Ads

কর্মজীবী মায়ের মাতৃত্ব

রোকসানা বিনতী

নীতিবোধ ,অধিকারবোধ, দায়িত্ববোধ সবকিছু ছাপিয়ে একজন কর্মজীবি মায়ের যে বোধটা সবচেয়ে বেশি বড় হয়ে দাঁড়ায় তা হল অপরাধবোধ। সারাক্ষণ কেমন যেন একটা অপরাধী অপরাধী অনুভুতি। বিশেষ করে বাচ্চার কোন সমস্যায় এই বোধ আরও বেশি প্রকট হয়ে দাঁড়ায়। সবসময় মনে হতে থাকে আমি ঠিকমত সময় দেই না বলেই হয়ত বাচ্চা অসুস্থ হয়েছে, বাচ্চা রেজাল্ট খারাপ করেছে, পরে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে ইত্যাদি। নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে থাকতে থাকা মায়ের এই বোধটা আরো বেশি উসকে দেয় আশেপাশের মানুষজন।

আমার নিজের কথা বলি- আমার মেয়ের বয়স একুশ মাস। আমার বাসা আমার বাবা মায়ের বাসার পােেশেই আর বাবুকে রেখেও আসি উনাদের কাছে। একজন কর্মজীবি মায়ের জন্য এর চাইতে ভালো সুবিধা আর কিছু হতে পারে না। বাচ্চা নিয়ে কোন টেনশনই নাই! সারাদিন আরামসে অফিস করি , বাসায় গিয়ে প্রথমে রান্না বান্না করে তারপর বাবুকে আনতে যাই। কিন্তু তারপরও আমি মাঝে মাঝে অস্থিরতা ও অপরাধবোধে ভুগি! সময়ের সাথে দৌড়াই সারাটাক্ষণ। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করার চেষ্টা করি যেন বাবুকে একটু বেশি সময় দিতে পারি কিন্তু কিসের কি? সেই রাত নয়টা বেজেই যায় সবকিছু সামলে উঠতে উঠতে। বাবু ঘুমিয়ে যায় বারোটার দিকে। সারাদিনে মাত্র তিনঘন্টা মেয়েটা মাকে পাচ্ছে ! মাত্র তিনঘন্টা !

পরিবারের থেকে সর্বোচ্চ সাপোর্ট নিয়েও আমি এর বেশি সময় আমার মেয়েকে দিতে পারছি না। মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে যাই। খুব মন খারাপ লাগে, কোন কাজ মনোযোগ দিয়ে করতে পারি না। তখন আমার সবকিছুতেই মন খারাপ হয়।

ক্রন্দনরত বাচ্চাকে রেখে এসে যখন অফিসের উদ্দেশ্যে রিক্সায় উঠি তখন মন খারাপ লাগে, আমি বাসায় আসার পর বাচ্চাটা যখন খুশিতে লাফায় তখনও মন খারাপ লাগে, আমি ওয়াশরূমে ফ্রেশ হতে গেলে যখন দরজায় দাঁড়িয়ে আম্মা আম্মা বলে ডাকে তখন মন খারাপ লাগে এমনকি ও ঘুমিয়ে গেলেও আমার তখন মন খারাপ লাগে! মনে হয় ও কেন আরেকটু সময় জেগে থাকলো না ,তাহলে আমার সাথে আরেকটু খেলতে পারতো! আর অসুখ-বিসুখ হলে তো কথাই নেই, মনে হয় সব দোষ আমার। আমি ঠিকমতো যত্ন করতে পারিনি বলেই ও অসুস্থ হয়েছে।

এ তো গেলো একটা দিক। অন্যদিকে আবার যখন দেখি আমার আম্মু আব্বু বাবুকে দেখাশোনা করতে গিয়ে নিজেদের স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছেন না তখন অন্যরকম একটা অপরাধবোধে ভুগি। আম্মু আব্বুর কোথাও ঘুরতে যাওয়া, বই পড়া ,রিলাক্স করা, ইবাদত করা, দৈনন্দিন কাজকর্ম সবকিছুই এখন বাবুর সাথে এডজাস্ট করে করতে হচ্ছে। হয়তো কোথাও যাওয়া দরকার তারজন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে আমি কবে বাসায় থাকবো । হয়তো শরীর খারাপ লাগছে, বাবু তো সেটা বুঝবে না । খারাপ শরীর নিয়েই বাবুকে সময় দিতে হচ্ছে। বাবুর খাওয়া, গোসল, ঘুম সবই তো উনাদেরই করতে হচ্ছে। আর এই বয়সের বাচ্চাদের এক মুহুর্তও চোখের আড়াল করা যায় না। অন্যান্য সব বাচ্চাদের মতো আমার মেয়েও খেতে চায় না, গোসল করতে গেলে আর আসতে চায় না, ঘুম পেলে ঘ্যান ঘ্যান করে। তার পছন্দমতো খেলনা না খুঁজে পেলে অস্থির করে ফেলে। সারাদিন বাবুর এতসব হ্যাপা সামলে যখন আম্মু রাতে বলে যে তার কোমর ব্যথা করছে তখন একটা অপরাধবোধ আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আসলে এই কাজগুলো তো আমার করা উচিত কিন্তু আমি কর্মজীবি মা বলে করতে পারছি না। আমার ক্যারিয়ারের জন্য আমার মা বাবার আরাম বিসর্জন দিতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে ভাবি ,আমি তো তাও অনেক সুবিধা পাচ্ছি , কেউ কেউ তো এইটুকুও পাচ্ছে না। তাদের জীবনযাপন তাহলে আরো কত কঠিন !

