Ads

তাজমহল ও শাহজাহানের ‘পাষণ্ডতা’!

।। মোহাম্মদ সলিমুল্লাহ ।। 

প্রতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি এলেই কিছু লোক তাজমহল নির্মাণে ‘শাহজাহানের পাশবিকতা’ খুঁজে পান! ফেসবুকে তাদের পোস্টে সম্রাট শাহজাহানকে মোটামুটি ১০টি অভিযোগ দেওয়া হয়। যেমন-
(ক) “১৪ বছরের ইরানী কিশোরী মমতাজের দৈহিক সৌন্দর্য্য শাহজাহানকে বিমোহিত করেছিল। তাই তিনি এ কিশোরীর সাথে বাগদান সম্পন্ন করেন”।
(খ) “তাকে ঝুলিয়ে রেখে শাহজাহান আরেক নারীকে বিয়ে করেন”।
(গ) “১৬১৭ সালে তিনি আরো এক নারীকে বিয়ে করেন মমতাজসহ দুই স্ত্রী ঘরে থাকা সত্ত্বেও”।
(ঘ) “শাহজাহান মমতাজের মৃত্যুকে ডেকে এনেছিলেন বোধহীনের মতো এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। গর্ভবতী মমতাজকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যুদ্ধযাত্রা করেন”।
(ঙ) “২০,০০০ শ্রমিক ও কারিগর তাজমহল নির্মাণে দাস- দাসীদের মতো ব্যবহৃত হয়েছিল। তাজমহল নির্মাণ শেষে কারিগরদের হাতের আঙ্গুল কেটে দেয়া হয়”।
(চ) “তাজমহল নির্মাণে তাত্ত্বিক হিসাব অনুযায়ী বর্তমানের ১০৪.৮ বিলিয়ন রুপি বা ১৬৫৪ মিলিয়ন ইউএস ডলার, অর্থাৎ ১২,৮৫৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল”।
(ছ) “পুরো টাকাটাই ছিল সাধারণ মানুষের রক্ত চুষে আদায় করা খাজনা। অনুৎপাদনশীল খাতে এ বিশাল পরিমান অর্থ খরচ করা আর সেই অর্থ আদায় করতে গিয়ে জনগণের উপর চালানো অত্যাচারের কুফল হিসেবে তাজমহল নির্মাণের কিছুদিনের মধ্যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়”।
(জ) “মুঘল পরিবারের মেয়েদেরকে বিয়ে করতে দেয়া হতো না”।
(ঝ) “জাহানারা যার প্রেমে পড়েছিলেন……। বিদূষী জাহানারা প্রেমে অটল ছিলেন। তাঁর প্রেমিক লুকিয়ে তাঁর সাথে দেখা করতে আসতো। মেয়ের চোখের সামনেই সেই প্রেমিককে তক্তা দিয়ে দেয়ালের সাথে আটকে পেরেক গেঁথে গেঁথে খুন করেন শাহজাহান”।
(ঞ) “শাহজাহান নিজের ভাইদের খুন করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন”।
পোস্টে শাহজাহানকে সাধারণত এই অভিযোগগুলো দেওয়া হয়। সাথে কিছু আবেগী আলোচনা করে তাঁকে প্রেমহীন পাষণ্ড হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। আমরা দেখি- মূল ব্যাপারটা কী! প্রতিটি অভিযোগের দফাওয়ারি বিশ্লেষণ-

 

(ক) ইরানি বংশোদ্ভূত আর্জুমান্দ বানু (মমতাজ) ছিলেন মুঘল সম্রাজ্ঞী নূর জাহানের আপন ভাতিজি এবং তার বাবা আসাফ খান ছিলেন মুঘল মুখ্যমন্ত্রী। অর্থাৎ, মমতাজকে শ্রেফ ‘ইরানি কিশোরী’ বলে চালিয়ে দেওয়া চলে না।
অন্যদিকে, শাহজাহান রাজপুত্র হয়েও বিবাহ না করা পর্যন্ত রাজপদে অভিষিক্তের উপযুক্ত হতে পারছিলেন না। তাই, পারিবারিক পছন্দেই ১৩ বছরের আর্জুমান্দ’র সাথে ১৫ বছরের শাহজাহানের বাগদান সম্পন্ন হয়। এতে করে তিনি ৮ হাজারী মনসবে অধিষ্ঠিত হন। এর ৫ বছর পর শাহজাহান তাঁকে ঘরে তুলে নেন।

