অনেকটাই কাটিয়ে উঠল বারাহ। যুদ্ধে জীবন উলোটপালোট হয়ে যাওয়ার অনেক ঘটনা সে শুনেছে, কিছু কিছু দেখেছেও। গোত্রপতির কন্যা হিসেবে মনে মনে তারও সামান্য প্রস্তুতি ছিল।

আরও পড়ুন-সাব্বির জাদিদের একটি শোক সংবাদ

ফলে পরিবারের শোক ভুলে বারাহর ভেতর জেগে ওঠে নতুন শোক। এক উচ্চবংশীয় গোত্রপতির কন্যা কীভাবে এক সাধারণ সৈন্যের দাসী হিসেবে বাকি জীবন কাটাবে! মদিনার সম্ভ্রান্ত কোনো নেতার ঘরে যদি সে যেত, তবু তো সান্ত্বনার একটা জায়গা থাকত। মদিনায় পৌঁছনোর আগেই মনের আক্ষেপ মনিবের কাছে খুলে বলল বারাহ– আমাকে মুক্ত করে দিন। বিনিময়ে যা চান তাই দেব।

মনিব সাবেত বিন কায়েস শর্ত দিল উনিশ উকিয়া স্বর্ণমুদ্রার। শর্ত পূরণ করতে পারলেই সে মুক্ত।সময়টা গতকালের হলে অনায়াসে শর্ত পূরণ করতে পারত বারাহ। কিন্তু আজ তো গতকাল নয়। আজ সে নিঃস্ব, অসহায়, সম্বলহীন দাসী। তবু সে চেষ্টা করে যাবে। আজাদির চেয়ে মানুষের বড় কোনো আকাঙ্ক্ষা যে আর নেই।

মদিনায় পৌঁছে নবিজির সঙ্গে দেখা করল বারাহ। সে শুনেছে, মদিনার নবি মুহাম্মদ বড় ভালো মানুষ। তার বুকভর্তি দয়া, হৃদয় ভর্তি মমতা। তার কাছে আমির-ফকির, মনিব-দাসের কোনো ভেদাভেদ নেই। এমন উদার মানুষ কি এক অবলা নারী থেকে মুখ ফেরাতে পারে!

তার আশার পালে উদ্যমের হাওয়া লাগায় কদিন আগের দেখা স্বপ্নটা। সে দেখেছিল, মদিনার আকাশে উদিত একটি ঝলমলে চাঁদ তার ঘরে এসে পড়ছে। ভয়ে বাবা কিংবা স্বামীর কাছে বলেনি ঘটনা। চাঁদ ঘরে আসার ব্যাখ্যা কী? তার মুক্তির কোনো ইশারা আছে ওই স্বপ্নে?

পরিচয় উন্মোচন করে নবিজির কাছে সব খুলে বলল বারাহ। সে এক সম্ভ্রান্ত নারী। দাসী হয়ে সে বাঁচতে চায় না। নবিজি যদি উনিশ উকিয়া স্বর্ণমুদ্রার ব্যবস্থা করে দেন, সব খোয়ানো বাবার কাছে ফিরে গিয়ে সে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারে।

বারাহর কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন নবিজি। একটু ভেবে নিয়ে বললেন, আমি যদি এর থেকে উত্তম কোনো প্রস্তাব তোমাকে দিই, গ্রহণ করবে?

বারাহ দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল, এই মুহূর্তে আজাদির চেয়ে উত্তম আর কী প্রস্তাব থাকতে পারে আমার জন্যে!

নবিজি বললেন, আমি তোমার মুক্তিপণের ব্যবস্থা করে দেব। বিনিময়ে তোমাকে আমার স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে চাই।

আরও পড়ুন- মহানবী (সা.)-এর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা

নবিজির প্রস্তাবে হতভম্ব হলো বারাহ। মুহূর্তে সেই স্বপ্নের দৃশ্যটা ঝিলিক দিয়ে মিলিয়ে গেল চোখের সামনে থেকে। সে এমন এক দাসী, যার বাবা পলাতক, স্বামী নিহত, স্বজাতির লোকেরাও শত্রু পক্ষের দাস। ধ্বংসস্তূপের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মেয়েটির সামনে কিনা মদিনার অধিপতির স্ত্রী হওয়ার মোহনীয় হাতছানি! এই বুঝি সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা! মদিনার আলোকোজ্জ্বল চাঁদ তার কোলে নামতে চলেছে? বারাহ রাজি হয়ে গেল। হে মদিনার সম্রাট, হে আল্লাহর রসুল, এর চেয়ে সম্মানজনক প্রস্তাব আমার জন্য আর কিছু হতে পারে না।

দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে বারাহ কালেমা পড়লেন। অমুসলিম থেকে হলেন মুসলিম। সে থেকে হলেন তিনি। বারাহ থেকে হলেন জুয়াইরিয়া। নবিজিই দিলেন নতুন এই নাম। এক সাধারণ গোত্রপতির কন্যার মাথায় চড়ল উম্মতের জননীর মুকুট।

