Ads

যে কারণে বার বার ‘পলাশী ’ আসে

জিয়াউল হক

বসর ঘুরে আবারও হাজির হয়েছে ২৩ শে জুন, পলাশী দিবস। প্রায় ২৬৪ বসর আগের এই দিনে নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে যুদ্ধ নামক এক প্রহসনের মাধ্যমে ক্ষমতা হতে সরিয়ে বাংলার ক্ষমতা দখল করা হয়েছিল। নিরেট ক্ষমাতার হাত বদলই ভেবেছিল বরাবরই ‘রাজনীতি আমার পছন্দ নয়’ কিংবা ‘আমি ভাই অরাজনৈতিক’ বচন কপচানো বাংগালি। তারা সেদিন বুঝতেই পারেনি যে, সিরাজের পতন এর মাধ্যমে ক্ষমতা নয় দেশটাই হাতছাড়া হয়ে গেছে।
সেই থেকে রথী মহারথীরা কতো শত গবেষণা প্রবন্ধ রচনা করেছেন, কত শত বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছেন। সিরাজের জন্য কান্না করেছেন। কেউ কেউ আবার তার দোষত্রæটি খুঁজে খুঁজে হয়রাণ হয়ে গেছেন। কিন্তু একটা কাজ সম্ভবত কেউই করেননি, সেটা হলো, কোন দীর্ঘ সামাজিক, রাজনৈতিক ও আদর্শিক নৈরাজ্যের ধারাবাহিকতায় বাংলায় দেশবিক্রির এই নাটকটা মঞ্চস্থ হলো?

নিজেদের দোষ গোপন করাটা বরাবরই মানুষের একটা বৈশিষ্ঠ। সুযোগ পেলেই মানুষ তা করবে। অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজে সাজবে নির্দোষ মাসুম! ঠিক এই কাজটাই করে চলেছি আমরা বিগত দুইশত চৌষট্টিটা বসর। কেউ নিজেদের দোষটা খুঁজে দেখছি না, সব দোষ ঐ ব্যাটা সিরাজ, মীর জাফর, ঘষেটি বেগম আর উমিচাঁদ কিংবা রাজা রায়দূর্লভ প্রমূখ ওদের। আমরা সবাই নির্দোষ।

পলাশীর ট্রাজেডি যে পথ দিয়ে একটি সমাজে আসে, সেই পথটা চিনতে না পারলে ওরকম ট্রাজেডি বার বার আসবে দেশে বা সমাজে। কাজেই কোন পথ ধরে পলাশীর সেই নাটক মঞ্চস্থ হতে পেরেছে, সেটাকে চিনতে হবে নিজের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তার স্বার্থেই।

পঞ্চদশ শতাব্দির শেষভাগে (১৪৯২) এসে বিষ্ময়কর আন্দালুসের ইসলামি শাসনকে উৎখাতের মাধ্যমে পুরো স্পেন থেকেই ইসলামি শাসন এবং মুসলমান সম্প্রদায়কে উৎখাত করা গেছে, এই আনন্দে পোপ এবং খৃষ্টজগত উচ্ছসিত। তারা যেন আকাশে উড়ছেন। বিশ্বময় খৃষ্টবাদকে ছড়িয়ে সকল দেশ ও জনপদ নিজেদের আয়ত্বে এনে সম্পদের পাহাড় গড়ার স্বপ্নে বিভোর। ফার্ডিনান্ড ও ইসাবেলার পরিকল্পনা ও পোপের অনুমতিতে দলে দলে পুর্তগিজ অভিযাত্রীরা বেরিয়ে পড়ে। তারই ধারাইবহকতায় আন্দালুসের পতনের মাত্র পাঁচ বসরের মাথায় ভাস্কো দা গামা এসে হাজির (১৪৯৭)।
চোর ডাকাতকে স্বর্ণের গুদাম চেনানোর মতো ঘটনা ছিল এটা। ভাস্কো ডা গামা ভারতে প্রথম ট্রিপ শেষ করে ফেরত যাবার মাত্র বৎসর চারেকের মধ্যেই ইউরোপের বাজারে, ইটালির ভ্যালেন্সিয়াতে দাস হিসেবে ভারতীয়দের বিক্রি করা শুরু হয়।

