Ads

ভারতের মাওবাদী আন্দোলনের ইতিহাস

আয়েশা সিদ্দিকা

গত ৩ এপ্রিল ভারতের ছত্তিশগড় রাজ্যে সুকমা জেলায় মাওবাদীদের হামলায় ২২ জন জওয়ান নিহত হয় এবং ৩১ জন আহত হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যম কাভার করছে নিচু স্বরে, শরমিন্দাভাবে। অথচ পাকিস্তান বা চীনের হাতে একজন জওয়ান প্রাণ হারালে সবার মধ্যে প্রতিশোধের উন্মাদনা দেখা দেয়।

এই অভিযানে রাষ্ট্রীয় প্রায় ১ হাজার ৮০০ জন সেনা ছিল অন্যদিকে মাওবাদীদের সংখ্যা ২০০-৪০০ উল্লেখ করা হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। এত বড় রাষ্ট্রীয় বাহিনী এরকম ছোট গেরিলা দলের হাতে বিপর্যস্ত হওয়া সত্যিই সামরিক ধাঁধা। সংখ্যায় ৬-৭ গুণ বড় উন্নত অস্ত্রধারী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তাদের সফলতার জন্য সংবাদমাধ্যমগুলো দায়ী করছে মূলত মাদাবি হিডমাকে। তাঁকে খোঁজার জন্য ৪৫ লাখ রুপি ধার্য করা হয়েছে। কিন্তু মাওবাদী সমস্যা কোনো এক ব্যাক্তির রোমাঞ্চকর বিপ্লবীপনার ফসল নয়। গুরুতর এক আর্থসামাজিক অবস্থার সঙ্গেই এর মূল যোগ।

মাওবাদ আসলে কী?

এ সম্পর্কে একটু ধারণা নেই ।

মাওবাদ একটি রাজনৈতিক মতবাদ বা আদর্শ। চীনের মহান নেতা মাও জে দং এর আদর্শ,চিন্তাভাবনা ও শিক্ষাকে মাওবাদ বলে। মাও জে দং মার্কসবাদ এবং লেনিনবাদের ভালো দিকগুলো অনুসরণ করে মাওবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল। একে বলা হয় মাওবাদ ও লেনিনবাদের বাইরে উচ্চতম মতবাদ।

মাওবাদ ১৯৫০ এর দিকে বিস্তার লাভ শুরু করে। তবে মার্কসবাদ ও মাওবাদে পার্থক্য রয়েছে। আমি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে যাচ্ছি না । যেমনঃ

১. মার্কসবাদে বিপ্লবের ক্ষেত্রে সমাজের প্রলেতারিয়েত শ্রেণি এবং শহরকেন্দ্রিক বিপ্লবের কথা বলা হয়েছে । কিন্তু মাওবাদে প্রান্তিক শ্রেণিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। চীনের উৎপাদনব্যবস্থা কৃষিনির্ভর। চীনের ক্ষেত্রে সফল বিপ্লবের জন্য প্রান্তিক কৃষকশ্রেণি থেকে শুরু করে আন্দোলন সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে। মার্কসবাদে এক শ্রেণির মানুষকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কিন্তু মাওবাদে সকল শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

২. মার্কসীয় চিন্তায় পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব। মাওবাদীরা মনে করে আধা সামন্ততান্ত্রিক – আধা পুঁজিবাদী দেশগুলি এক লাফে পুঁজিবাদের দিকে না গিয়ে সমাজতন্ত্রে যেতে পারে।

৩. মার্কসবাদ যদিও খাতা কলমে পার্টির কথা বলা হয়নি। তবে মার্কসের ও তার অনুগামীদের কাজকর্মে এটা পরিষ্কার যে একটি পার্টির কথা বলেছিলেন। প্রশিক্ষিত, বাছা বাছা সদস্যদের নিয়ে গঠিত দল যারা সাধারণ মানুষের শ্রেণিস্বার্থ রক্ষায় সমাজতন্ত্রের অগ্রগতির জন্য কাজ করবে। অন্যদিকে মাওবাদের ধারণামতে পার্টি বলতে গণপার্টির কথা বলা হয়েছে । যেখানে “জনগণই পার্টি, পার্টিই জনগণ”। যখনই পার্টি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কাজ করবে তখনই জনগণকে তাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আশ্রয় নিতে হবে। মাও ১৯৬৬ সালে চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু করেছিল।

