Ads

দু:খ কেবল এটুকুই যে…..

।। জিয়াউল হক ।।

 

একাদশ শতাব্দির স্পেন। সঠিক হিসেবে বলতে হলে বলতে হয় মুসলিমদের কাছে আল আন্দালুস হিসেবেই পরিচিত। তারিক বিন জিয়াদের মাধ্যমে ৭১১ খৃষ্টাবদে শুরু যে অভিযান, তা‘ই শেষ হয়েছে ৭৫২ খৃষ্টাব্দের দিকে আব্দুর রহমানের মাধ্যমে, তার সাহসী, কঠোর ও কুশলী অভিযানের মাধ্যমে। মাঝখানে একটানা একচল্লিশ বসর বহু রক্ত, বহু ত্যাগ আর তিতিক্ষার ইতিহাস। রুক্ষ পাথুরে, অনুর্বর ও শতধা বিভক্ত ও হানাহানিতে জর্জরিত স্পেনের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত হলো খেলাফত।
উমাইয়্যা খেলাফত। স্পেন হয়ে উঠলো বিশ্বের বিষ্ময়, আল আন্দালুস।

 

যে ভুখন্ডের মাত্র পঁয়ত্রিশ ভাগ আবাদ যোগ্য, বাঁকি সব পাথুরে পাহাড় আর অনাবাদী, সেই ভুখন্ডই কিনা দেখতে দেখতে মাত্র কয়েকটি দশকের মধ্যে হয়ে উঠলো বিশ্বের বিস্ময়! ভারত ও বাগদাদের পরে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী এলাকা। জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে বিশ্বে বাগদাদ ও দামেশকের সমকক্ষ্য, কোন কোন বিচারে তাদের চেয়েও উঁচু স্তরের কেন্দ্র! কুরআন, হাদিস, দর্শন আর ফিকাহ চর্চার এক অনন্য তীর্থস্থান!

 

এটা মুসলমানদের জন্য গর্বের আর গৌরবের বিষয় বটে। তবে এর পাশাপাশি এই স্পেন-ই তাদের জন্য লজ্জা আর অনুশোচনা, কলঙ্ক আর কালীমার, অনুপাত আর অনুশোচনার উপলক্ষ্যও বটে।
তারিক, প্রথম ও দ্বিতীয় আব্দুর রহমান সহ শত শত মুসলিম জানবাজ তাদের ত্যাগ আর বীরত্ব দিয়ে যে আন্দালুসকে গড়ে দিয়েছেন, সেই আন্দালুসকেই পরবর্তি মুসলিম শাসকরা নিজেদের ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও প্রভাবের কারণে, নিজেদের ভোগ আর বিলাসের জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কোন মুল্যে খলিফার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে বংশীয় বা গোত্রীয় সহায়তা নিয়ে।
এমনটা ঘটেছে বা এমনটা ঘটা শুরু হয়েছে বিশেষ করে, উমাইয়্যা খলিফা হিশামের পক্ষে মুহাম্মদ ইবনে আবি আমের-এর শাসনকালের পরে। তার দীর্ঘ সাতাশ বসরের শাসনকাল ছিল এক গৌরবোজ্জল অধ্যায় আন্দালুসের ইতিহাসে। উত্তর দিকে ফ্রান্সের সীমান্ত এবং পশ্চিম দিকে আটলান্টিকের তীর ঘেঁষে ছোট খাটো যে দু‘একটা খৃষ্টান রাজ্য তখনও টিকে ছিল কোনমতে, তাদের হৃদয়ে কাঁপন তুলেছিলেন এই মহান ব্যক্তি।

 

কিন্তু একাদশ শতাব্দির একেবারে শুরুর দিকে (১০০২ খৃষ্টাব্দে) তার মৃত্যুর পর পরই চিত্রপট বদলে যায়। গোত্রে গোত্রে যেমন দ্বন্দ শুরু হয়ে যায়, তেমনি প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের হাত ধরে ক্ষমতার জন্য পিতা-পুত্র, ভাই-ভাই, পরিবারের এক সদস্যের সাথে অপর সদস্যের দ্বন্দ শুরু হয়। দেখতে দেখতে তা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে।

 

