Ads

মহান সম্রাট অশোকের হাতে এক নদী রক্তের দাগ

ডাঃ আহমেদ জোবায়ের

মগধ প্রাচীন ভারতের ১৬টি মহাজনপদের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী রাজ্য ছিলো।বর্তমান বিহারের পাটনা,গয়া ও বাংলার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত ছিলো এই জনপদ।বিম্বিসার ছিলেন মগধের প্রথম ঐতিহাসিক রাজা।বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতের কথা জানা যায় জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কবিতায়।

এক সময় মগধ নন্দ বংশের শাসনে আসে।ধনানন্দ ছিলেন নন্দ বংশের শেষ সম্রাট।মহামতি আলেকজান্ডার যখন ভারত আক্রমণে এগুচ্ছিলেন, তখন তক্ষশীলার আচার্য চাণক্য ভারতকে রক্ষায় যান ধনানন্দের কাছে।কিন্ত ধনানন্দ চাণক্যকে অপমান করে তাড়িয়ে দেন।সেই অপমানের প্রতিশোধ নিতে প্রাচীন ভারতের শ্রেষ্ঠ কুটনৈতিক ও রণকৌশলী চাণক্য ক্ষত্রিয় চন্দ্রগুপ্তকে তক্ষশীলায় গড়ে তুলেন।চন্দ্রগুপ্ত মগধের রাজাকে পরাজিত করে মগধের সম্রাট হন এবং মৌর্য্য সামাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।চন্দ্রগুপ্ত একের পর এক রাজ্য দখল করে পুরো ভারতের প্রায় সবটাই এই সামাজ্যের অধীনে নিয়ে আসেন।

চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তার ছেলে বিন্দুসার সম্রাট হন।বিন্দুসারের দুই পুত্রের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে লড়াই ছিলো।সুসীম ও অশোক দুইজন সিংহাসনের দাবীদার ছিলেন।অশোক ছিলো বিন্দুসারের দাসী সুভদ্রাঙ্গীর ঘরে জন্ম নেওয়া পুত্র।সেজন্য বিন্দুসার চাইতেন সুসীম যেন সম্রাট হয়।কিন্ত সে ছিলো উগ্র,অহংকারী ও বদমেজাজী।কথিত আছে সুসীম একবার এক টেকো মন্ত্রীর মাথায় লাঠি দিয়ে বাড়ি দেন রসিকতা করে।সেই মন্ত্রী ৫০০ জন মন্ত্রীকে জড়ো করে সুসীমের অযাচিত ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করেন।সম্রাট না হয়েও যে আজ মাথায় বাড়ি দেয়,সেতো পরে মাথা কেটে নিবে।তারা অশোক যেন সম্রাট হতে পারেন তা চাইতো।

তক্ষশীলায় বিদ্রোহ দেখা দিলে সম্রাট বিন্দুসার পুত্র সুসীমকে সেখানে বিদ্রোহ দমনে পাঠালেও সে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে,পরে অশোক গিয়ে বিদ্রোহ দমন করলে অশোকের গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে।

পাশের রাজ্য কলিঙ্গ।সেখানে অশোক নির্বাসনে গিয়ে প্রেমে পড়ে কলিঙ্গের রাজকন্যা কৌরভাকীর।উজাইন রাজ্য বিদ্রোহ দেখা দিলে সম্রাট বিন্দুসার অশোককে ডেকে পাঠান।উজাইনে বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে অশোক আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং এক বৌদ্ধ আশ্রমে চিকিৎসা নেন।সেখানে এক ভিক্ষুর মেয়ে দেবী তার সেবা করে সুস্থ করে তুলেন যাকে পরে অশোক বিয়ে করেন।

বিন্দুসার মারা গেলে অশোক সিংহাসনে বসেন।তিনি তার ভাই সুসীমকে জলন্ত কয়লার খনিতে ফেলে হত্যা করেন।কথিত আছে অশোক তার ভাই বিতাশোক ছাড়া বাকি ৯৯ ভাইকে হত্যা করেন।সিংহাসনে আরোহনের প্রথম আট বছর অশোক ছিলেন নৃশংস ও নিষ্ঠুর।সেজন্য তার নাম হয় চান্ডাশোক মানে ভয়ংকর অশোক।

প্রচন্ড অত্যাচারী অশোক রাজধানী পাটলিপুত্রের উত্তরে এক নান্দনিক জেলখানা তৈরি করেন যার ভেতর যে একবার ঢুকতো,সে লাশ হয়ে বের হতো।
চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ভারত উপমহাদেশে এসেছিলেন সপ্তম দশকে।তিনি উল্লেখ করেন ভারত উপমহাদেশের মানুষ অশোকের মৃত্যুর ৯০০ বছর পরেও তার নৃশংসতার কথা মনে রেখেছিলো এবং অশোকের জেলখানাকে অশোকের নরক বলা হতো।