 

(খ) মির্জা সাফাভী মুঘলদের সাথে শত্রুতার অবসান ও মৈত্রী স্থাপনের লক্ষ্যে রাজপুত্রের সাথে নিজ কন্যার বিবাহের (কূটনৈতিক) প্রস্তাব পাঠান। জাহাঙ্গীর শাহজাহানকে প্রস্তাব করলে তিনি মমতাজের সাথে বাগদানের কথা উল্লেখ করে তা প্রত্যাখ্যান করেন। পরে, জাহাঙ্গীর তাঁকে বাধ্য করেন বিবি কান্দাহারী’কে বিবাহ করতে, যা জাহাঙ্গীর নিজ জীবনীতে (তুজুক-ই জাহাঙ্গীরী) উল্লেখ করেছেন।

 

(গ) দক্ষিণাত্য বিজয়ের পর ইজ্জুন্নিসা’র দাদাকে সেখানকার গভর্নর ও পিতাকে সেনাপতি নিয়োগ করা হয়। তাঁরা সম্রাটের বিশ্বস্ততা অর্জনের লক্ষ্যে রাজপুত্রের সাথে কন্যার বিবাহের প্রস্তাব করেন। দক্ষিণাত্য বিজয় করেছিলেন এই শাহজাহান-ই। এবারও জাহাঙ্গীর শাহজাহানকে বাধ্য করেন ইজ্জুন্নিসা’কে বিবাহ করতে।

 

(ঘ) মমতাজ ও শাহজাহানের মধ্যে এতটাই গভীর প্রণয় ছিল যে, তারা কখনই একে অপরকে ছেড়ে থাকতেন না। মমতাজ তাঁর জীবদ্দশায় শাহজাহানের একেবারে সকল যুদ্ধাভিযানে সঙ্গীনী হয়েছিলেন। এটাকে বোধহীনতা বলা যেতে পারে, কিন্তু তা শাহজাহানের একক নয়, প্রেমে দিওয়ানা যুবক-যুবতী স্বামী-স্ত্রীর।

 

(ঙ) শ্রমিক- কারিগরদেরকে দাস-দাসীর মতো ব্যবহার এবং নির্মাণ শেষে আঙ্গুল কেটে দেওয়ার বিষয়টি নিরপেক্ষ ইতিহাস তো দূরে থাক, কোন নিন্দুক বা পক্ষপাতদুষ্ট ঐতিহাসিকও লেখেননি। এটা তো কোন পৌরাণিক কাহিনী নয়; মাত্র ৩৬৭ বছর পূর্বের ইতিহাস। ঐকালের প্রতিটি দিন-ঘটনার বিবরণ পাওয়া যাবে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। আপনি যা ইচ্ছা তা লিখতে পারেন; তা উপন্যাস (যেমন- বিষাদ সিন্ধু) হতে পারে, তবে ইতিহাস নয় (যেমন-রাজসিংহ)।

 

(চ) তাজমহলের তৎকালীন আর্থিক মূল্য ছিল ৩২ মিলিয়ন রুপি, যা উইকি’র ২০১৫ সালের তথ্য মতে ৫২.৮ বিলিয়ন রুপি ও ৬২৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় ৬৬ বিলিয়ন হওয়ার কথা। এই পূর্ণ অর্থ রাজকোষ থেকে ব্যয়িত হয়নি। ইতিহাস বলছে- শ্বেত স্ফটিক রাজস্থান, চুনি পাঞ্জাব, পান্না ও স্ফটিক চীন, ফিরোজা তিব্বত, নীলকান্ত আফগানিস্তান, শ্বেতকান্ত শ্রীলঙ্কা ও রক্তচুনি আরবদেশ থেকে এসেছিল, অধিকাংশই উপঢৌকন হিসেবে।

