Ads

মহান ভাষা আন্দোলন ও বিচারপতি হাবিবুর রহমানের পঙ্খীরাজ

।। নুরে আলম মুকতা ।।

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্তির রূপরেখাটি আসলে যথাযথ ছিল কিনা এ বিষয়ে এখন আর আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করিনা। কারন হিসাবে বলা যেতে পারে ইতিহাস কখনও ভুল পথে এগিয়ে যায় না। ইতিহাসের পথ অতি সত্য আর মানবিক। রক্তের নদী বইতে পারে, অনেক বাধা অতিক্রম করতে হতে পারে কিন্তু কালের পরিক্রমণ ঠিক জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। এ যেন এক অবিনশ্বর ঘড়ির কাঁটা। সময়কে কেউ জোর করে থামিয়ে দিতে পারে না। পশ্চিম পাকিস্তানিদের এক বড় রকমের রাজনৈতিক ভুল ছিল তা হল ওরা আমাদের জাতিসত্ত্বাকেই অস্বীকার করেছিল। ওরা কখনই মনে রাখেনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার আমাদের আজকের প্রাণপ্রিয় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। একক জাতিসত্ত্বার একটি জনপদকে রক্তচক্ষু বা শক্তির জোরে দমন করা মুশকিল এ সামান্য বিষয়টি তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক জান্তাদের মাথায় আসেনি বিষয়টি ভাবতে অনেকের কষ্ট হবে। তীতুমির, মাষ্টার দা সূর্য সেন, ইলা মিত্র, লীলা নাগদের অস্বীকার করা কী যে দূর্বিষহ কষ্টের তা বাঙ্গালি মাত্র জানে। শোষণ আর শাসন শব্দ দুটি পরিপূরক ।

১৯৪৭ সালের পরে মাত্র তিন চার বছরের মধ্যেই এক অসহ্য অবস্থার মধ্যে আমরা পড়ে গিয়েছিলাম এটি আমরা জানি। কিন্তু দমন পীড়নের মাত্রায় ভাষার ওপর নির্যাতন এটি ছিল এক মারাত্মক রকমের অন্যায় আর পাপাচার । আমাদের তৎকালীন রাজনীতিবিদেরা ছিলেন একদম কোনঠাসা অবস্থায়। তাঁরা হতবিহ্বল পরিবেশ অতিক্রম করছিলেন। ১৯৫১ থেকে ৫২ পর্যন্ত জিন্নাহর রাষ্ট্রভাষা ষড়যন্ত্রের রূপরেখা স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য তারুন্য আর যৌবন দীপ্ত শক্তি ছাড়া কোন উপায় ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব আমাদের জাতির চালিকা শক্তি হিসেবে বার বার আবর্তিত হয়েছে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাত্রা যোগ করে একবারে ১৯৭১ এর বিজয় পর্যন্ত গিয়েছে। ঝরেছে অনেক রক্ত আর মহামূল্যবান প্রাণ। মৃত্যু যেখানে অবশ্যম্ভাবী সেখানে বাঙ্গালি সূর্য সন্তানেরা আত্মাহুতি দিতে কখনই কার্পন্য করেনি।