অশোকের সম্রাট হবার ৮ম বা ১২তম বছরে ২৬১ খিস্ট্রপূর্বে অশোক কলিঙ্গ আক্রমণ করেন।বর্তমান ওড়িশার উপকূলীয় অঞ্চল নিয়ে কলিঙ্গ গঠিত ছিলো।অনেক সমৃদ্ধ ছিলো কলিঙ্গ।ধৌলি পাহাড় ময়দানে দায়া নদীর তীরে এক বিভীৎস যুদ্ধ হয়।সেই যুদ্ধে অশোক বাহিনী কলিঙ্গের মানুষদের কঁচুকাটা কাটে।এক লাখ মানুষ নিহত হয়,দেড় লাখ মানুষ নির্বাসিত হয়।লাশের স্তূপ থেকে এক আহত সৈনিক বের হয়ে এসেছেন। সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত এই সৈনিক জ্ঞান হারিয়ে চাপা পড়েছিলেন লাশের স্তূপের নিচে। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই তার প্রচণ্ড তৃষ্ণাবোধ হচ্ছে। যুদ্ধক্ষেত্রের পাশ দিয়ে বয়ে চলা দায়া নদীর দিকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এক আঁজলা পানি না পেলে এই যাত্রা আর বাঁচবেন না এই তার আশঙ্কা!
নদীর কাছাকাছি চলে আসার পর উঠে বসলেন সৈনিক। যেই না পানি স্পর্শ করতে যাবেন, তখনই ভয়ে শিউরে উঠলেন তিনি। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন, “পানি কোথায়?”

বিশাল দায়া নদীর পানি শুকিয়ে যায়নি। তা কল্পনায়ও অসম্ভব! তাহলে কী দেখে ভয় পেয়েছিলেন সেই সৈনিক? নদীর পানি ঠিকই বয়ে চলছিল আপন খেয়ালে। কিন্তু সেদিন দায়া নদীর পানি ঠিক আমাদের পরিচিত রঙহীন পানির মতো ছিল না। সেই পানির রঙ ছিল টকটকে লাল!
কথিত আছে, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কলিঙ্গে শ্রম খাটানোর জন্য কোনো জীবিত দাস খুঁজে পাওয়া যায়নি।

কলিঙ্গ যুদ্ধের বিজয়ী সম্রাট অশোক যুদ্ধ শেষে যখন কলিঙ্গের ময়দানে বীরদর্পে পদচারণা করেন, তখন চারিদিকে মানুষের আহাজারি, কান্না আর আর্তনাদ তার মনকে ব্যথিত করে তুলে। কলিঙ্গের ঘরে ঘরে বিধবা আর পিতৃহীনদের কান্নায় পরিবেশ ভারি হয়ে উঠলো। সম্রাট অশোক এই বিজয় চাননি। তিনি কলিঙ্গ চেয়েছিলেন, কিন্তু পরিণামে পেলেন এক মৃত্যুপুরী, যার কারিগর তিনি নিজে।

ময়দানের যুদ্ধ ঠিকই শেষ হয়ে গেল, কিন্তু অশোকের মনে তখনো যুদ্ধ চলছিল। লোকমুখে প্রচলিত আছে, যুদ্ধের পর এক কলিঙ্গ বৃদ্ধা অশোকের দরবারে হাজির হন। কলিঙ্গে যুদ্ধে বৃদ্ধার স্বামী, পিতা এবং সন্তান প্রাণ হারান।

তিনি কাঁদতে কাঁদতে সম্রাটকে প্রশ্ন করেন, “আপনার কারণে আমি সব হারিয়েছি। এখন আমি কী নিয়ে বাঁচবো?”
বৃদ্ধার এই প্রশ্ন সম্রাটকে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলে। তার পক্ষে এই গ্লানি সহ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ভেঙে পড়েন শক্তিধর সম্রাট। এরপর তিনি মৌর্য সাম্রাজ্যবাদের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। তিনি নিজে আর যুদ্ধে অংশ নেবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন।

সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন এবং অহিংস নীতির অনুসারী হন।এভাবে কলিঙ্গ যুদ্ধের ফলে অশোকের রাজ্য পরিচালনা নীতিতে অনেক বড় পরিবর্তন আসে।তিনি জনদরদী সম্রাট হয়ে উঠেন।

পৃথিবীর ইতিহাসে তিনি প্রথম পশুপাখিদের জন্য হাসপাতাল বানান।বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি অনুরক্ত অশোক চান্ডাশোক থেকে ধর্মাশোকে পরিনত হন।বৌদ্ধগুরুরা তাকে দেবনাংপ্রিয় উপাধি দেন মানে দেবতাদের প্রিয়জন অশোক।

ভারতের জাতীয় পতাকায় অশোকের চক্র সাদার মধ্যে ২৪টি স্পাইক চক্র।অশোক হয়ে উঠলেন মহান সম্রাট।দক্ষিণের কিছু অংশ ছাড়া পুরো ভারত উপমহাদেশ অশোকের সাম্রাজ্যের অধীনে ছিলো।একজন নিষ্ঠুর ও নৃশংস সম্রাট থেকে অশোক একজন ধর্মপ্রাণ ও দরদী সম্রাট হয়ে উঠলেও অশোকের হাতে লেগে আছে এক নদী রক্তের দাগ।লাখো মানুষ হত্যার দায় অশোকের কাঁধে।

লেখকের অন্য লেখা-সন্তানের মুখ দেখে মায়েরা ভুলে যান সব ব্যাথা

লেখকঃ কলাম লেখক ও চিকিৎসক

আরও পড়ুন