 

(ছ) তাজমহল নির্মাণে জনগণের উপর নতুন করারোপ করার তথ্যও মিথ্যাচার। আর, তাজমহল-উত্তর মোঘল সম্রাজ্যে কখনই দূর্ভিক্ষ দেখা দেয়নি। বরং ইতিহাস হচ্ছে- পরপর ৩টি ফসলী পর্ব অনাবৃষ্টিতে মারা যাওয়ায় ১৬৩০ সালে চরম দূর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। শাহজাহান সারা দেশে লঙ্গরখানা খুলে জনগণকে খাওয়াতে থাকেন। কিন্তু ফসল উৎপাদন না হওয়ায় অর্থ থাকলেও খাদ্যের অপ্রতুলতায় বিপুল মানুষ অনাহারে মারা যায়। এটা তাজমহল নির্মাণ শুরুর বেশ আগের ঘটনা।

 

(জ) “মুঘল মেয়েদেরকে বিয়ে করতে দেয়া হতো না”- এটাও নির্জলা মিথ্যাচার। মুঘল রাজরমণীগণের মধ্যে কেবল পরমা বিদুষী জাহানারা ও কোরআনের হাফেজ জেবুন্নিসা বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে অবিবাহিত ছিলেন। অপর কেউ অবিবাহিত ছিলেন বা বিয়ে করতে দেওয়া হয়নি- এমনটি ইতিহাসে পাওয়া যায়নি।

 

(ঝ) মমতাজের মৃত্যুতে পাগলপ্রায় শাহজাহান এক বছরকাল জনসমক্ষে বের হননি। এ সময়ে তিনি প্যারালাইজড হয়ে যান এবং তার সব চুল পেকে যায়। মহীয়সী জাহানারা নিজ বিবাহের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে পিতৃসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। দেখুন- তিনি বেশকিছু বইয়ের লেখিকা এবং অসংখ্য কাব্যের রচয়িতা; নিজ মালিকানাধীন জাহাজে বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনা করতেন। জনহিতৈষী কাজে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে যেতেন। মমতাজের মৃত্যুর পর তিনিই পিতার রাজ্য পরিচালনা করতেন।

 

(ঞ) শাহজাহান নিজ ভাইদের খুন করে ক্ষমতা দখল করেননি, সত্যটা হচ্ছে- ক্ষমতায় বসার পর তাঁর বিমাতা নূর জাহানের সাথে তাঁর দূর্নিবার দ্বন্দে রাজপরিবারের বেশকিছু সদস্য নিহত হন।

 

পাঠক, খেয়াল করবেন- শাহজাহানের স্থাপত্য নিদর্শন শুধু তাজমহল নয়, দিল্লীর লাল দূর্গ, দিল্লী জামে মসজিদ (যা অদ্যাবধি উপমহাদেশের মুসলিমদের নির্দেশনার কেন্দ্রভূমি), ওয়াজির খান মসজিদ, মতি মসজিদ, শালিমার বাগ, লাহোর দূর্গ, পেশোয়ারের মহাব্বাত খান মসজিদ, জাহাঙ্গীরের দরগা, শাহজাহান মসজিদ- ইত্যাদি প্রতিটি বিশাল বিশাল একেকটি নির্মাণ কর্ম। তবে হ্যাঁ, মমতাজের মৃত্যুর পর আমৃত্যু তাঁর মধ্যে মানসিক অস্থিরতা ও বিকৃতি দেখা দিয়েছিল।

 

লেখকঃ কলাম লেখক ও  জয়েন্ট ডিরেক্টর, বাংলাদেশ ব্যাংক 

 

লেখকের আরও লেখা পড়ুন-  মানসুরা যুদ্ধ-১২৫০: যে যুদ্ধে মুসলিম সেনাপতি ছিলেন নারী

 

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ, পরিবার ও নিজেকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য নানা ধরণের

আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi এ লাইক দিন  এবং

আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন ।

আরও পড়ুন