পরবর্তি বসর দুয়েকের মধ্যেই আর এক পর্তুগিজ Pedro Alvarez ৩৩টি যুদ্ধজাহাজ আর ১৫০০ সৈন্য নিয়ে সদলবলে এলেন। তখন দক্ষিণ ভারতের উপকূলীয় এইসব এলাকায় মুসলিম সালতানাত প্রতিষ্ঠিত ছিল আরব নৌ বাণিজ্য রমরমা যে মুসলমানদের উৎখাত করেছে স্পেনের মাটি হতে, ভারতের উপকূলে সেই মুসলমানদের একচ্ছত্র আধিপত্য পর্তূগিজদের সহ্য হবার কথা নয়।
কাজেই Pedro Alvarez দেরি না করে স্থানীয় ও আরব মুসলমানদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘাটে ঘাটে নোঙ্গর করা আরব বণিকদের জাহাজগুলো ধ্বংস করে পুড়িয়ে দেয়। বহু আরব বণিকদের ধরে ধরে হত্যা করে। আচমকা এধরনের নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় স্থানীয় মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়।

কালিকটের জামুরিন রাজার যে জামুরিন রাজা দাক্ষিণাত্যে পর্তূগিজ আগমণের একেবারে শুরু থেকেই বিরোধিতা করে আসছিলেন। তিনি প্রতিরোধ গড়ে তুললেন আশে পাশের সকল মুসলমান বণিক ও যোদ্ধাদের নিয়ে। তার বাহিনীর বেশিরভাগ যোদ্ধাই ছিলেন আরব ও স্থানীয় মোপলা মুসলমান এবং কিছু হিন্দু প্রজা। বাহিনীটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মারক্কার স্থানীয় দুইজন মোপলা মুসলিম সেনাপতি; কুঞ্জ আলি এবং কুট্টি আলি।
এই দুই মুসলিম যোদ্ধার নেতৃত্বে ভারতীয়রা পাল্টা আক্রমণ করে বসে পর্তুগিজ বাহিনীকে। পেদ্রো আলভারেজ (Pedro Alvarez ) এর নেতৃত্বে আগত তেত্রিশটা জাহাজ বহরের মধ্যে প্রায় কুড়িটাই ধ্বংস হয় তার আসে দেড় হাজার পর্তূগিজ সৈন্যদের মধ্যে প্রায় সাড়ে আটশতজন ভবলীলা সাঙ্গ করে। পেদ্রো আলভারেজ প্রচন্ড মার খেয়ে অবশিষ্ঠদের নিয়ে কোনমতে গিয়ে আশ্রয় নেয় কোচিনের স্থানীয় হিন্দু রাজার কাছে।

