Ads

যে মুসলিমের গেরিলা কৌশলের অনুসারী মাও সে তুংসহ অনেকে

।। মোহাম্মদ সলিমুল্লাহ ।। 

চে গুয়েভারা, মাও সে তুং বা হো চি মিন এর নাম সবাই জানি। কিন্তু জানি না, মরক্কোতে এমন একজন বিপ্লবী নেতা ছিলেন, যার গেরিলা কৌশল ও সাফল্য ঐ তিন নেতাকেই অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল করিম খাত্তাবি । তিনি ফরাসি ও স্প্যানিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর বিদ্রোহ গড়ে তুলেছিলেন। ১৮৮২ সালে মরক্কোর রিফ অঞ্চলের আজদির শহরে খাত্তাবির জন্ম হয়। তিনি স্থানীয় মাদ্রাসায় কুরআন শেখেন। পরবর্তী কয়েক বছর তিনি স্প্যানিশ স্কুলে পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি ফেজের বিখ্যাত কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আরবি এবং ইসলামি আইনশাস্ত্রের ওপর পড়াশোনা সম্পন্ন করেন।

 

পড়াশোনা শেষে খাত্তাবি মেলিলা এলাকায় বসবাস শুরু করেন। মরক্কোর ঐ অংশ ছিল স্পেনের উপনিবেশ। সেখানে তিনি শিক্ষক ও অনুবাদক হিসেবে চাকুরি শুরু করেন। তিনি এল তেলিগ্রামা দেল রিফ পত্রিকার সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসেবেও কাজ করেন। ১৯১০ সালে তিনি সরকারী দোভাষী হিসেবে চাকুরি শুরু করেন।দোভাষীর চাকুরি তাঁকে স্প্যানিশ সামরিক আমলাতন্ত্র ও শহরের নাগরিক সমাজের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগে নিয়ে আসে এবং তিনি বুদ্ধিমত্তা, দক্ষতা ও বিচক্ষণতার জন্য খ্যাতি অর্জন করতে থাকেন। তাঁর ধর্মীয় ও শিক্ষাগত যোগ্যতা বুঝতে পেরে সরকার ১৯১৫ সালে তাঁকে মেলিলার কাজি হিসেবে নিয়োগ করে।

 

১ম বিশ্বযুদ্ধকালে তুর্কি-জার্মানদের সহযোগিতা করার কারণে ফরাসিদের রোষানলে পড়ে খাত্তাবি ১৯১৬-১৯১৮ সাল, দুই বছর জেল খাটেন। পরে জেল পালান এবং যুদ্ধ সমাপনান্তে চাকুরিতে পুনঃবহাল হন। তাঁর বাবা ছিলেন রিফ অঞ্চলের নেতা। ১৯২০ সালে তাঁর মৃত্যু হলে খাত্তাবি ঐ এলাকার নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।এদিকে, ফরাসি ও স্প্যানিশদের নতুন নতুন করের বোঝা ও বিবিধ অত্যাচার মানুষকে অতিষ্ঠ করে তোলে। এসময় খাত্তাবি অসামান্য মেধা, নেতৃত্ব, বাগ্মীতা ও মানুষকে প্রভাবিত করার অকল্পনীয় দক্ষতায় দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। অল্প দিনের মধ্যে স্প্যানিশদের বিরুদ্ধে একটি সশস্ত্র গেরিলা দল তৈরি করে ফেলেন।

 

১৯২০ সালে খাত্তাবি বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং স্বাধীন রিফ প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেন। ১৯২১ সালে স্প্যানিশ সৈন্যরা রিফের নিকটবর্তী হয়। খাত্তাবি স্প্যানিশ জেনারেল ম্যানুয়েল ফার্নান্দেজ সিলভেস্ত্রকে সতর্কবাণী পাঠান যে, তার বাহিনী যদি নদী পার হয়ে রিফে প্রবেশ করে, তবে তা যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।জেনারেল সিলভেস্ত্র হুমকি হেসে উড়িয়ে দেন এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খাত্তাবিকে ধ্বংস করে তাঁর বাড়িতে বসেই চা পান করার ঘোষণা দেন। কিন্তু চা পান তো দূরের কথা, খাত্তাবির আক্রমণে তার বিশাল বাহিনীর পান করার মতো পানিও অবশিষ্ট ছিল না। অনেককেই নিজেদের মূত্র পান করে তৃষ্ণা মেটাতে হয়েছিল।