৪. উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোই প্রথম সমাজতন্ত্রের পথে যাবে মার্কসবাদে এ ধারণা প্রকাশ করে। কিন্তু মাওবাদে ” গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরো” তত্ত্বের বিশ্বব্যাপী রুপে বিশ্বাস করে।

ভারতের মাওবাদী আন্দোলনের ইতিহাসঃ
দেশকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত করতে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শীদের দ্বারা এই আন্দোলনের সুত্রপাত হয়। ১৯৪৭ সালে বৃটিশরা দেশ থেকে চলে গেলেও বামপন্থী মতাদর্শ থেকে যায় অগোচরে ।

প্রথম সরকারবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের সুত্রপাত হয় ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ী গ্রাম থেকে । এক কৃষককে তার জমিতে চাষ না দেয়া থেকে এ বিরোধ শুরু হয়। এই সশস্ত্র আন্দোলন ৭২ দিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল চারু মজুমদার ও কানু স্যানাল। কৃষকেরা ভূস্বামীদের উৎখাত করে। এজন্য এদের নকশালবাদী মাওবাদী বলা হয়।

চারু মজুমদার নকশালবাড়ী আন্দোলনকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল তার লেখনীর মাধ্যমে। তার বিখ্যাত রচনা “হিস্টরিক এইট ডকুমেন্টস” যা নকশাল মতাদর্শের ভিত্তি রচনা করে। চারু মজুমদার মাও জে দং এর চিন্তাধারায় প্রভাবিত ছিল।

১৯৬৯ সালে তারা CPIML নামে একটা সংগঠন তৈরী করে এবং প্রথম মহাসচিব চারু মজুমদার। অল্প সময়ে দেশের ১১ টি রাজ্যে এর শাখা তৈরী হয়। ১৯৭২ সালে চারু মজুমদার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে এবং মারা গেলে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে।
পরে CPIML ভেঙে একাধিক সংগঠন তৈরী হয়।

২০০৪ সালে জনযুদ্ধ বা পিপলস ওয়ার গ্রুপ ও ভারতের মাওবাদী কমিউনিস্ট সেন্টার মিলে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ( মাওবাদী) CPI। আবার বিদ্রোহের শুরু হয়। মাওবাদীর নিয়ন্ত্রিত এলাকা “রেড করিডোর” নামে পরিচিত। মাওবাদী CPI এর বর্তমান সাধারন সম্পাদক নিম্বলা কেশব রাও ওরফে বসব রাজ। যিনি মুপালা লক্ষ্মণ রাও ওরফে গণপতির পরে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।

মাওবাদীদের দাবি যে তারা মধ্য ভারতের ছত্তিশগড়, উড়িষ্যা, বিহার,ঝাড়খন্ড,মহারাষ্ট্র ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যগুলির কাছাকাছি বনভূমি আদিবাসীদের অধিকার জন্য লড়াই করছে। তাদের মূলধারার রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া নয়, সশস্ত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা।
ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মাওবাদী বিদ্রোহকে সবচেয়ে অভ্যন্তরীণ হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে। ২০০৯ সালে শুরু হওয়া এই অভিযানের নাম ছিল “অপারেশন গ্রীনহার্ট”
দু’পক্ষের সংঘর্ষে অনেক সাধারন জনগণ মারা যায়।
২০১০ সালে একবার মাত্র তিন ঘন্টার এক সংঘাতে ৭৬ জন সেনা হারানোর ঘটনা রয়েছে। যা এই ছত্তিশগড়েই ঘটেছিল।

লেখকঃ আন্তর্জাতিক বিষয়ে কলাম লেখক

আরও পড়ুন