Ads

চিরন্তন (ইউনিভার্সাল / Universal) ১৪৪ ধারা ও আজকের মুসলমান!

জিয়াউল হক

দ্বিতীয় হিজরিতে (৬২৮ খৃ:) কিবলা পরিবর্তনের ঘটনা। মদিনায় এতোদিন যে কিবলার দিকে মুখ করে মুসলমানরা নামাজ আদায় করেছেন,মসজিদুল আকসা, সেটিই ছিল তাদের প্রথম কিবলা এটি জেরুজালেমে অবস্থিত। এই মসজিদের কারণেই জেরুজালেমকে বায়তুল মোকাদ্দাসকে বা আল-কুদ্স শরীফও বলা হয়। ঐতিহাসিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ নগরীতে অসংখ নবী-রাসূলের আগমন ঘটেছে। আল্লাহ পাক নিজেও এ নগরী ও তার আশে পাশের অঞ্চলকে বরকতময় হিসেবে অভিহিত করেছেন। এই বায়তুল মুকাদ্দাস’ই বিখ্যাত নবী হযরত দাউদ (আ.) ও হযরত সোলাইমান (আ.)-এর রাজধানী ছিল। হযরত সোলাইমান (আ.) কর্তৃক নির্মিত গম্বুজবিশিষ্ট সেই বিখ্যাত মসজিদ আজও টিকে আছে।

বিশ্ব মানবসভ্যতার কালচারাল ইভুলেশনও বা সাংস্কৃতিক ও বুদ্বিবৃত্তিক আত্মপ্রকাশ ও বিস্তারও এই জেরুজালেমের বুকে চর্চিত জ্ঞান ও চিন্তা চেতনার উপরে ভিত্তি করেই হয়ে এসেছে এতোদিন। ল্যাটিনো হেলেনিক এবং মিশরের ফারাও সভ্যতা কিংবা আলেকজান্দ্রিয়া হেলেনিক সভ্যতার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ, যার কথাই বলুন না কেন, তাদের গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে এই জেরুজালেমের বুকে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার হাত ধরে।

অথবা পাশাপাশি সমান্তরালভাবে চলতে চলতে একসময় তা জেরুজালেমের বুকে আত্মপ্রকাশ করা তালমুদীয় ও খৃষ্টদর্শনের সাথে মিশে গিয়ে বিশেষ আকার ও রুপ পরিগ্রহ করেছে। মানবসভ্যতার বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষতা ও বিন্যাসের ক্ষেত্রে কয়েক হাজার বসরের এ এক দীর্ঘ পথপরিক্রমা। আধুনিক বিশ্বের বুকে প্রচলিত সকল অনৈসলামিক মতবাদও এই চিন্তামানসের উপরেই প্রতিষ্ঠিত।

এই যে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের কেন্দ্র হয়ে উঠা, সেটাই মসুজিদুল আকসা বায়তুল মুকাদ্দাস, তথা, জেরুজালেমকে ইতিহাসের পাতায় এক অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করে রেখেছিল। এই অনন্য উচ্চ মর্যাদার কেন্দ্রবিন্দুতে আসীন ছিল আল্লাহর প্রিয় নবী হযরত ইয়াকুব আ: এর পরবর্তি বংশধর; ইহুদি গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর মধ্যেই হযরত দাউদ আ:, সুলাইমান আ:, মুসা আ: এবং ইসা আ:’সহ আরও অনেক নবী রাসুলের আগমন।

কাজেই ইহুদিদের গোত্র মর্যাদা এবং সেই সাথে অত্র এলাকার ভৌগলিক গুরুত্বের পাশাপাশি এখানকার বুদ্ধিবৃত্তিক সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অবস্থান ছিল অত্যন্ত মর্যাদাকর। এই উন্নত অবস্থান এখানকার অধিবাসী ইহুদিদের সামাজিক মর্যাদা একটা বিশেষ স্তরে উন্নিত করেছিল, বিশেষ ধরনের ছিল তাদের মনস্তাত্তিক স্তরও। ফলে তারা বিশ্বের অন্য কোন গোষ্ঠী ও মতবাদকেই মেনে নিতে বা তাদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতে আদৌ প্রস্তুত ছিল না।

এরকম একটা প্রেক্ষাপটেই ইহুদি গোত্রের বাইরে, তাদেরই একটা প্রতিদ্বন্দী গোত্রের মধ্য হতে প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: এর আগমন নবুওয়াত নিয়ে। এর আগে দাউদ আ: কিংবা সোলাইমান আ:, মুসা আ: কিংবা ইসা আ: সকলের শিক্ষা ও দর্শন ছিল বিশেষ গোষ্ঠী ও গোত্রের জন্য, কিন্তু এবারে মুহাম্মদ সা: যে দাওয়াত তুলে ধরলেন, তা ছিল সারা বিশ্বের সকল মানুষের জন্যই। একটা বৈশ্বিক বা গ্লোবাল আহবান।

