Ads

কোন মুসলমান লেখক গবেষক কি এগিয়ে আসবেন না?

জিয়াউল হক

বসনিয়া হার্জেগোভিনা, ১৯৯৫। দীর্ঘ ছয়শত বসরের চাপা ক্ষোভ, ধিকি ধিকি জ্বলা হিংসার আগুন আগ্নেয়গীরির তপ্ত লাভা হয়ে বয়ে গেল পুরো একটি মুসলিম জনপদের উপর দিয়ে। ইতিহাসের অন্যতম বর্বর নৃশংস জাতিগত হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে ‘মানবাতাবাদী, আধুনিক এবং সভ্য (!) আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখের সামনেই। আড়াই লক্ষ মুসলমান, নিরস্ত্র নীরিহ প্রাণকে বর্বোরোচিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

বর্বর ইউরোপের মুসলিম ও ইসলাম বিদ্বেষী ক্রুসেড সেই মধ্যযুগীয় উন্মাদনার একটা পর্যায়ে চতুর্দশ শতাব্দির শেষ দিকে এসে; ১৩৮৯ খৃষ্টাব্দে তুর্কি সুলতান মুরাদ কসেভোর যুদ্ধে ইউরোপের সম্মিলিত ক্রুসেড বাহিনীকে পরাজিত করেন শোচনীয়ভাবে। বলা চলে, উত্তর ইউরোপের সামরিক শক্তির মেরুদন্ডই তিনি ভেঙ্গে দেন সে যুদ্ধে। ভ্যাটিকানের পোপ আর তার সহচর পাদ্রিদের মনোবলও ভেঙ্গে যায়। তথাকথিত এই ধর্মগুরুরাই খৃষ্টান জনগণকে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে সারাটা বছর ধরে ক্ষেপিয়ে তোলার কাজে ব্যস্ত থাকতেন।

যুদ্ধে ‘ধবল ধোলাই মাইর’ খাবার পরে নিজের দেশ ও ক্ষমতা বাঁচাতেই হোক কিংবা শুভবুদ্ধি উদয়ের কারণে হোক, সার্বিয়ার তৎকালিন খৃষ্টান রাজা স্টিফেন (Stephen) মুসলমানদের বিরুদ্ধে আর কোন যুদ্ধে অংশ নেবেন না, এমন শর্তে সুলতান মুরাদের সাথে সন্ধি চুক্তি করে নিজেকে ও তার পরিবারকে তুর্কি হেরেমের দাসত্ব করার হাত থেকে রক্ষা করেন।

যুদ্ধ থেমে গেলে সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। বিজিত মুসলমান সৈন্যরা অনেকে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সার্বিয়ার সাধারণ খৃষ্টান জনগণ ইসলাম ও মুসলমানদের জীবন যাপনকে খুব কাছ থেকে দেখা ও জানার সুযোগ পায়। মুসলমানদের জীবন যাপন, বোধ-বিশ্বাস আর সংষ্কৃতির প্রভাব অনিবার্যভাবেই সার্বিয় জনমানসে পড়তে শুরু করে।

এর ফল ফলতে দেরি হয়নি। কয়েক মাসের মধ্যে সার্বিয় রাজা স্টিফেন তার বোন লেডি ডেসপিনা’সহ ইসলামের সরলতায় মুগ্ধ, বিমোহিত ও আকর্ষিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। কিছুদিন পর রাজা স্টিফেন নিজের সেই বোন লেডি ডেসপিনাকে তুর্কি শাহজাদা বায়েজিদের সাথে বিয়েও দেন। নওমুসলিম দুই ভাই বোন; রাজা স্টিফেন ও লেডি ডেসপিনা নতুন ধর্মবিশ্বাসে উজ্জীবিত হয়ে নিজের জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে ইসলাম প্রচারের উদ্যোগ নিলে সহসাই আশাতীত ফলও ফলতে শুরু করে। সার্বিয়ার একটি উল্লেখযোগ্য সংখক খৃষ্টান জনগোষ্ঠী ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়।

এরকম অবস্থা দেখে মাত্র তিন বছর পরেই পোপ নবম বোনিফেস ১৩৯৪ সালে পূনরায় ইসলামের বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষণা করেন এবং রাজা স্টিফেনকে মুসলমানদের সাথে, তথা, সুলতান মুরাদের সাথে চুক্তি বাতিল করতে নির্দেশ দেন। তিনি ভ্যাটিকান থেকে ফতোয়া জারি করে বলেন; প্রভূ যীশুকে অস্বীকারকারী গোষ্ঠীর সাথে ‘চুক্তিলংঘন’ করলে পাপ হয় না।
কিন্তু ইতোমধ্যেই ইসলাম গ্রহণকারী রাজা স্টিফেন পোপের এ নির্দেশ মানতে অস্বীকার করলে পোপের নির্দেশ ও উস্কানিতে সার্বিয়ার খৃষ্টান বাহিনীর একটা অংশ ও অধিকাংশ খৃষ্টান জনগণই মুসলিম রাজা স্টিফেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়ে। খবর পেয়ে তুর্কি সুলতান মুরাদ আবারও রাজা স্টিফেনকে সাহায্যের জন্য সৈন্য প্রেরণ করেন।