ভারতে প্রেরিত বাহিনীর প্রায় অর্ধেক পর্তূগিজ সৈন্যের এই শোচনীয় পরিণতি পর্তূগালের শোকের মাতম তোলে। তারা ক্রোধে আক্রোশে ফেটে পড়ে নতুন পরিকল্পনা প্রণয়নে মাঠে নামে। মাত্র কয়েকবসর আগে ভারত থেকে ফেরত যাওয়া ভাস্কো দ্যা গামার মুখে এদেশের ঐশ্বর্য আর সম্পদের বিবরণ শুনে পর্তূগালের সরকার রোমের ভ্যাটিকানে পোপের কাছে দূত পাঠান উপহার সামগ্রীসহ।
এইসব উপহার সামগ্রীর মধ্যে মধ্যে অন্যতম একটা দর্শনীয় বস্তু, বস্তু ঠিক নয়, প্রাণী; ভারতীয় হাতিও ছিল। ইতোপূর্বে পোপ জীবনেও কখনও হাতি দেখেন নি, এই বিচিত্র ও প্রচন্ড শক্তিশালী প্রাণী সন্মন্ধ্যে অনেক কথা শুনেছেন বটে। জীবনে প্রথমবারের মতো প্রকান্ড শক্তিশালী ও অদ্ভূত প্রাণি হাতি দেখে পো স্ববান্ধব বিগলিত হয়ে পর্তূগিজ দূতকে জিজ্ঞেস করলেন; তিনি আগত দূতকে কিভাবে সম্মানিত করতে পারেন?
পর্তূগিজ দূতের বেশি কিছু না, একটা মাত্র আব্দার; মহামান্য পোপ যদি দয়া করে ঘোষণা দেন এই মর্মে যে, ‘আটলান্টিকের ওপারে দক্ষিণ আমেরিকা আর পুবের দিকের ভারতীয় অঞ্চলে পর্তূগিজ বণীকদের ব্যবসার অধিকার আছে’ তা হলেই তারা কৃতজ্ঞ থাকবে। আন্দালুসের মাটি হতে ইসলাম উৎখাতে সফল রাজা রাণী ফার্ডিান্ড ও ইসাবেলার সেই আাব্দার মেনে নিয়ে তিনি বিনাদ্বিধায় সে ঘোষণা দিয়ে ডিক্রি স্বাক্ষর করলেন।
এর মাত্র কয়েক বসরের মধ্যেই আলফানসো ডি আল বুকার্ক পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে আবারও এলেন ভারতে। ততোদিনে পেদ্রো আলভারেজ কোচিনের স্থানীয় হিন্দু রাজার সহায়তায় ব্যবসা জমিয়ে নিতে শুরু করেছেন। বিপরিতে অন্যান্য স্থানীয় হিন্দু বা মুসলিম রাজার তুলনায় কোচিনের রাজারও ব্যবসা ভালো জমে উঠছে, তিনিও খুশি। সবাই খুশি। খুশির জোয়ার বইছে । সেই খুশিতে যোগ দিতে স্বসৈন্যে এলেন আলফানসো ডি আল বুকার্ক।

আলফানসো এবারে পূর্ণ সামরিক পরিকল্পনাতেই এগুলেন। মাত্র পাঁচ বৎসরের মধ্যেই বাণিজ্য কুটিরের ছদ্মাবরণে কোচিনে তৈরি করলেন প্রথম দূর্গ। কেরালার রাজার ক্ষমতা হলো না বাধা দেবার, সে নিজেই তখন পর্তূগিজ বণিকদের হাতের পুতুল ! ১৫১০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় এলাকা গোয়া’য় প্রথম পর্তূগিজ কলোর্নি বানিয়ে ফেলেলেন। এতোদিন কোন না কোন স্থানীয় ভারতীয় রাজার উপরে নির্ভর করতে হতো, কিন্তু এবারে তাদের নিজেদের বসার জায়গা হলো অন্তত। এখান থেকেই তারা যুদ্ধ চালিয়ে গেল উপকূলব্যাপী ছোট ছোট মুসলিম সালতানাতগুলো বিরুদ্ধে।

কালিকটের জামুরিন হিন্দু রাজা পর্তূগিজ আগমণের সূচনা থেকেই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন আশে পাশের সকল মুসলমান বণিক ও যোদ্ধাদের নিয়ে মুসলিম সেনাপতি কুঞ্জ আলি এবং কুট্টি আলি’র সেনাপতিত্বে। সেই রাজাই শেষপর্যন্ত মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে পর্তূগিজদের সাথে সন্ধী করেন!
এ বিশ্বাসঘাতকতা পুরো মুসলমান সম্প্রদায়কে চরম ঝুঁকির মুখে ফেলে। হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক ও পারষ্পরিক আস্থায় মারাত্মক ধ্বস নামে। যে দু’টি সম্প্রদায় শত শত বৎসর পাশাপাশি বন্ধুর মত বসবাস করে এসেছে, তাদের সেই সম্পর্ক ও সম্প্রীতিতে অবিশ্বাস আসন করে নেয়।