এ আহবানটা ছিল অন্য সকল গোষ্ঠী ও গোত্রের মত ইহুদিদের জন্যও। কাজেই তাদের টনক নড়ার যথেষ্ঠ কারণও ছিল। তাদের যে জাতীয় চরিত্র ও মনস্তাত্তিক বৈশিষ্ঠের কথা বলেছি তার ভিত্তিতে তারা প্রথম থেকেই মুহাম্মদ সা: এর আহবানকে অস্বীকার করেছে।

মুহাম্মদ সা: এবং তার সতীর্থ মুসলমানরা এতোদিন, তথা, নবুওয়তের শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রায় পনোরোটি বসর বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে মুখ করেই নামাজ আদায় করে এসেছেন। আল্লাহর কুরআনের আহবানকে মেনে নিতে অস্বীকারকারী গোষ্ঠী ইহুদিদের সাথে সাংস্কৃতিক কেন্দ্রভূমির কোন দৃশ্যমান পার্থক্য ছিল না। এ যেন উভয় গোষ্ঠীই একই সাংষ্কৃতির ধারক বাহাক।

আজ হঠাৎ করেই সেই সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচয়কে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করলেন মুসলমানরা। তারা মুখ ঘুরিয়ে নিলেন ভিন্ন দিকে। আল্লাহপাক ওহি পাঠালেন; ‘নিশ্চয়ই আমি আপনাকে বার বার আকাশের দিকে তাকাতে দেখি। অতএব, অবশ্যই আমি আপনাকে সে কিবলার দিকেই ঘুরিয়ে দেব যাকে আপনি পছন্দ করেন। এখন আপনি মসজিদুল-হারামের দিকে মুখ করুন এবং তোমরা যেখানেই থাক, সেদিকে মুখ কর। যারা আহলে-কিতাব, তারা অবশ্যই জানে যে, এটাই ঠিক পালনকর্তার পক্ষ থেকে। আল্লাহ বেখবর নন, সে সমস্ত কর্ম সম্পর্কে, যা তারা করে। (সুরা বাকারা : ১৪৪)।

দয়া করে আল কুরআনের আয়াত বা ধারা নম্বরটি লক্ষ্য করুন। সম্পূর্ণ নতুন একটি নির্দেশনা! চিরদিনের জন্য বিশ্বের সকল মতবাদ, মতাদর্শ ও সংস্কৃতিকে পরিত্যাগ করার নির্দেশ। এর বিপরিতে সারা বিশ্বের সকল মানুষের জন্য যে কাবাঘর (সুরা আলে ইমরান: ৯৬), সেই কাবাঘর কেন্দ্রিক বৈশ্বিক বা গ্লোবাল যে মতবাদ সেই ইসলামকে ভিত্তি করে যে চিন্তা, জ্ঞান ও সাংস্কৃতি গড়ে উঠছে, তার দিকে মুখ ফেরানোর নির্দেশনা এটা। সেই কাবার মালিকের প্রশ্নাতিত আনুগত্যের নির্দেশ ও দাসত্বের নির্দেশ রয়েছে অন্যত্রও (সুরা কুরাইশ দ্রষ্টব্য)।

খুব গভীরভাবে ভেবে দেখুন, নির্দেশনা প্রতিটি মুসলমানের জন্য একটা স্থায়ী, অপরবির্তণীয় ধারা। এ ধারা বলে আল্লাহ পাক আল কুরআন ব্যতিরেকে অন্য যে কোন দর্শন ও মতবাদ ভিত্তিক জীবনব্যবস্থা, চিন্তা দর্শন ও সংস্কৃতির অনুবর্তি হবার উপরে স্থায়ীভাবে, চিরন্তন ১৪৪ ধারা জারি করে রেখেছেন!

আজ যে সব মুসলমানরা আধুনিকতা, মুক্তবুদ্ধি, উদারনৈতিকতা কিংবা প্রগতিবাদীতা চর্চার নামে নানা মত ও পথের দাসত্ব করে চলেছেন, তারা জেনে বা না জেনে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আল্লাহর এই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে চলেছেন। তাদের উচিৎ সময় থাকতেই বিশ্বের তাবৎ মতবাদকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করা, আর তা না হলে এর খেসারত তাদেরকে ঠিকই আল্লাহ সামনে দাঁড়িয়ে দিতে হবে। অতএব সাবধান।

লেখকঃ ইংল‍্যান্ডের বেসরকারী মানসিক হাসপাতালের সাবেক সহকারী পরিচালক ও লেখক, ইংল‍্যান্ড

আর পড়ুন-

যে কারণে বার বার ‘পলাশী ’ আসে

 

আরও পড়ুন