আমরা জানি ভাষা আন্দোলনের লড়াকু বীর সালাম রফিক জব্বারদের নাম। অসীম বীর সূর্য সৈনিক আর গর্বগাঁথা আমাদের ভাই বোনেরা। আমরা আজ একজন বরেন্য ভাষা সৈনিকের বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করি। বিচারপতি হাবিবুর রহমান আমাদের রাজশাহীর গর্ব আর লালন করার মত একটি নাম। ভারতবর্ষ বিভক্ত হবার পরে যে সব বিখ্যাত উচ্চশিক্ষিত পরিবার পূর্ববাংলায় চলে এসেছিলেন তার মধ্যে একজন হলেন বিখ্যাত আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ জহির উদ্দিন বিশ্বাস। তিনি বিচারপতি হাবিবুর রহমানের বাবা। সহ্য করেছিলেন বৃটিশ রাজের অত্যাচার । ভারতের মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহন করলেও রাজশাহীকে একদম একান্ত নিজের করে নিয়েছিলেন। বিচারপতি হাবিবুর রহমান ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিভাগে এমএ পাশ করার পরও ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের একজন বীর লড়াকু সৈনিক ছিলেন। ১৯৫১ সালের ২১ ফ্রেব্রুয়ারী পাকিস্তানি সরকারের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার অগ্রনায়ক ছিলেন তিনি, বিভিন্ন তথ্য মতে জানা যায়, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বেলা এাগারোটার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার উত্তপ্ত সভায় ঘি ঢেলে দেন ভাষা সৈনিক গাজীউল হক। তিনি বলেন, সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেছে, আমরা এ ধারা ভাঙ্গলে ওরা গুলি করবে, আমাদের হত্যা করবে। আমরা চ্যালেঞ্জ নিয়েছি যে, আমরা দেখতে চাই নুরুল আমিন সরকারের অস্ত্রাগারে কত বুলেট জমা আছে?

এ জ্বালাময়ী বক্তৃতা শেষ হবার পর পরিবেশ গনগনে হয়ে যায়। ভয়ানক শ্লোগানে কেঁপে ওঠে ঐতিহাসিক আমতলা, সমবেত ছাত্ররা শ্লোগান দেয় বজ্রমুষ্ঠি আকাশে তোলে, ১৪৪ ধারা মানি না, মানব না । কিন্তু কে প্রথম ১৪৪ ধারা ভাঙ্গবে এ নিয়ে ইতস্তত বোধ ছিল এবং এটি খুবই স্বাভাবিক । কিন্তু ছাত্ররা বজ্রশপথ নিয়েছিলেন । বিভিন্ন দলে উপদলে ভাগ হয়ে বাইরে বেরোনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বীর বাঙ্গালি সন্তানেরা। এজন্য নাম লিখে রাখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল জনাব মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে। কিন্ত তিনি চাইছিলেন ভিন্ন রকম! এ দলগুলোতে ছিলেন, আজহার, হাসান হাফিজুর রহমান, ইব্রাহিম তাহা, আব্দুস সামাদ আজাদ, আনোয়ারুল হক খান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। গেটে পুলিশ লাঠি চার্জ আর হামলা করলে বীর ছাত্রীদের দল প্রস্তুত রাখা হয়। এ দলগুলোতে ছিলেন, রওশন আরা বাচ্চু, ডা.শাফিয়া, সুফিয়া ইব্রাহিম, শামসুন নাহার প্রমুখ।

পুলিশ লাঠিচার্জ আর হামলা শুরু করলে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার প্রতিযোগিতা শুরু করে দেন উপস্থিত ছাত্রছাত্রীরা । নাম লিখে রাখার দায়িত্ব মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান নিয়েছিলেন, কিন্তু মোহাম্মদ সুলতান এগিয়ে আসতেই তাঁকে তালিকাটি ধরিয়ে দেন আমাদের এ সূর্য সন্তান, প্রধান বিচারপতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা । হাবিবুর রহমান তাঁর প্রিয় বাই সাইকেলটি সুলতানকে দেখিয়ে বলেন, ‘ তুই আমার পঙ্খীরাজটা দেখে রাখিস, আমি চললাম, ভয়ানক কন্ঠে উচ্চারিত হল, রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, ১৪৪ ধারা মানি না, মানব না,

