Ads

শাসকের সামনে নির্ভীক আলেম (পর্ব-১)

আইনুল হক কাসিমী

হাসান বসরি রহ.। রাসুলের বেশ কজন সাহাবির সাহচর্যপ্রাপ্ত একজন প্রসিদ্ধ তাবেয়ি। মদিনায় জন্মালেও পরবর্তীকালে বসরায় চলে যান। দেখতে ছিলেন কালো। কিন্তু ইলম ও আমলে ছিলেন তাঁর জামানার সরদার। বুজুর্গিতেও ছিলেন অনন্য। কথায় ও কাজে কোনো বেমিল ছিল না তাঁর। ছিলেন বড় বীরচেতা। সত্য বলতে পরোয়া করতেন না। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মতো ছিলেন স্পষ্টভাষী।

তাঁর জন্মের পর তাঁকে নিয়ে খলিফাতুল মুসলিমিন উমর ইবনুল খাত্তাবের কাছে যাওয়া হয়। তিনি তাঁকে দুআ দিয়ে বলে—‘হে আল্লাহ! এই ছেলেকে দীনের ফকিহ বানিয়ে দাও এবং লোকদের মধ্যে প্রিয় করে দাও।’ খলিফার দআ কবুলও হয়েছিল।

হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সাকাফি। উমাইয়া খিলাফতের পক্ষ থেকে নিযুক্ত ইরাকের শাসক। জুলুম, সীমালঙ্ঘন ও স্বৈরাচারিতা শুরু করলেন। সরব হলেন হাসান বসরি। তিনিও সেসব অল্পসংখ্যক লোকদের একজন, যারা হাজ্জাজের সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে বিরোধিতা করেছিলেন। বলিষ্ঠভাবে মানুষের মধ্যে তাঁর অপর্কমের ঘোষণা করেছিলেন। এবং তাঁর মুখের ওপর সত্য বলতে কুণ্ঠাবোধ করেননি।

হাজ্জাজ একটি প্রাসাদ নির্মাণ করলেন। রাজকীয় জাঁকজমকপূর্ণ। তিনি লোকদের মাঝে শাহি এলান জারি করলেন যে—তারা যেন তাঁর প্রাসাদের দীর্ঘস্থায়িত্ব ও বরকতের জন্য দুআ করে। শাহি এলান শুনতেই লোকজন রাজপ্রাসাদে গিয়ে হাজির।

হাসান বসরি লোকদের সমবেত হওয়ার এই সূবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলেন। তাদেরকে উপদেশ দেয়ার জন্য। তাদেরকে বোঝানোর জন্য। পার্থিব সম্পদের ব্যাপারে তাদের উদাসীন করার জন্য। সর্বোপরি পারলৌকিক সম্পদের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ জন্মানোর জন্য।

লোকজন হাজ্জাজের আকাশচুম্বী প্রাসাদ প্রদক্ষিণ করছে। প্রাসাদের সৌন্দর্য উপভোগ করছে। প্রাসাদের চাকচিক্যের পূর্ণতা দেখে থমকে যাচ্ছে। তখন হাসান বসরি লোকদের মধ্যে বক্তব্য রাখার উদ্দেশ্যে দাঁড়ালেন। বক্তব্যের সারাংশ হলো—
“যদি আমরা সর্বাধিক নিকৃষ্ট ব্যক্তির তৈরি করা প্রাসাদের দিকে তাকাই, তবে দেখতে পাই—ফেরাউন এর চেয়ে কঠিন মজবুত এবং আকাশচুম্বী উঁচু প্রাসাদ তৈরি করেছিল। তবুও আল্লাহ তাআলা ফেরাউনকে ধ্বংস করে দিয়েছেন এবং তার গগনচুম্বী প্রাসাদ ভেঙ্গে চুরমার করে ছেড়েছেন। হাজ্জাজ যদি বুঝতে পারত—আকাশের অধিবাসীরা তাঁকে অপছন্দ করছে এবং পৃথিবীর অধিবাসীরা তাঁর থেকে উপদেশ গ্রহণ করছে!”

