Ads

মানসুরা যুদ্ধ-১২৫০: যে যুদ্ধে মুসলিম সেনাপতি ছিলেন নারী

।। মোহাম্মদ সলিমুল্লাহ ।। 

.
১২৫০ সালের এইদিনে (৮ ফেব্রুয়ারি) মানসুরা যুদ্ধ শুরু হয়। এটা ছিল ৭ম ক্রুসেডের শেষ যুদ্ধ। এখানে ফ্রান্সের রাজা নবম লুই এর বাহিনী এবং রানী শাজার আল-দুর এর নেতৃত্বে আইয়ুবী বাহিনীর মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধে ক্রুসেডার বাহিনী ধ্বংস হয়। তবে, জীবীতরা ইউরোপে পালিয়ে গিয়ে যুদ্ধজয়ের কাহিনী জানায়।
.
১২৪৪ সালে ৬ষ্ঠ ক্রুসেডে মুসলিম বাহিনী জেরুসালেম পুনরুদ্ধার করে। ক্রুসেডাররা উপলব্ধি করে যে, মিশর হচ্ছে মুসলিম সেনাবাহিনী ও অস্ত্রাগারের প্রাণকেন্দ্র। এই সম্রাজ্য তাদের জেরুসালেম দখলের পথে মূল বাধা। ফলে, ১২৪৫ সালে ৭ম ক্রুসেডের ১ম কাউন্সিলে পোপ ইনোসেন্ট মিশর অভিযান অনুমোদন করেন।
.
৭ম ক্রুসেডের লক্ষ্য ছিল মিশর ও সিরিয়ায় আইয়ুবী রাজবংশকে ধ্বংস করা এবং জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করা। এই লক্ষ্যে পোপ দূত প্রেরণের মাধ্যমে মঙ্গোল বাহিনীকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদের মিত্র হতে আমন্ত্রণ জানায়। এর বিনিময়ে মঙ্গোল সম্রাট গুইউক পোপ ও ইউরোপের রাজাদের বশ্যতা আদায় করে নেন।
.
সিদ্ধান্ত হয় যে, ক্রুসেডাররা পশ্চিম দিক থেকে এবং মঙ্গোলরা পূর্ব থেকে মিশরকে আক্রমণ করবে। ১২৪৮ সালে রাজা লুইয়ের ভাই চার্লস ডি’আঞ্জু ও রবার্ট ডি’আর্টয়েস এর নেতৃত্বে সপ্তম ক্রুসেডের যুদ্ধজাহাজগুলি মিশরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। ১২৪৮ সালের জুন জাহাজগুলি মিশরীয় জলসীমায় প্রবেশ করে।
.
রাজা নবম লুই সুলতান আস-সালিহ আইয়ুবীকে পত্র প্রেরণ করেন। এদিকে ক্রুসেডার ও মঙ্গোলদের বিশাল উপস্থিতি দেখে দামিয়েত্তা শহরে আইয়ুবি কমান্ডার আমির ফখর আদ-দিন ইউসুফ দূর্গ ত্যাগ করে বাহিনী নিয়ে রাজধানীতে ফিরে যান। ক্রুসেডাররা নির্বিঘ্নে সেতু পার হয়ে দামিয়েত্তা দখল করে নেয়।
.
এ অবস্থায় সমগ্র মিশর থেকে যোদ্ধা-অযোদ্ধা লোকেরা যুদ্ধের জন্য কায়রোতে চলে আসে। তথাপি মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা ক্রুসেডারদের তুলনায় নগন্য ছিল। তারা কয়েক মাস ধরে ক্রুসেড ক্যাম্পগুলোতে গেরিলা হামলা করতে থাকে এবং অনেক ক্রুসেডারকে বন্দী করে কায়রো পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হয়।
.
এদিকে রাজা লুই এর তৃতীয় ভাই আলফোনস ডি পোয়েটার্স আরো একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে উপনীত হয়। ওদিকে সুলতান সুলতান সালিহ আইয়ুবির মৃত্যু ঘটে। এতে ক্রুসেডারদের উদ্দীপনা অত্যান্ত বৃদ্ধি পায়। তারা দ্রুতবেগে কায়রোর দিকে অগ্রসর হয়। মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন বিধবা রানী শাজার আল-দুর।
.
ক্রুসেডাররা আশমুম খাল (বর্তমানে আলবাহর আলসাগির নামে পরিচিত) পার হয়ে মুসলিম শিবিরের নিকটবর্তী হয়। কয়েকজন মিশরীয় খ্রিস্টান ক্রুসেডারদেরকে মুসলিমদের দূর্গে পৌছাবার গোপন পথ দেখিয়ে দেয়। ক্রুসেডাররা দ্রুত নিজেদের কমান্ডো বাহিনীকে সুগঠিত করে এবং সামনে এগিয়ে দেয়।