স্থানীয় ছোট খাটো হিন্দু রাজারাও (যেমন; Kolathiri, Quilon এবং Purakkad প্রমূখ) প্রতিপক্ষকে পরাস্থ বা তাদের হাত থেকে নিজেদের রাজ্য রক্ষার জন্য পর্তুগিজদের আহ্বান করেছে, তাদের সহায়তা নিয়েছে। এ সুযোগকে পর্তূগিজরা কাজে লাগিয়েছে পুরোমাত্রায়। কোন ইউরোপীয় দখলদার শক্তি কর্তৃক সাফল্যজনকভাবে ভারতের একটি গোষ্ঠীকে অপর কোন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে কার্যস্বিদ্ধির ধারাও এখান থেকেই শুরু।
এভাবেই পর্তূগিজরা ১৫০৩ খৃষ্টাব্দে কোচিন, ১৫০৫ কান্নালৌর, ১৫১০ খৃষ্টাব্দে গোয়া এবং ১৫১১ খৃষ্টাব্দে মালাক্কা প্রণালী দখল করে দুরপ্রাচ্যের ইন্দোনেশিয়া থেকে আফ্রিকার মোজাম্বিক পর্যন্ত এক বিশাল নৌ রুটের উপরে নিজেদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে।

পায়ের নীচে মাটি শক্ত হয়ে গেলে তারা শত্রু মিত্র কাউকেই ক্ষমা করেনি। মালাবার উপকূলের পরাজিত মুসলমান, এমনকি, হিন্দুদেরও হত্যা করেছে, নারীদের রক্ষিতা বানিয়েছে, শিশু, যুবকদের দাস হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছে আটলান্টিকের ওপারে ওয়েস্ট ইন্ডিজে। আজও সেখানে হিন্দু-মুসলমান ভারতীয়দের বংশধররা বিদ্যমান। এই দাস ব্যাবসায় বহু হিন্দু ব্রাহ্মণ এবং গোয়ায় ভারতীয় নারীদের গর্ভে পর্তূগিজদের ঔরষে জন্ম নেয়া এ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা জড়িয়ে গেলে তারা অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছোঁয়া পায়। উন্নয়নের জোয়ার আসে স্পেন ও পর্তূগালেও! রাতারাতি সেখানে বিপ্লব ঘটতে দেখে ঘর ছেড়ে ছুটে আসে প্রতিবেশি ফ্রান্সও। শুরু হয় দেশ ও জনপদ দখলের মহোৎসব!

নিজেদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দে, তাতার ও ক্রুসেডারদের বর্বরতায় আব্বাসীয় খেলাফত ততোদিনে ইতিহাস। উমাইয়্যাদের তো আন্দালুস থেকে উৎখাত করেছে। মুসলিম উম্মাহর সামনে কোন অভিভাবক নেই এক ওসমানীয় খেলাফত ছাড়া। কিন্তু ওসমানীয় খেলাফত তখন পুর্ব ইউরোপের হাঙ্গেরি, ভিয়েনা, বুলগেরিয়া’সহ আশে পাশের নানা জনপদে অভিযানে ব্যস্ত। আর নিজেদের আভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বন্দ তাদেরও ছিল।

ঠিক এরকম একটা সময়ে আরও একটা ঘটনা ঘটে যায়, ভারতের বাইরে, কিন্তু ঘটনাটা পুরো ভারতের, এমনকি, পুরো মুসলিম বিশ্বের গতিধারাই বদলে দিয়েছে। সেটা হলো ‘সাফাউই’ বা ‘সাফাভি’ নামক কট্টর ও উগ্রপন্থী শিয়া গোষ্ঠীর নেতা শাহ আব্বাস পারস্যের ক্ষমতায় আসীন হন। উগ্রপন্থী, কট্টর সুন্নীবিরোধি এই গোষ্ঠী পারস্যের বুকে হাজার হাজার ইসলামিক স্কলার, সুন্নী আলেম, এমনকি, মধ্যপন্থী শিয়া আলেমদেরকেও নির্দ্বিধায় হত্যা করে। ইরানের বুকে দীর্ঘ সাড়ে আটশত বৎসর ধরে চলা ইসলামের গৌরবজনক অবস্থান থেকে বিচ্যুত করে শিয়া ধর্মকে ইরানের রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করে (১৫০১)। শুরু হয় এক ভিন্ন অধ্যায়।