আমরা জানি, আমাদের নবিজি এগারোটি বিয়ে করেছেন। জুয়াইরিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন তাদের অন্যতম। নবিজির প্রতিটি বিয়ের পেছনেই সুদূরপ্রসারী কোনো না কোনো কারণ বা তাৎপর্য ছিল। যেমন আলোচিত এই বিয়ে, এর পেছনে রাজনীতির প্রভাব কাজ করেছে। তাই, এই বিয়েটিকে আমরা রাজনৈতিক বিয়ে বলতে পারি।

নবিজির সঙ্গে যখন জুয়াইরার বিয়ে হয়, তখন সাহাবিদের ঘরে ঘরে জুয়াইরিয়ার গোত্রের লোকেরা দাসের জীবন যাপন করছে। সাহাবিদের কানে যখন জুয়াইরিয়ার সঙ্গে নবিজির বিয়ের সংবাদ পৌঁছল, তারা নতুন এই মায়ের সম্মানে এক যোগে সব দাস-দাসীকে মুক্ত করে দিলেন। নবির স্ত্রীর আত্মীয়দেরকে তারা দাস বানিয়ে রাখতে পারেন না।

আর এই দাসদাসীরা দেখেছে, যুগে যুগে বিজয়ী শক্তিগুলো বিজিতদের সাথে কী বীভৎস আচরণ করে! কতটা পাশবিক নিপীড়িন চালানো হয় অসহায় মানুষগুলোর ওপর! বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারগুলোও কেড়ে নেয়া হয়। তাদেরকে মনে করা হয় পশুরও অধম। মানুষের নূন্যতম অধিকারটুকুও তাদের দেয়া হয় না।যেন তারা হাতে গড়া মাটির পুতুল, তাদের সঙ্গে যা খুশি তা-ই করা যায়। চাইলে হাত ভাঙা যায়, চোখ উপড়ানো যায়, আঙুল মটকানো যায়। ঝুপ করে কুয়ায় ফেলেও দেয়া যায়। অথচ মুসলিম বিজয়ী শক্তি সবার থেকে আলাদা। এরা অন্য রকম।

যুদ্ধের নিয়মে তাদেরকে এরা বন্দী করেছে বটে, কিন্তু অমানবিক আচরণ করেনি। নিজেদের ভাগের খাবারই এরা তাদেরকে খাইয়েছে। তাদের ওপর কোনো কাজের দায়িত্ব দিলে সেই কাজে হাত লাগিয়েছে নিজেরাও। এমনকি মুসলমানদের নেতা তাদের নেতার মেয়েকে মুক্ত করে স্ত্রীর মর্যাদা পর্যন্ত দিয়েছে।

এতকাল তারা দেখে এসেছে শাসক আর দাসীর সম্পর্ক কেবলই ভোগের, শয্যার। আর এই শাসক দাসীকে দিয়েছে স্ত্রীর সম্মান। আবার সেই স্ত্রীর সম্মানে, ছয়শত মূল্যবান দাসদাসীকে বিনা শর্তে মুক্তি দিয়েছে তার কর্মীরা। যে ধর্ম এত উদার, এত মহৎ, এত মানবিক; সেই ধর্ম থেকে কীভাবে মুখ ফিরিয়ে রাখবে তারা!

বিবেকের ক্রমাগত ঘাই তাদেরকে স্থির থাকতে দেয় না। তারা এক যোগে কালিমা পড়ে এই অন্য রকম মানুষগুলোর দলভুক্ত হয়ে যায়। নাফরমানির পথ ছেড়ে তারা পা রাখে আনুগত্যের পথে। যে পথ শান্তির। যে পথ স্নিগ্ধতার। যে পথ গিয়েছে চলে জান্নাতের মোহনায়। এই পরিবর্তন কখনোই সম্ভব ছিল না, যদি না নবিজি জুয়াইরিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতেন। নবিজির একটি বিয়ের সিদ্ধান্ত বদলে দিল একটি জনপদের ভাগ্য।

[লেখকের প্রজ্ঞায় যার উজালা জগৎ বই থেকে]

লেখকঃ সাব্বির জাদিদ, লেখক ও কলামিস্ট 

 

মহীয়সীঃ নবিজির রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল অসাধারণ । তিনি তার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক  প্রজ্ঞা  খাঁটিয়ে অনেক সুন্দর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যা ইসলামের প্রচার ও প্রসারে অনেক ভূমিকা রেখেছে । তিনি তার অসাধারণ মানবিক  গুণাবলী যেমন মহানুভবতা, ক্ষমা, ভালবাসা ও দরদ দিয়ে মানুষের মন জয় করেছেন । সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে নবিজির রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ই তাকে সহায়তা করেছে । নবিজির রাজনৈতিক প্রজ্ঞা -র জন্য ইসলাম খুব অল্প সময়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে ।

আরও পড়ুন