এক ভাই তার অপর ভাইকে ক্ষমতার দৃশপট থেকে সরিয়ে দিতে সহায়তা প্রার্থনা করেছে পার্শ্ববর্তি খৃষ্টান শাসক ও ভুস্বামীদের! আর চাতক পাখীর মত অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকা খৃষ্টান শাসকরা এ সুযোগে বন্ধু (!) মুসলমান খলিফা কিংবা সুলতান কিংবা ক্ষমতাবঞ্চিত যুবরাজদের সাহায্য করার জন্য দু‘বাহু বাড়িয়ে এগিয়ে আসে।
ক্ষমতার স্বাদ না পাওয়া বা যথাযথভাবে ভোগ করতে না পারার আক্ষেপে ফুঁসতে থাকা এইসব যুবরাজরা বন্ধু খৃষ্টানদের সাহায্য-সহযোগীতা, পরামর্শ, উৎসাহ ও রসদ নিয়ে সোল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিজ পিতা বা চাচা বা ভাই এর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে!
খেলাফতের আনুগত্য থেকে বেরিয়ে এসে রাজ্যের দূরবর্তি সীমান্ত এলাকায় যৎ সামান্য ভুমি নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে আরও একটা সালতানাত (!) আরও একটা হুকুমাত (!) প্রতিষ্ঠা করেছে যে সামান্য ভুখন্ড তাদের হাতে ছিল বা যেটুকু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে বা রাখতে পেরেছে, সেটুকুকে কেন্দ্র করেই। এভাবে স্পেন, তথা মুসলিম আন্দালুস এক এক করে তেইশটা ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
এসব রাজ্যের কোনটই নিজেদের শক্তি ও সামর্থের উপরে ভিত্তি করে টিকে থাকার মত সক্ষমতা ছিল না। তাদের না ছিল পর্যাপ্ত ভুসম্পদ আর না ছিল শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি। গণভিত্তির তো প্রশ্নই ওঠে না। এসব রাজ্যের মহামান্য (!) সুলতান আর আমিররা নিজেদের বাবা বা ভাই এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বেরিয়ে এসেছে, কাজেই তারা নিজেরাও নিজেদের ভাই-ব্রাদার, সন্তান, এমনকি, আত্মীয় স্বজনদের দেখেছে প্রতিদ্বন্দী হিসেবে! কেউ কাউকে বিশ্বাস করেনি একটা মহুর্তের জন্য! নিজ ঘরেই যেন একে অপরের বিরুদ্ধে সারাক্ষণ ফন্দি আঁটতে ব্যস্ত থেকেছে।
এরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য, রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য খৃষ্টান মার্সিনারি সৈন্য পুষেছে জনগণের ট্যাক্সের টাকায়। পার্শ্ববর্তি ছোট ছোট খৃষ্টান রাজা, যারা মাত্র কিছুদিন আগেও তারিক বা আব্দুর রহমান কিংবা ইউসুফ বিন তাশফিনের নাম শোনামাত্রই ভয়ে, আতংকে কাপড় ভিজিয়ে ফেলেছে, সেই সব খৃষ্টান রাজাদেরকেই নিজেদের রক্ষক ও বন্ধু হিসেবে মেনে নিয়ে চুক্তি করেছে।
এইসব মহামান্য সুলতান আর আমিরগণ (!) বসরের পর বসর ধরে পার্শ্ববর্তি খৃষ্টান রাজা রাজড়াদেরকে বাৎসরিক কর দিয়ে এসেছে কেবলমাত্র এই কারণে যে, কোন মুসলমান রাজ্য দ্বারা আক্রান্ত হলে এইসব খৃষ্টান রাজারা তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে সামরিক সহায়তা নিয়ে, সৈন্য ও রসদ জোগাবে, তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করবে!
মজার বিষয় হলো, এই সব রাজ্যের খলিফা বা সুলতান বা আমিরগণ সকলেই ধর্মবিশ্বাসে ছিলেন মুসলমান। তার পরেও তারা একে অপরের গলা কাটতে ব্যস্ত থেকেছে সোল্লাসে কেবলমাত্র ক্ষমতার লোভে। এদের বেশির ভাগ নেতাদের কাছেই বৃহত্তর মুসলিম স্বার্থের চেয়ে নিজেদের পরিবার বা বংশ বা গোত্রের স্বার্থই ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও মহার্ঘ।
তার প্রমাণ আমরা দেখতে পাই খলিফা মুসতাঈন কর্ডোভা আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নেবার সময় গোপনে খৃষ্টান রাজা ইবন আলফানসোর নিকট তার দূত পাঠাচ্ছেন সাহায্যের আবেদন নিয়ে।

 

অপরদিকে ঐ একই সময় তার প্রতিপক্ষ মুসলিম সুলতান মাহদিও গোপনে সাহায্যের আবেদন করছেন, সাথে সাথে তিনি খৃষ্টান রাজাকে আশ্বাস দিচ্ছেন, যদি তারা খলিফা মুসতাঈনের বিরুদ্ধে তাকে সাহায্য করে, তা হলে যুদ্ধ জয়ের পরে খলিফা তার রাজ্যের সীমান্ত সংলগ্ন মুসলিম দূর্গগুলো খৃষ্টান রাজাকে হস্তান্তর করবেন কৃতজ্ঞতা স্বরুপ!
খৃষ্টান রাজা ইবন আলফানসো এতোটা বোকা ছিলেন না, তিনি তার ধর্মবিশ্বাস ও আদর্শের প্রতি নিষ্ঠাবান ছিলেন বলেই ব্যক্তিগত লাভ লোকসানের বিপরিতে নিজের আদর্শের তথা খৃষ্টবাদের লাভ লোকসানের হিসাব নিকাশ করে দূর্বল মাহদির পরিবতে শক্তিশালী মুসতাঈনকেই সাহায্য করার স্বিদ্ধান্ত নিলেন।
ইবন আলফানসো কালক্ষেপণ না করে এক হাজার ষাঁড়, পনোরা হাজার ছাগল এবং অস্ত্রসহ কয়েক হাজার খৃষ্টান সৈন্য পাঠালেন বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে। ভবিষ্যৎ রাজনীতির ক্ষেত্রে খৃষ্টান রাজার জন্য এটা ছিল এক যুগান্তকারী স্বিদ্ধান্ত।