এ সময় ভারতের লোকসংখ্যা ছিল আঠারো কোটি। ওদিকে ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে ইংল্যান্ড তখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো বস্তি। স্যাঁতসেঁতে কর্দমাক্ত জলাভুমিতে পচিশ লক্ষ মানুষের মানবেতর জীবন। আলু আর সমুদ্র বা নদীর মাছ পুড়িয়ে খেয়েই কোনমতে জীবন বাঁচায়। শতকরা ৯০জন গ্রামে বাস করে, সারা বসর রোগ আর মহামারীর মহোৎসবে গড় আয়ু মাত্র ৩৫ বসর, শতকরা ৯০জন শিশু প্রথম জন্মবার্ষিকির আগেই মারা যায়। খুন ডাকাতি লুটতরাজ অহরহ ঘটছে। শতকরা প্রায় পচাত্তর ভাগ থেকে আশি ভাগ লোকই দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে।

রাণী প্রথম এলিজাবেথ দিশেহারা। তাঁর এক পরামর্শক; বুড়ো দার্শনিক জন ডি (John Dee) পরামর্শ দিলেন বাইরের দেশ দখল করে ‘ব্রিটিশ এম্পায়ার’ প্রতিষ্ঠার। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘ব্রিটিশ এম্পায়ার’ বাক্যটি তিনিই উচ্চারণ করেন। বুড়োকে রাজদরবারের অন্যান্যরা তো বটেই, এমনকি, রাণীও পাগল ঠাউরেছেন। ঠাট্টা করেছেন। বেচারা বুড়ো জন ডি উপহাসের পাত্র হয়ে অনাদরে, অনাহারে একরম বিনা চিকিৎসায় মরেছেন। এ যেন আমাদের কবি ফররুখের মতো অবস্থা। পৃথিবীর সব দূরদর্শী মানুষগুলোকেই বোধ হয় অপরিণামদর্শী দেশবাসী এভাবেই প্রতিদান দেয়! জন ডি যে সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন পুর্তুগাল আর ফ্রান্সের ঘটনা বিবেচনায়, সেটা দেখার মতো জ্ঞানচক্ষু ছিল না ইংলিশ সমাজের অধিকাংশজনেরই।

পর্তূগালের নাটকীয় উত্থান শুনে এক ইংরেজ ব্যবসায়ী রালফ ফিচ (Ralph Fitch) ভাগ্যের সন্ধানে সেখানে যান, কিন্তু পাত্তা না পেয়ে নিরাশ হন। দেশে গিয়ে কি করবেন? খাবেনই বা কি? তাই দেশ না ফিরে পর্তূগিজরা যে দেশে গিয়ে ভাগ্য ফিরিয়েছে, সেই ভারত অভিমুখে যাত্রা করেন এবং একসময় এসে দক্ষিণ ভারতে নামেন। সবখানেই পর্তূগিজদের আধিপাত্য, কোন ইংলিশম্যানকে তারা পাত্তা দিতে রাজী নয়। ফলে বাধ্য হয়ে উত্তরে দিকে যাত্রা করলেন।
রালফ ভারতের জনপদকে খুব কাছ থেকে দেখতে থাকলেন। বর্ণবাদভিত্তিক এ সমাজে এক গোষ্ঠী অপর গোষ্ঠীর দ্বারা নিষ্পেষিত ও জর্জরিত। প্রতিটি গোষ্ঠী তার প্রতিদ্বন্দী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার সুযেগে থাকে। যে কোন মূল্যে তা গ্রহণও করে মনের ঝাল মেটাতে। এখানে প্রত্যেকে প্রত্যেকের শত্রু, বন্ধুত্বের ভান ধরে থাকে কেবল!

খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রালফের জন্য, একজন ইংরেজের জন্য। অচিরেই তিনি ভিড়ে যান সম্রাট আকবরের দরবারে (১৫৭৯)। সম্রাটের সাথে বন্ধুত্ব এবং মাত্র বসর দুয়েকের মধ্যেই খোদ রাণী এলিজাবেথের ব্যক্তিগত অনুরোধে আকবর তাকে মোগল দরবারে ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত হিসেবে বরণ করে নেন। শুরু হয় ইতিহাসের এক টার্নিং পয়েন্ট।

রালফ পানপেয়ালার বন্ধু আকবরকে পরামর্শ দিচ্ছেন কিভাবে তার রাজ্যকে নিরুপদ্রব রাখা যায়, আকবর বিনিময়ে তড়িঘড়ি গঠিত ইংলিশ কোম্পানি ‘ Elizabeth’s Levant Company ’কে (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পূর্বসূরী) ভারতে বিশেষ সুবিধায় বাণিজ্য, দিল্লিতে গির্জা প্রতিষ্ঠা, রাজপরিবারে খৃষ্টধর্ম শিক্ষা দেয়াসহ সবরকম সুবিধা দিয়েছেন (১৫৮৬-৮৮)।

ওদিকে সুন্নী মুসলমানদের হাতছাড়া হওয়া শিয়া ইরানে ইংরেজ দুই সহোদর; রবার্ট শালি আর উইলিয়াম শার্লি পর্যটকের ছদ্মবেশে এসে চাকুরি নিলেন শাহের অধিনে। ছোট ভাই রবার্ট শার্লিকে ইরানি সেনাবাহিনী আধুনিকায়নের দায়িত্ব দেয়া হলো (১৫৮৮)। মাত্র পাঁচ বসরেই ইরানের সেনাবাহিনী তাদের শক্তি পরখ শুরু করলো উসামানীয় খেলাফতের বিরুদ্ধে।

বসর দুয়েকের মধ্যেই (১৫৯১) ভারতে ‘হায়দ্রাবাদ’ নামক পুরোমাত্রায় শিয়া শহর প্রতিষ্ঠিত হলো সুলতান কুলি কুতুব কর্তৃক। ততদিনে দক্ষিণ উপকূলে পর্তূগিজদের প্রতিদ্বন্দী ফরাসি এবং ইংরেজ বণিকরাও হাজির। আর বিজাপুরের সুলতান আদিল খাঁন ও আহমেদনগরের শাসক নিজাম শাহ মিলে পর্তুগিজদের দূর্গ Chalyam মাটির সাথে মিশিয়েছেন (১৫৬৪)। ঐতিহাসিক শ্রীধারা মেননের মতে; ‘সেটাই ছিল ভারতে পর্তূগিজদের পতনের শুরু।’
তবে কারণটা ভিন্ন। নেহেরুর ভাষায়; ‘সে (ভারত) সব সময়ই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, কখনও সফল হয়েছে, কখনোবা ব্যর্থ। এমনকি, যখন সে ব্যর্থ হয়েছে, তখনও তার ব্যর্থতাকে স্মরণে রেখে সুযোগের অপেক্ষায় থেকে নিজেদের সেভাবেই তৈরি করেছে। তার কৌশল দুই ধরনের; লড়াই করে আগ্রাসী শক্তিকে তাড়িয়ে দেয়া, আর যাদের পরাজিত করা সম্ভব হবে না, তাদেরকে ভেতর থেকেই হজম করে ফেলা।’