সব কর্মজীবি মায়েরাই অপরাধবোধে ভোগে। কেউ কম কেউ বেশি। দিন শেষে একবার হলেও বাচ্চার কথা ভেবে মন খারাপ হয়। বাচ্চার জন্য জীবনের সব আনন্দ ,সব আহলাদ স্যাক্রিফাইস করা সত্ত্বেও কর্মজীবি মা যেন কখনোই পুরোপুরি মা নয়। সমাজ, সংসার, আত্মীয়, বন্ধু সবাই প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিবে যে মা বাচ্চার সম্পূর্ণ দেখাশোনা করতে পারেনি।

এমনকি অনেকে এভাবেও বলে যে- তুমি কিভাবে থাকো এতোক্ষণ এতো ছোটো বাচ্চা বাসায় রেখে? আমি হলে তো বাবা জীবনেও পারতাম না! কিংবা বাচ্চার কোন সমস্যায় প্রথমেই যে মন্তব্য তা হল- মা সময় না দিলে তো বাচ্চার এমন হবেই! এছাড়া ইদানীং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কর্মজীবি মায়েদের গুষ্ঠি উদ্ধারে ব্যস্ত থাকেন অনেকে। সেই সাথে নিজের মধ্যে পুষে রাখা আত্মগ্লানি তো আছেই। সবকিছু মিলিয়ে ,সবকিছু ম্যানেজ করেও দেখা যায় একজন চাকুরীজীবি মা অপরাধবোধে ভুগছেনই।

এতসব সমস্যা –অসুবিধা থাকার পরও প্রতিটা দিন নতুনভাবে নতুন উদ্যোমে শুরূ করি। যে অল্প কয়েকটা ঘন্টা বাবুকে পাচ্ছি তার সবটুকু দিয়ে আনন্দ করার চেষ্টা করি। নতুন নতুন খেলা আবিষ্কার করি। বাবুর সাথে গান গাই,নাচানাচি করি।

আমার মেয়ে আমার গানের একমাত্র ও একনিষ্ঠ শ্রোতা, নাচের মুগ্ধ দর্শক! আমার সাথে সেও নাচে ! গান গায়! আমরা বই পড়ি, বইয়ের ছবি দেখি। ওর চোখ দিয়ে পৃথিবীটা দেখার চেষ্টা করি। ওর আবেগগুলো বোঝার চেষ্টা করি। আমার প্রতি ওর নির্ভরশীলতা উপভোগ করি। সারাদিন মনে যতখানি অপরাধবোধ ছিল তা যেন ওই তিন ঘন্টায় ফুঁৎকারে উড়ে যায়। সেই সাথে পেয়ে যাই পরের দিন নিজের মনের সাথে লড়াই করার শক্তি!

সারা দুনিয়া যতই আমাকে কর্মজীবি মা বলে আমার মার্তৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করূক না কেন আমার প্রতি আমার মেয়ের ভালোবাসা, নির্ভরশীলতা আমার মার্তৃত্বকে পরিপূর্ণ করেছে। মনের মধ্যে পুষে রাখা আত্মগ্লানি দূর করার জন্য আমার মেয়ের এক টুকরো হাসি, একবার আম্মা ডাকই যথেষ্ঠ। কর্মজীবি মা হয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে টিকে থাকার মনের জোর পাই আমার সন্তানের কাছ থেকেই! বাচ্চাকে একবার জড়িয়ে ধরেই মুক্তি পেয়ে যাই সমস্ত অপরাধবোধ থেকে! আমার মার্তৃত্বই আমার শক্তি!

চাকুরীজীবি বা গৃহিনী, ভালো থাকুক সব মায়েরা । ভালো থাকুক সব সন্তানেরা……।

আরও পড়ুন