 

সিলভেস্ত্র ৬০ হাজার সৈন্য নিয়ে নদী পার হয়ে আবরান পাহাড়ের পাদদেশে চৌকি স্থাপন করেন। ১৯২১ সালের জুন মাসে রিফিয়ান বাহিনী প্রথম একটি পোস্টে হামলা চালায়। ঐ পোস্টের ২৫০ স্প্যানিশ সৈন্যের মধ্যে ১৭৯ জন নিহত হয়। ১৯২১ সালের ২২ই জুলাই আনুয়াল ক্যাম্পে হামলা পরিচালনা করা হয়।৩,০০০ রিফ গেরিলার হামলায় একরাতের মধ্যে স্প্যানিশদের ২২,০০০ সৈন্য নিহত হয়। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় তারা অন্তত ১৫টি কামান, ৪০০টি মেশিনগান, ২৫,০০০ রাইফেল, ২,০০০ ঘোড়া পেছনে ফেলে যায়। এই জয় অর্জিত হয় মাত্র ৮০০ রিফি গেরিলার প্রাণের বিনিময়ে।

 

জেনারেল সিলভেস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে আত্মহত্যা করেন। আনুয়াল যুদ্ধ ছিল বিশ্বের সকল ঔপনিবেশিক শক্তির জন্য একক সর্বোচ্চ পরাজয়। এই গ্লানি মুছে ফেলার জন্য স্প্যানিশ বাহিনী ফরাসিদের সাথে মিলে মরক্কোতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। তারা ১৯১৯ সালের ভার্সেই চুক্তি ভঙ্গ করে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করতে শুরু করে।১৯২৫ সালের এপ্রিল নাগাদ খাত্তাবি স্প্যানিশ ও ফরাসিদের পরাজিত করতে করতে ফেজ পর্যন্ত রিফ রাষ্ট্রের আয়তন বৃদ্ধি করেন। নাস্তানাবুদ ফ্রান্স সরকার ফিল্ড মার্শাল হেনরি ফিলিপ পেটেনের অধীনে মরোক্কোতে আড়াই লাখ সৈন্যের বিশাল বাহিনী, তাদের সকল যুদ্ধ বিমান ও বিপুল কামান মোতায়েন করে।

 

১৯২৫ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ মরোক্কোতে স্প্যানিশ-ফরাসি বিশাল নৌবহর যুক্ত হয়। এরপর দশ মাস স্থায়ী তীব্র যুদ্ধে রাসায়নিক বোমার এলোপাতাড়ি ব্যবহারের সামনে রিফ বাহিনী পরাজিত হয়। অগণিত বেসামরিক মানুষের ক্রমাগত মৃত্যুতে ভারাক্রান্ত খাত্তাবি অবশেষে ১৯২৬ সালের ২৬ মে আত্মসমর্পণ করেন।

 

ফরাসিরা তাঁকে লা রিইউনিয়ন দ্বীপে নির্বাসন দেয়। ১৯৪৭ সালে তিনি সেখান থেকে পালিয়ে মিশরে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানেই ১৯৬৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
চে গুয়েভারা, মাও সে তুং, হো চি মিন- প্রত্যেকেই খাত্তাবির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং তাঁর পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। আমরা চে গুয়েভারা, মাও সে তুং, হো চি মিন’দের পুরো ইতিহাস জানলেও তাদের গুরুর নামটা পর্যন্ত জানি না।

 

লেখকঃ কলাম লেখক ও  জয়েন্ট ডিরেক্টর, বাংলাদেশ ব্যাংক 

 

লেখকের আরও লেখা পড়ুন-  মানসুরা যুদ্ধ-১২৫০: যে যুদ্ধে মুসলিম সেনাপতি ছিলেন নারী

তাজমহল ও শাহজাহানের ‘পাষণ্ডতা’!

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ, পরিবার ও নিজেকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য নানা ধরণের

আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi এ লাইক দিন  এবং

আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন ।

আরও পড়ুন