ভারত পর্তূগিজদের হজম করে ফেলেছে। আল বুকার্ক আর ভাস্কো ডা গামা অগণিত ভারতীয়কে হত্যা করে তাদের স্ত্রী কন্যাদের বিয়ে করতে হুকুম দিয়েছিলেন নিজ সৈন্যদের। এভাবেই ভারতীয় সংস্কৃতির ছোবলে পর্তূগিজ শাসন হজম হয়ে যায়। ইংরেজরা ঢালাওভাবে ভারতীয় সাংস্কৃতি গ্রহণের ভূলটা করেনি। উল্টো তাদের জন্য সবচেয়ে বড়ো আতংক; ইসলামি সাংস্কৃতিকে কলুষিত করেছে, করিয়েছে ভারতীয় হিন্দু ও কট্টর শিয়াদের দিয়ে। সম্রাট আকবরকে তারা এ কাজে লাগিয়েছে।

হায়দ্রাবাদ ভারতের বুকে উগ্র শিয়ামতবাদের তীর্থস্থান হয়ে উঠলো। সাফাউই ইরান হতে সৈনিক, প্রশাসক, আলেম এসে ভারতে আসন গাড়লো। বিগত একটি শতাব্দি ক্রমাগতভাবে নির্যাতনের মুখে সুন্নী অনেক আলেম-ওলামা সুফীবাদের দিকে ঝুঁকে সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতি হতে সরে যাওয়ায় শুন্যস্থান পূরণ করলেন তারা এবং আরও বেশি কঠোর হলেন সুন্নী আলেমদের প্রতি। এ সময়ে ভারতের বুকে সুফিবাদের বিস্তার ঘটার কারণও এটাই।
আকবরের মা হামিদা বানু, তার অভিভাবক বৈরাম খাঁ, আবুল ফজল, তার ভাই ফৈজি শিয়া মতাদর্শী, আবুল ফজল শিয়া হয়েও ছিলেন পাঁড় নাস্তিক। তাদের বাবা শেখ মুবারাকও শিয়া। রিক্ত হাতে আসা এ পরিবার রাষ্ট্রীয় সুবিধা পেতে আকবরের দরবারে পরামর্শদাতা সেজে বসলেন। খুঁটির জোর দুটো; এক; কুরআন-হাদিসের জ্ঞান থাকায় বিকৃত ফতওয়া দেবার যোগ্যতা এবং দুই; প্রতিবেশি সাফাউই শাহের নেকনজর।

আকবরের আগে ভারতবর্ষে ক্রমাগত নয়টি মুসলিম রাজবংশ শাসন করলেও কেউই চল্লিশ বৎসরের বেশি টেকেনি। তাই আকবরের মনে রাজ্য হারাবার ভয় থাকায় তিনি সহজ পথ ধরলেন। Alexander Walker এর ভাষায় ‘আকবর অন্যান্য মহান ধর্মের সাথে ইসলাম ধর্মকে মিলিয়ে একটা সার্বজনীন সহনশীল ধর্ম উদ্ভাবনে সচেষ্ট হন, এটা আকবরকে তার অমুসলিম প্রজাদের কাছে প্রিয়পাত্র করে তোলে’।

রাজপুতরা নিজ কন্যা, বোন, আত্মীয়াকে আকবরের স্ত্রী হিসেবে রাজপ্রসাদে তুলে দিলে হিন্দু ধর্ম, সংস্কৃতি ও জীবানাচারের অবাধ অনুপ্রবেশে মোগল সাম্রাজ্যসহ পুরো মুসলিম সমাজ অস্তিত্তসংকটে পড়ে। মুসলিম শাসকরা জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য হারিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভোগবাদী ও বিলাসী শাসকে পরিণত হয়। প্রমাণ জাহাঙ্গির আর তার রাণীর শখের বশে মাছের নাকে হীরার নোলক পরানো, শাহজাহানের ৩ কোটি ২০লক্ষ রুপীতে (আধুনিক ২০ বিলিয়ন রুপী) তাজমহল, ১১৫০ কেজি সোনা, ২২৪ টি হীরা দিয়ে ময়ুর সিংহাসন, ১২ বিলিয়ন ডলারের কোহিনূর মুকুট তৈরি!
অথচ পচিশকোটি (১৭৫৬) ভারতবাসীর মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা, শিক্ষার আধুনিকায়ন ও বিজ্ঞানচর্চার কোন ব্যবস্থা হয়নি। জুন মাসের প্রচন্ড রোদে পা পুড়ে যাওয়া থেকে বাঁচতে এক জোড়া পুরোনো জুতো চুরির অপরাধে চোরের পা গোড়ালী হতে কেটে ফেলেন! আকবরে ন্যায়বিচারের নমূনা !!