ইতিহাসে নাম লেখা হয়ে যায় একজন প্রদীপ্ত যুবকের! ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে যে দলটি তার নেতৃত্ব দেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান , আমরা তাঁর স্মৃতিকথা শুনে আসি, ” তখন বেলা সোয়া একটা। উত্তেজনায় সারা গা থেকে তখন আগুনের ভাপ বের হচ্ছে। প্রথমে পুলিশ আমাদের ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং পরে রাস্তার একধারে ঘেরাও করে রাখে। আমরা এগিয়ে যাওয়ার পর যখন অন্য ছাত্ররা গেট পার হয়ে রাস্তায় নামতে শুরু করল তখন আমাদের কয়েক জনকে পুলিশ একটি ট্রাকে তুলে নিল। ট্রাকটা যখন তেজগাঁওয়ের দিকে চলতে শুরু করল তখন মনের অবস্থা হালকা করার জন্য আমি বললাম, দূরে কোথাও কোন মজা পুকুরে আমাদের চ্যাংদোলা করে ছুঁড়ে ফেলা হবে। ট্রাকটা চলার সাথে সাথে ঠান্ডা হাওয়ায় মানসিক উত্তেজনা কিছু কমল, কিন্তু দূর্ভাবনা বাড়তে থাকল। “

জনাব মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ১৯৫২ সালে তিনি তাঁর প্রিয় ক্যাম্পাসে ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আধুনিক ইতিহাসে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট হন। ১৯৬১-৬৪ সাল পর১৯৬১-৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের রিডার ও আইন বিভাগের ডীনের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি আইন কে পেশা হিসাবে গ্রহন করে ঢাকা হাইকোর্ট বারে যোগদান করেন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ হাইকোর্টের বিচারপতি ও ১৯৯৫ সালে প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন।

১৯৯৬ সালে তত্তাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ভাষা পন্ডিত ও মননশীল লেখার জন্য বাংলা একাডেমী সাহিত্য পদক, একুশে পদক সহ বিভিন্ন পদকে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর বেশ কিছু মৌলিক গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, যথাশব্দ, মাতৃভাষার স্বপক্ষে রবীন্দ্রনাথ , আমরা কি যাব না তাদের কাছে যারা শুধু বাংলায় কথা বলে , প্রথমে মাতৃভাষা পরভাষা পরে , কত ভাগ্যে বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ, একমুঠো সমুদ্রের গর্জন, কুরআন সূত্র, নির্বাচিত চিনা কবিতা, রবীন্দ্রনাথ ও সভ্যতার সঙ্কট, রবীন্দ্র রচনায় আইন ভাবনা ইত্যাদি অসংখ্য মৌলিক প্রকাশনা রয়েছে তাঁর ।

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ১৯২৮ সালে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গীপুর মহকুমার দয়ারামপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেছিলেন। তিনি ভাষা ও রবীন্দ্র গবেষক, অভিধান প্রণেতা এবং উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বিষয়ে বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের জীবনের একটি চমৎকার সময় কেটেছে আমাদের চাঁপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর গ্রামে নানা বাড়িতে। তাঁর বাবা এ উপজেলার সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা গুল হাবিবাকে বিয়ে করেছিলেন। মুহম্মাদ হাবিবুর তিনি তিন কন্যার গর্বিত জনক, এরা হলেন রুবাবা রহমান, রওনক শিরীন, নুসরাত হাবিব । মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমি, ওরশেস্টোর কলেজ অব অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ছিলেন। বিশ্বখ্যাত লিঙ্কস ইন থেকে তিনি বার এট ল করেন আর লিঙ্কস ইন এর সম্মানিত অনারারি বেঞ্চার ছিলেন। মহান গবেষক, আইনজ্ঞ, প্রশাসক, মহান ভাষা আন্দোলনের পুরোধা বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমান ২০১৪ সালের ১১ জানুয়ারী ৮৫ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন । আমরা এ মহান ভাষা সৈনিকের আত্মার শান্তি কামনা করছি ।

লেখকঃ শিক্ষক ও সহ- সম্পাদক, মহীয়সী 

 

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ, পরিবার ও নিজেকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য নানা ধরণের

আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi এ লাইক দিন  এবং

আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন ।

 

আরও পড়ুন