 

এ হঠকাতিরার মুল্য কেবল একা মাহদিই দেননি, এর মুল্য দিতে হয়েছে মুসতাঈনকেও, বিজয়ী হবার পরেও। বস্তুত তাদের উভয়কেই এক চরম মূল্য দিতে হয়েছে। মুসতাঈন ও ইবন আলফানসোর যৌথ আক্রমণের মুখে মাহদি পরাস্থ হয়েছেন। খৃষ্টান রাজার সাহায্যে যুদ্ধে জয়ী হয়েও জয়ী হতে পারলো না মুসতাঈন! প্রতিপক্ষ মাহদি পরাজিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মুসতাঈনও জয়ী হতে পারেনি।
লেখকের আরও গুরুত্বপূর্ণ লেখা পড়ুন-ফিলিস্তিন বিবাদে আরব নেতৃত্ব, ইতিহাসের এক ঝলক
চরম মুল্য দিতে হয়েছে। করুণ, শোচনীয় ও লজ্জাস্কর পরিণতি মেনে নিতে হয়েছে তাকে। মুসলিম বন্ধু মুসতাঈনের সাহায্যে এগিয়ে আসা খৃষ্টান রাজা ইবন আলফনকোর পরিকল্পনা ছিল অন্যরকম। তিনি তার জেনারেলদের নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন তার সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য।
যুদ্ধের পরে বিজয়ী খলিফা মুসতাঈনের সহযোগী হিসেবে প্রবেশ করার পরে খৃষ্টান সৈন্যরা প্রথম যে কাজটি করে, তা হলো, তারা খলিফা মুসতাঈনের চোখের সামনে কর্ডোভার মুসলমানদের উপরে নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। তারা বেছে বেছে কর্ডোভার শত শত আলেমকে খুঁজে খুঁজে বের করে হত্যা করে! কর্ডোভার বুদ্ধিজীবি হত্যা!
খলিফা মুসতাঈন নিজ চোখের সামনে খৃষ্টান সৈন্যদের দ্বারা মুসলমান জনগোষ্ঠীর উপরে এমন বর্বরতা দেখেও মুখ খুলতে পারলেন না! যে খৃষ্টান বন্ধুরা তাকে কর্ডোভা জয় করতে সাহায্য করেছে, পাছে সেই বন্ধুরা না আবার অসন্তুষ্ঠ হয়ে পড়ে, এ ভয়ে!

 

জ্ঞান বিজ্ঞানের লীলাভুমি কর্ডোভার উপরে এ বর্বরতার মাধ্যমে তথা মুসলিম স্কলারদের হত্যার মাধ্যমে খৃষ্টান রাজা কর্ডোভার বুদ্ধিবৃত্তিক রক্ষাকবচটা ভেংগে দিয়ে তার নিজ রাজ্যে ফেরত যান। খলিফা মুসতাঈন কর্ডোভার শাসনভার ফিরে পেলেন।

 

পেলেন বটে। তবে এ কর্ডোভা সে কর্ডোভা নয়। একটি রাজ্যের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ, তার বুদ্ধিজীবি সমাজ, রাজ্যের আলেম ওলামা শুন্য কর্ডোভা। এরকম একটা রাজ্য যেখানে জ্ঞানী-গুণী নেই, যেখানে আলেম-ওলামা নেই, সেরকম কর্ডোভা স্বাভাকিভাবেই এক চরম বিশৃংখলার মধ্যে নিপতিত হলো। মাত্র কয়েকটি দশকের মধ্যেই কর্ডোভা তার স্বাধীনতা হারাতে বাধ্য হলো।

 

সেই একই পথ আজও ইসলাম বিদ্বেষী গোষ্ঠী মুসলিম দেশসমূহে অবলম্বন করে চলেছে। মুসলমানদের মধ্যে মজহাবি বিতর্ক, বা যে কোন ছল ছুতায় অনৈক্য, অবিশ্বাস উস্কে দিয়ে তারা এক পক্ষের বন্ধু সাজে অপরপক্ষের বিরুদ্ধে সাহায্য করার জন্য। এ ভাবে তারা আসলে মুসলমানদের উভয় পক্ষকেই দূর্বল করার মাধ্যমে রাষ্ট্রের মৌলিক নিরাপত্তাকেই দূর্বল করে দেয়।
দু:খ কেবল এটুকুই যে, দু:খজনক এ ইতিহাস সামনে থাকা সত্তেও মুসলিম সমাজ সে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না।
লেখকঃ ইংল‍্যান্ডের বেসরকারী মানসিক হাসপাতালের সাবেক সহকারী পরিচালক ও লেখক, ইংল‍্যান্ড

 

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়ন মূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi এ লাইক দিন।

এবং প্রিয় লেখক ! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected]

প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন ।

আরও পড়ুন