Ads

বাংলার ইতিহাসে গৌরবান্বিত ইসলাম

ড. সাজেদা হোমায়রা

বাংলায় মুসলিম জাতির রয়েছে গৌরবময় অতীত ইতিহাস। মুসলিমরা অতীতে এই সমগ্র এলাকায় সাড়ে ৬০০ বছর রাজত্ব করেছে যার ফলশ্রুতিতে আজ এদেশে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। এদের সমাজ সংস্কৃতি সাহিত্য লোকাচার ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ইসলাম এর প্রচন্ড প্রভাব বিদ্যমান। ক্ষমতার পালাবদলের সাথে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী শাসকরা এ দেশের শাসন করেছে কিন্তু এতে বাংলার মুসলিমদের ইসলামী মূল্যবোধ কখনোই কমেনি।

রাসূল সা. এর পরবর্তীকালে তাঁর সুশিক্ষিত সাহাবা তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ীগণ ইসলামের সত্য জীবন বিধান ও সমাজ ব্যবস্থার বাণী নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। এ সময় আরবরা ব্যবসা-বাণিজ্যে ছিলো খুব উন্নত। তাদের বাণিজ্য বহর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করতো। মুসলিম বণিকদের সাহায্যে সপ্তম শতকের প্রথম দিকে ভারতের পশ্চিম উপকূলে মালাবার রাজ্যে ইসলাম প্রচার শুরু হয়।

৭১২ খৃষ্টাব্দে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ইরাকের গভর্নর নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি ১৭ বছরের যুবক মুহাম্মদ বিন কাসিম কে সেনাপতি করে সিন্ধু অভিযানে পাঠান এবং মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে এ সিন্ধু বিজয় ছিলো ইসলামের বিরাট রাজনৈতিক বিজয়। ফলে ৮ম শতকের মধ্যই সিন্ধু ও পাঞ্জাবের বিভিন্ন এলাকায় মুসলিমদের উপনিবেশ ও বসতি গড়ে ওঠে।

বাংলায় ইসলাম প্রচারের ইতিহাসে একাদশ থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত সাতশো বছর একটি চিহ্নিত সময়কাল। এসময় বাংলার চারিদিকে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে।

একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকে সুফি, আলেম ও মুজাহিদদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত ভাবে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলায় আসেন। তাদের ইসলাম প্রচারের ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়।

১২০৩ খৃষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বাংলা বিজয়ের ফলে এদেশে মুসলিমদের সর্বপ্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভ হয়। এসময় অব্যাহত গতিতে ভারতের পশ্চিমাঞ্চল, আফগানিস্তান, ইরান, আরব ও তুরস্ক থেকে অসংখ্য মুসলিম বাংলায় আসেন। ফলে বাংলায় মুসলিমদের সংখ্যা হয়ে পড়েছিল ক্রমবর্ধমান।

১৬ শতকের শুরু থেকে ১৯ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্যের শাসন চলে। তাদের সাম্রাজ্য মূলত আধুনিক ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ নিয়ে গঠিত ছিল। মোঘল শাসকদের কিছু অনৈসলামিক কার্যকলাপ বাংলার মুসলিম শ্রেণীকে চরম বিভ্রান্তির দিকে নিয়ে যায়। তবে ১৭ শতকের শেষার্ধে বাদশা আওরঙ্গজেব কিছু সংস্কারমূলক কাজ করেন যার ফলে ইসলাম ও মুসলিম সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়।

১৮ শতকে উপমহাদেশের কেন্দ্র ও গুরুত্বপূর্ণ শহর দিল্লিতে আবির্ভাব হয় শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবীর। তিনি প্রথমে মুসলিমদের চিন্তা সংশোধন ও পরিশুদ্ধির কাজে হাত দেন। এরপর তিনি ইসলামিক জ্ঞান ও চিন্তার পুনর্গঠন এর কাজে অগ্রসর হন। তার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তার লিখিত বই গুলো বাংলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। চিন্তার ক্ষেত্রে তিনি যে বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন তার ভিত্তিতেই ১৯ শতকের প্রথম দিকে দুটি ইসলামী আন্দোলনের উদ্ভব হয়। এর একটি পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী পরিচালিত ‘তরিকা-ই-মোহাম্মাদিয়া আন্দোলন। আর অপর আন্দোলনটির সৃষ্টি এ বাংলাদেশেই। এটি ফরায়েজী আন্দোলন নামে খ্যাত। ফরিদপুরের হাজী শরীয়তুল্লাহ ও তার পুত্র দুদু মিয়া ছিলেন এ আন্দোলনের পরিচালক। বাংলার মুসলিমদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও ব্যবহারিক জীবনকে কুরআন ও সুন্নাহর আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এ আন্দোলন দুটি সফল ভূমিকা পালন করে।

হাজী শরীয়তুল্লাহর সমসাময়িক ছিলেন শহীদ তিতুমীর। তিনিও অধঃপতিত মুসলিম সমাজে সংস্কার আন্দোলন করেন। জমিদার নীলকরদের অত্যাচার দমনের জন্য তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং শহীদ হন।

১৯ শতকের প্রথম দিকে সমগ্র ভারতব্যাপী এক বিরাট সুসংগঠিত স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে ওঠে। এ আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল ভারতীয় মুসলিমদের দ্বারা। এ আন্দোলনের প্রাণশক্তি ছিলেন সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী রহ.। বালাকোটের প্রান্তরে এ মুক্তি আন্দোলনে মুসলমানরা চরম বিপোর্যয়ের সম্মুখীন হয় এবং ব্রেলভী শাহাদাত বরণ করেন। তবে যারা গাজী হিসেবে বেঁচে ছিলেন, তাদের কর্মতৎপরতা একটুও কমেনি। এদের অনেকেই ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে ইসলামি আন্দোলনকে জাগিয়ে রাখেন, যার পরিসমাপ্তি ঘটে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ তথা সারা ভারতব্যাপী বৃটিশ বিরোধী মুক্তি আন্দোলনে। এই বিদ্রোহ ছিল ভারতভূমিকে বৃটিশ শাসকদের গোলামির শৃংখল থেকে মুক্ত করার জন্য। এর ৯০ বছর পর ১৯৪৭ সালে ভারতীয় মুসলিমরা বৃটিশদের বিতাড়িত করে নিজস্ব আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা সংগ্রামে বিজয় লাভ করে।

মূলত এ উপমহাদেশে ইসলামি সভ্যতা সংস্কৃতির বাহক ছিলেন মুহাম্মদ বিন কাসিম। পরবর্তীতে সমগ্র ভারত উপমহাদেশে ইসলামের পতাকা উড়ে। মুসলিমরা বিভিন্ন দিক থেকে বিজয়ীর বেশে ভারতে আসতে থাকে। দীর্ঘ মুসলিম শাসনামলে ভারত উপমহাদেশে ইসলামি সভ্যতার যে ভিত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা এখনো বিদ্যমান।

লেখকঃ সাহিত্যিক, কলাম লেখক এবং সেরা মানুষ ছিলেন যারা এর লেখক

লেখকের প্রকাশিত আরও লেখা-

ইসলামে বিধবা নারীর যেমন অধিকার রয়েছে

বিয়ে বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক সভ্যতা বিলীনের মারাত্মক পদক্ষেপ

আরও পড়ুন