.
৮ ফেব্রুয়ারি রবার্ট অব আর্টইস এর নেতৃত্বে নাইট টেম্পলার এবং উইলিয়াম অব স্যালিসবারি এর নেতৃত্বে ইংরেজ কন্টিনজেন্ট মানসুরা থেকে দুই মাইল দূরে মুসলিমদের গিদেইলা শিবিরে আকস্মিক আক্রমণ করে এবং মানসুরার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তাদের আগমনে কায়রোর প্রবেশ দ্বার খুলে দেওয়া হয়।
.
ক্রুসেডাররা পরিপূর্ণ বিজয় ভেবে শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে ছুটে যায়। কিন্তু শহরে প্রবেশ করে তারা আবিস্কার করে যে, ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে। সকল দিক থেকে মিশরীয় বাহিনী ও স্থানীয় জনগণের তাদেরকে ছেয়ে ফেলে। রবার্ট অব আর্টোইস একটি বাড়িতে লুকিয়ে পড়েন এবং উইলিয়াম অব সালিসবারি নিহত হন।
.
রবার্ট অব আর্টোইস-সহ মাত্র পাঁচজন টেম্পলার নাইট জীবিত পালাতে পেরেছিল। ক্রুসেডা বাহিনী তাদের শিবিরে পিছু হটে এবং দ্রুত ট্রেঞ্চ খনন করে নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করে। ৯ ফেব্রুয়ারি মুসলিম বাহিনী শহর ছেড়ে বের হয়ে ক্রুসেডারদের আক্রমণ করে। কিন্তু ট্রেঞ্চের কারণে তারা বিফল হয়।
.
১১ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা মুসলিম বাহিনী ‘গ্রীক ফায়ার’ নিয়ে পুনরায় ক্রুসেডারদের উপর আক্রমণ শুরু করে। এইদিনের যুদ্ধে উভয় বাহিনীয় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে, দিনশেষে ক্রুসেডারদের বিজয় দেখা যায়। মুসলিমরা মনসুরাতে ফিরে যায় এবং ক্রুসেডাররা তাদের পরিত্যক্ত সম্পদ অধিকার করে।
.
যদিও ক্রুসেডারদের আপাতত বিজয় দেখা গেল, কিন্ত তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। অহংকারী রাজা লুই মুসলিমদের সাথে সন্ধির চেষ্টা করেছিলেন; জেরুসালেম এবং সিরিয়ার উপকূলের কয়েকটি শহরের অধিকার চেয়েছিলেন। মুসলিম বাহিনী এই প্রস্তাব তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করে।
.
ক্রুসেডাররা যখন সিদ্ধান্তহীনভাবে দামিয়াতায় অবস্থান করছে তাদের মাঝে প্লেগ মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। তারা সরে গিয়ে ফারিসকুর ময়দানে অবস্থান গ্রহণ করে। ৫ এপ্রিল মুসলিম বাহিনী সেখানে উপস্থিত হয়। এখানে মরণপণ যুদ্ধে ক্রুসেডার বাহিনী প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় এবং ৬ এপ্রিল রাজা নবম লুই বন্দী হন।
.
স্বল্প সংখ্যক ক্রুসেডার পালিয়ে ইউরোপ যেতে সক্ষম হয়। তারা মিথ্যা তথ্য প্রচার করছিল যে, রাজা লুই মিশরের সুলতানকে পরাজিত করেছেন এবং কায়রো অধিকার করে সেখানে শাসন করছেন। কিন্তু পরে তাদের পরাজয় ও লুইয়ের বন্দিত্বের খবর পৌঁছলে লুই’কে উদ্ধারের জন্য নতুন ক্রুসেড গড়ে তোলা হয়।
.
লেখকঃ জয়েন্ট ডিরেক্টর, বাংলাদেশ ব্যাংক 

 

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ, পরিবার ও নিজেকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য নানা ধরণের

আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi এ লাইক দিন  এবং

আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন ।

আরও পড়ুন