Ads

ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের জনক কে?

আয়েশা সিদ্দিকা

ভারতীয় চলচ্চিত্র ইতিহাসের গোড়াতেই গন্ডগোল। এ দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের জনক হীরালাল সেন নাকি দাদাসাহেব ফালকে। দাদাসাহেব ফালকেই সর্বজন স্বীকৃত। হীরালাল সেনকে কজনই বা জানে! হীরালাল সেন ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পে এক অনন্য নাম। তাঁর হাত ধরেই উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে এক নতুন দিগন্ত রচিত হয়।

১৮৯৫ সালে অগাস্ট ও লুই লুমিয়ার দুই ভাই ৪৯ সেকেন্ডের একটি ফিল্ম বানায়। বিশ্ববাসী জেনে যায় লুমিয়ার ব্রাদার্সের চলমান চিত্র আবিষ্কারের কাহিনী। লুমিয়ার ভাইদের মতো সেন ভাইরাও উপমহাদেশে চলচ্চিত্রের বীজ বপন করে।

হীরালাল সেন এর জন্ম ১৮৬৬ সালে মানিকগঞ্জ জেলার বগজুরি গ্রামে। তার পিতার নাম চন্দ্রমোহন সেন, মাতা বিধুমুখী।পিতামহ গোকুলকৃষ্ণ মুনশি ছিলেন ঢাকার জজ আদালতের নামকরা আইনজীবী। পরে তিনি কোলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসাবে যোগ দেন। পিতা মাতার আট সন্তানের মধ্যে হীরালাল ছিলেন দ্বিতীয়। মানিকগঞ্জ মাইনর স্কুলে তার শিক্ষা জীবন শুরু হয়। একই সাথে মৌলভী সাহেবের কাছে ফারসী ভাষাও শিখতেন। ১৮৭৯ সালে মাইনর পরীক্ষা পাস করে ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলে ভর্ত্তি হন। পরে পিতার সাথে হীরালাল কোলকাতা গিয়ে কলেজে ভর্ত্তি হন। আই.এস.সি. অধ্যয়ন কালে চলচ্চিত্রের প্রতি ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ায় যবনিকাপাত ঘটে।

১৮৯৮ সালে, প্যারিসের ‘পাথে ফ্রেরেস স্টুডিও’র সদস্য অধ্যপক স্টিভেনসনের একটি নাতিদীর্ঘ ছবি কলকাতার স্টার থিয়েটারে দেখানো হয়, The Flower of Persia (পারস্যের ফুল) নামে একটি অপেরার সঙ্গে।স্টিভেনসনের ক্যামেরা ধার করে নিয়ে হীরালাল বানান তার প্রথম ছবিঃ A Dancing Scene From the Opera, The Flower of Persia, ওই অপেরার একটি নাচের দৃশ্য নিয়েই। ভাই মতিলাল সেনের সাহায্যে লন্ডনের ওয়ারউইক ট্রেডিং কম্পানীর চার্লস আরবানের থেকে তিনি একটি ‘Urban Bioscope’ কিনে নেন।পরের বছর তিনি ভাইয়ের সাথে রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানীর গোড়াপত্তন করেন।

১৮৮৭- ১৮৯৮ সালের মধ্যে ফটোগ্রাফি চর্চায় শ্রেষ্টত্বের জন্য হীরালাল সাতবার স্বর্ণপদক পান। ১৯০১ সালে ক্লাসিক থিয়েটার চিত্রায়িত করে কিছু বাংলা নাটকের দৃশ্য। এর মধ্যে ছিল সীতারাম, হরিপদ,ভ্রমর, সরলা,দোলযাত্রা, বন্ধু ইত্যাদি।
১৯০১ সালে ১৩ ডিসেম্বর ব্যবসায়িকভাবে চিত্র প্রদর্শনী শুরু করে। তা দেখার জন্য আসে প্রধান বিচারপতি স্যার উইলিয়াম ম্যাকমিলান।
১৯০৩ সালে তার সৃষ্ট পূর্ণদৈর্ঘ্য আলিবাবা ও চল্লিশ চোর। কিন্তু এ ছবির ব্যাপারে বেশি কিছু জানা যায় না। হয়তো কোনোদিন এ ছবির প্রদর্শন হয় নি।

হীরালাল সেনকে উপমহাদেশের বিজ্ঞাপনের জনক বলা হয়। তাঁর তৈরী বিজ্ঞাপন চিত্র হলো এডওয়ার্ডস টনিক, জবাকুসুম হেয়ার ওয়েল। তাঁর আগে কেউ ভারতে বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরী করে নি।

উপমহাদেশে প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র তৈরী করে হীরালাল। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ প্রতিবাদ সভা ডাক দেন সেখানে হীরালাল সভার ভিডিও করেন। কলকাতা থিয়েটারে তা প্রদর্শন করা হলে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তার খুবই প্রশংসা করে।
তাঁর তৈরী তথ্য ছবিঃ Anti- partition Demonstration and Swadeshi movement at the Town hall, Calcutta on 22nd September 1905, ভারতের প্রথম রাজনীতিক চলচ্চিত্র বলে গণ্য করা হয়।
১৯০৫ এর এ ছবির বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল – “আমাদের নিজেদের স্বার্থে খাঁটি স্বদেশী সিনেমা” ছবির শেষ গাওয়া হয়েছিল “বন্দে মাতরম”

হীরালাল সেন কতগুলো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন তার সঠিক তথ্য জানা যায় নি। তবে ধারণা করা হয় ৪০ টির মতো হবে তবে বিভিন্ন মতবাদ আছে।
বেশিরভাগ ছবিতেই তিনি ক্যামেরাবদ্ধ করেন অমরেন্দ্রনাথ দত্তের কলকাতা ক্লাসিক থিয়েটারে মঞ্চস্থ বিভিন্ন থিয়েটারের দৃশ্য।

হীরালাল বিয়ে হয় হেমাঙ্গিনী দেবীর সাথে। তাদের তিন সন্তানের কথা জানা যায়। প্রথম পুত্র বৈদ্যনাথ সেন ১৯০২ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তৃতীয় সন্তান মেয়ে প্রতিভা সেন তথির বিয়ে হয় নরনাথ সেনের সাথে। নরনাথ সেনের ভাইপো দিবানাথ সেনের স্ত্রী ছিলেন কিংবদন্তির নায়িকা সুচিত্রা সেন।

রয়্যাল বায়োস্কোপ কম্পানী প্রথম ছবি বানায় ১৯১৩ সালে। এরপর হীরালাল অনেক দুর্গতি আর অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হন। এলফিনস্টোন বায়োস্কোপ কোম্পানীর জামশেদজি ফ্রেমজি ম্যাডান তার থেকে অনেক বেশি সাফল্য অর্জন করেন। ১৯১৭ সালের এক অগ্নিকাণ্ডে তার তৈরি সমস্ত ছবি ও নথিপত্র নষ্ট হয়ে যায়।

বিশ্বে প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মাত্র তিন বছরের মধ্যে আমাদের মানিকগঞ্জের সন্তান হীরালাল বাংলাদেশে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেছিল। উপমহাদেশে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের কৃতিত্ব প্রকৃতপক্ষে তারই প্রাপ্য।

১৯১৭ সালের ২৬ অক্টোবর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরন করেন।

লেখকঃ কলাম লেখক ও শিক্ষার্থী,অনার্স চতুর্থ বর্ষ(২০১৫-১৬),গনিত বিভাগ

লেখকের প্রকাশিত আরও লেখা পড়ুন-

ভারতের মাওবাদী আন্দোলনের ইতিহাস

 

আরও পড়ুন