বিগত আড়াইশত বসরে তৈরি হওয়া চরম বঞ্চনা, অপমান, শোষণ আর জুলুমে পরিপূর্ণ এরকম সমাজে যখন ইংরেজরা কিছু খুদ কুঁড়ো ছিটিয়েছে, দু’পয়সা কামানোর সুযোগ দিয়েছে, সেই সুযোগ নিতে সামান্য মুদি দোকানদার কান্তমুদি ছুটে গিয়েছে নিজ নবাব আলিবর্দীর বিরুদ্ধে হেস্টিংসকে সাহায্য করতে। বিনিময়ে মাত্র এক দশকেই কান্তমুদি ‘কান্তজমিদার’। একই পথে মীর জাফর থেকে ঘষেটি বেগম, রাজদূর্লভ প্রমূখ হেঁটেছে। নিজেদেরকে বঞ্চিত ভেবে প্রাপ্ত সুযোগ নিয়েছে।

সুযোগ নিয়েছে ইংরেজরাও। ভারতবাসীর আত্মকোন্দলের সুযোগে দীর্ঘ ১৯০ বসরে নিয়ে গেছে ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার! চলতি অর্থবসর (২০২১-২২) বাংলাদেশের প্রস্তাবিত বাজেট ৭২ বিলিয়ন ডলার; এ যাবতকালের সর্ববৃহৎ। চুরি হয়ে যাওয়া ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলারে বাংলাদেশ দীর্ঘ ৫৯৮ বসর একটা পয়সা না কামিয়েও ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে পারতো!

অবস্থার কি পরিবর্তন হয়েছে? আজও কি নিজেরা আত্মকলহে নিমগ্ন নেই? আজও কি অর্থনৈতিক বৈষম্য, জুলুম নির্যাতন আর অবিচার সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যমান নেই? আজও কি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার চুরি হয়ে যাচ্ছে না? আজও কি আমরা এক গোষ্ঠীকে অপর গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছি না? আমরা কি নিজেদের সাংস্কৃতিক স্বকীয়তাকে বিসর্জন দিচ্ছি না? অবলীলায় জুলুম করছি না? জুলুম করে নির্লজ্জের মতো ক্ষমতার বড়াই দেখাচ্ছি না? আজকের বঞ্চিত নির্যাতিত আর নিপীড়িতরাই নিশ্চিত একদিন ঘষেটি বেগম, মীর জাফর হবে প্রতিশোধ নিতে। অপেক্ষা কেবল উপযুক্ত সময় ও সুযোগের!

অর্থাৎ আরও একটা পলাশীর সকল পথই খোলা রয়েছে আজও। পলাশীর পূনরাগমণ ঠেকানোর পথ একটাই; ইনসাফ ও ন্যায় বিচার, মানবিক মর্যাদা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা এবং জাতিয় ঐক্যের সাথে সাথে ‘সবার আগে আমার দেশের স্বার্থ, তারপরে অন্য কিছু’ এই চেতনা ধারণ ও লালন করার মধ্যেই।

লেখকঃ ইংল‍্যান্ডের বেসরকারী মানসিক হাসপাতালের সাবেক সহকারী পরিচালক ও লেখক, ইংল‍্যান্ড

লেখকের প্রকাশিত আরও লেখা পড়ুন-

ফিলিস্তিন বিবাদে আরব নেতৃত্ব, ইতিহাসের এক ঝলক

 

আরও পড়ুন