পরদিন হাজ্জাজ যখন তাঁর সভাকক্ষে প্রবেশ করলেন, তখন তিনি রাগে ফেটে পড়ছিলেন। তিনি তাঁর সভাসদদের বললেন—‘তোমাদের ধ্বংস হোক, তোমরা দূর হও। বসরার এক কৃতদাস উঠে দাঁড়িয়ে তোমাদের সামনে যা ইচ্ছে তা-ই বলল, আর তোমাদের মাঝে এমন কেউ ছিল না, যে তাঁকে প্রতিহত করবে অথবা তাঁর কথায় অস্বীকৃতি জানাবে! আল্লাহর কসম করে বলছি, হে কাপুরুষের দল, অবশ্যই আমি তোমাদেরকে তাঁর রক্ত পান করাব।’ অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেন হাজ্জাজ। তিনি তরবারি ও যে চওড়া চামড়ার বিছানায় মানুষের শিরোচ্ছেদ করা হয়, সেই নাতা আনার আদেশ করলেন। হাজ্জাজের আদেশমতো তা উপস্থিত করা হলো।

জল্লাদকে ডাকা হলো। ডাক শুনতেই জল্লাদ এসে উপস্থিত। হাজ্জাজ হাসান বসরিকে ধরে আনার জন্য কয়েকজন সৈন্য পাঠালেন। অল্পক্ষণ পরেই হাসান বসরি হাজ্জাজের দরবারে এসে উপস্থিত হলেন। কিন্তু যেই হাসান বসরি দরবারে পদার্পণ করলেন, তখনই সবার হৃদয়ে কম্পন শুরু হলো! হাসান বসরি যখন তরবারি, নাতা ও জল্লাদকে উপস্থিত দেখলেন, তখন তিনি তাঁর ঠোঁটদ্বয় সামান্য নাড়ালেন। এরপরই হাজ্জাজের দিকে এগিয়ে গেলেন। অথচ তখনও তাঁর মধ্যে একজন মুমিনের মহত্ব, মুসলমানের আত্মসম্মানবোধ এবং দায়ি ইলাল্লাহর শান্তশিষ্টভাব বিরাজমান।

হাসান বসরির এ অবস্থান দেখে ভড়কে গেলেন হাজ্জাজ। ভয়ে তাঁর মুখাবয়ব ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কোনোরকম বলতে লাগলন—‘আবু সাইদ, এদিকে আসুন। এখানে বসুন!’ এ কথা বলে তিনি হাসান বসরিকে বসার জায়গা করে দিতে শুরু করলেন। হাজ্জাজের এ অবস্থা দেখে লোকজন তো বিস্ময়াবিভূত, হতবাক! তারা তাঁর দিকে বিস্ফারিত নেত্রে তাকাতে শুরু করল। আসন গ্রহণ করলেন হাসান বসরি। হাজ্জাজও বসলেন।

হাসান বসরির দিকে তাকালেন হাজ্জাজ। ধর্মীয় কিছু বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। হাসান বসরিও তাঁর প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর স্থিরচিত্তে, জাদুকরী ভাষায় এবং প্রগাঢ় জ্ঞানের আলোকে দিতে থাকলেন। উত্তর শুনার পর হাজ্জাজ বললেন—‘হে আবু সাইদ! আপনি জ্ঞানীদের সম্রাট!’ হাজ্জাজ সুগন্ধি আনতে হাঁক ছোড়লেন। সুগন্ধি আনা হলে নিজ হাতে হাসান বসরির দাড়িতে মেখে দিয়ে সসম্মানে বিদায় জানালেন।

হাজ্জাজের রাজপ্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন হাসান বসরি। প্রাসাদের দ্বাররক্ষী তাঁর পিছু পিছু ছুটে এলো। তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘হে আবু সাইদ! হাজ্জাজ আপনার সাথে যে আচরণ করেছেন, তার বিপরীত আচরণ করার জন্য তিনি আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমি লক্ষ্য করেছি, যখন আপনি অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখন আপনি উভয় ঠোঁট নেড়ে বিড়বিড় করে কী যেন পড়েছিলেন। বলুন তো, আপনি কী পড়ছিলেন?’

-‘হে আমার নিআমতের অভিভাবক! হে আমার বিপদের আশ্রয়দাতা! আপনি তাঁর ক্রোধকে আমার জন্য শীতল ও শান্তিময় বানিয়ে দেন, যেমনিভাবে আপনি আপনার প্রিয়বন্ধু হজরত ইবরাহিম আ.-এর জন্য আগুন শীতল ও শান্তিময় বানিয়েছিলেন।’

(চলবে)

লেখকঃ লেখক ও শিক্ষক, কওমি মাদ্রাসা

তথ্য সূত্রঃ
১। ওয়াফায়াতুল আইয়ান : ২/৩৭৭, ইমাম আহমাদ বিন মুহাম্মাদ ইবনে খাল্লিকান।
২। সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৪/২৩১, হাফিজ শামসুদ্দিন যাহাবি।
৩। হিলয়াতুল আউলিয়া : ২/১৭০, ইমাম আবু নুআইম আস্ফাহানি।

আরও পড়ুন-

জোরুজালেমে রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে হযরত ওমর (রা:) এর অনুভুতি

আরও পড়ুন