মুসলিম সেনাবাহিনী আবারও ভীষণ যুদ্ধের পর বিদ্রোহী খৃষ্টান বাহিনীকে কোণঠাসা করলে তারা সন্ধির প্রস্তাব দেয় এবং যুদ্ধবিরতির শর্ত নিয়ে আলাপ করতে এক প্রতিনিধিদল পাঠায় রাজা স্টিফেনের কাছে। উক্ত প্রতিনিধি দলে মিশেল নামে এক সৈনিকও ছিল। মিশেল যথাযথ প্রস্তুতি ও জামার আস্তিনের নীচে লুকিয়ে অস্ত্র এনেছিল রাজা স্টিফেনের কাছে, তার দৃষ্টিতে ‘বিশ্বাসঘাতক’ ও ‘ধর্মদ্রোহী’ রাজা স্টিফেনকে হত্যা করার জন্য।

আলোচনার এক পর্যায়ে সেই মিশেল রাজা স্টিফেনকে আক্রমণ করে বসলে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। তাৎক্ষণিকভাবে রাজার দেহরক্ষীরা মিশেলকে বন্দী করে। কয়েকদিন পরে ঐ ক্ষতের কারণে রাজা স্টিফেন ইন্তেকাল করেন। আদালতে বিচারের মাধ্যমে রাজাকে হত্যার কারণে মিশেলকেও প্রাণদন্ডে দন্ডিত করা হলে তা কার্যকর করা হয় যথাসময়ে।

সার্বিয়ার খৃষ্টানরা এ ইতিহাস কখনোই ভুলেনি। সেই থেকেই মিশেল তাদের জাতিয় বীর। ঘটনার প্রায় ছয়শত বছর পরে (১৯৯৫) এসে স্থানীয় রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে তারা যখন বসনিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার বিরুদ্ধে মাঠে নামে, তখন সেই ছয়শত বছর পুরোনো ক্ষোভ আর স্মৃতি উথলে উঠে। সার্বিয়ার রাষ্ট্রীয় নীতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে একটা ছাঁচ দেয় সেই ঘটনা। তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সমস্ত আক্রোশ ও ক্ষোভ নিয়ে মাঠে নেমে আসে। মিশেলের আত্মদানের ঘটনায়কে স্মরণে রেখে গঠন করে উগ্রখৃষ্টবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন; মিশেল ফোর্স। সন্ত্রাসী এই বাহিনী ছিল এক নৃশংস রক্তপিপাসু ঘাতকবাহিনী।

এই মিশেল ফোর্সই সার্ব সমাজে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নিরন্তর ঘৃণা ছড়িয়েছে। সরকার ও সমাজকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়েছে বছরের পর বছর ধরে। দেশের সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আরও একটা বাহিনী গঠন করে সরকার, প্রশাসন, এমনকি, সেনাবাহিনীর মধ্যেও নিজেদের উগ্র মতবাদ প্রচার করে বহু সেনাকে নিজেদের আদর্শে উজ্জীবিত করে মুসলিম নিধনে ঠেলে দিয়েছে। তারপরের ইতিহাস তো আমরা বিশ্বাসী নিজেদের চোখেই দেখেছি। খোদ জাতিসংঘের নাকের ডগায় জাতিনীধন। লক্ষ্য প্রাণের বর্বরতম অপচয়।

আজ আফগানিস্থানে পট পরিবর্তন, আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা বাহিনীর পলায়নের পর আফগানদের একাংশ যখন বিশ্বের নানা দেশ অভিমূখে যাত্রা করেছে, করছে ঠিক তখন পোল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া লিথুনিয়া এবং অষ্ট্রিয়া’সহ কিছু কিছু দেশ আগে ভাগেই তাদের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া তুলছে! (সুত্র: ইউরোনিউজ, ২৩শে আগস্ট, ২০২১)

এই যে ফরেন পলিসি, এই যে মুসলিম আতংক, ইসলামোফোবিয়া ইসলাম বিদ্বেষ, এর শেকড় রয়েছে দীর্ঘ ছয়শত বসরের ওসমানীয় শাসনের মধ্যে। তুর্কি ওসমানীয় খেলাফতই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আধুনিক ইউরোপের মন ও মানস গড়ে দিয়েছে, গড়ে দিয়েছে তাদের ভৌগলিক ও নৃতাত্তি¡ক পরিচিতও।

এই বিষয়টা নিয়েই কোন মুসলিম লেখক চিন্তক কি আজ পর্যন্ত কোন হবেষণা করেছেন? আমার জানা নেই। মনে হয় কোন মুসলমান লেখক সাহিত্যিকের সে সময়টুকু হয়নি। তবে এটা হওয়া প্রয়োজন নিজেদের স্বার্থেই। ইউরোপীয় সরকার ও সমাজ, তাদের ভবিষ্যত কর্মকান্ড, কুটনীতি, পররাষ্ট্রনীতির বুনিয়াদি ভিত্তি জানা বুঝার কিংবা চেনার স্বার্থেই। কাজটা করতে কোন মুসলমান লেখক গবেষক কি এগিয়ে আসবেন না?

আরও পড়ুন