।। শিমুন লিজা ।।
আজকের যুগে নারীর অধিকার, মর্যাদা এবং স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা পৃথিবীজুড়ে গুরুত্ব পাচ্ছে। নারীর অবস্থান এবং তার সমাজে ভূমিকা নিয়ে বৈচিত্র্যময় দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান। ইসলামের দৃষ্টিকোণ, নারীবাদ এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ—এই তিনটি ধারণা সমাজে নারীর মর্যাদা ও স্বাধীনতার সম্পর্ক এবং সংঘাতকে ব্যাখ্যা করে। তবে প্রশ্ন হলো, এই তিনটি ধারায় কি সত্যিকার অর্থে সংঘাত রয়েছে, না কি তারা একে অপরকে ব্যাখ্যা দিতে পারে? এটি এমন একটি প্রশ্ন, যা শুধুমাত্র ঐতিহাসিক, ধর্মীয়, এবং দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং মানবিক ও সামাজিক চিন্তাধারার জায়গা থেকেও গভীরভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
নারীবাদ: অধিকারের দাবিতে সংগ্রাম
নারীবাদ বা ফেমিনিজম হলো একটি সামাজিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলন, যা নারীর সমতা, মর্যাদা এবং স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে। নারীবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, একমাত্র নারীর স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হলে, সমাজের সামগ্রিক উন্নতি সম্ভব। নারীবাদীদের অনেক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, যেমন:
লিবারেল নারীবাদ: নারীর আইনগত সমতা নিশ্চিত করতে চায়।
রেডিক্যাল নারীবাদ: সমাজের প্রতিষ্ঠিত কাঠামো এবং পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানায়।
সোশ্যালিস্ট নারীবাদ: নারীর শোষণ এবং শ্রেণীবৈষম্য নিয়ে কাজ করে।
ইসলামিক নারীবাদ: ইসলামের আলোকে নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা।
নারীবাদ এক দিকে নারীর অধিকার ও স্বাধীনতার কথা বলে, তবে একই সঙ্গে এটি সমাজের সকল সদস্যের জন্য সমতা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়। যেমন, বেল হুকস বলেছেন, “Feminism is for everybody.” অর্থাৎ, নারীবাদ শুধুমাত্র নারীদের জন্য নয়, এটি সমাজের সব সদস্যের জন্য, যেখানে সমতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ: স্বাধীনতার একক অধিকার
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ বা Individualism একটি দার্শনিক চিন্তা, যা বলে যে, প্রতিটি ব্যক্তি তার জীবন, পছন্দ এবং সিদ্ধান্তের একক মালিক এবং এই সিদ্ধান্ত অন্যদের দ্বারা নির্ধারিত হবে না। এটি স্বাধীনতা এবং নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ অর্জন করার প্রতি গুরুত্ব দেয়। নারী যদি তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বাধীনতা পেতে চান, তবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ তাকে সেই সুযোগ দেয়। তবে, ব্যক্তি স্বাধীনতা যদি সমাজের বা ধর্মের নৈতিকতার বিরুদ্ধে চলে যায়, তখন তা সমাজের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। ইসলাম স্বাধীনতাকে সমর্থন করে, তবে নৈতিকতার এবং সামাজিক দায়িত্বের ভিতর সীমাবদ্ধ রেখে।
আরও পড়ুন-
নারীর মর্যাদা ও আধুনিক বিভ্রান্তিঃ ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক বাস্তবতা
ইসলাম: নারী ও স্বাধীনতার ভারসাম্য
ইসলাম নারীর জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা প্রদান করেছে, যেখানে নারীর অধিকার, মর্যাদা এবং দায়িত্ব সব কিছুই স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলাম নারীর স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা জানায়, তবে তা স্বাধীনতা, নৈতিকতা, সম্মান এবং ধর্মীয় নির্দেশনা দ্বারা সীমাবদ্ধতার মধ্যে। ইসলামী দর্শন অনুসারে, নারীর স্বাধীনতা কোনোভাবেই সমাজের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে না।ইসলাম মনে করে এটি বিশ্বস্ততার, সম্পর্কের সম্মান এবং ধর্মীয় আদর্শের মধ্যে সমন্বিত হওয়া উচিত।
কোরআনে সূরা নিসায় আল্লাহ তায়ালা পুরুষকে নারীর অভিভাবক হিসেবে উল্লেখ করেছেন । তার মানে এই না যে পুরুষ হওয়ার জন্য তিনি পুরুষকে নারীর চেয়ে বেশি মর্যাদাবান করেছেন, বরং নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য তিনি পুরুষকে নারীর তত্ত্বাবধায়ক করেছেন । আল্লাহর কাছে মানুষের মর্যাদার মাপকাঠি হচ্ছে তার তাকওয়া তথা ধর্মভীরুতা । আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেছেন,
“তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে ব্যক্তিই বেশী মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে বেশী তাকওয়াসম্পন্ন।” (সূরা হুজরাত, ১৩)
ইসলামে নারীর অধিকার ও মর্যাদা সুনিশ্চিত করার জন্য আল্লাহ স্বীয় বিধান প্রবর্তন করেছেন। মুসলিম নারীরা স্বামীর কাছে সম্মান, শিক্ষার অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, এবং পারিবারিক সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণের অধিকার রাখেন। আল্লাহর রাসুল সাঃ বলেছেন,
“তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম আচরণ করে ।” [ তিরমিজি ]
ইসলামে নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা:
ইসলামে নারীর ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। হযরত খাদিজা (রা.) একজন সফল ব্যবসায়ী এবং ইসলামের প্রথম সমর্থক ছিলেন। তিনি তাঁর জীবনে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, ধর্মীয় অবদান, এবং নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছিলেন।
অন্যদিকে, হযরত আয়েশা (রা.) ইসলামের অন্যতম শীর্ষ জ্ঞানদাত্রী এবং ২২০০ হাদীস বর্ণনা করেছেন, যা মুসলিমদের জন্য আজও শিক্ষা ও অনুপ্রেরণার উৎস। ইসলামের ইতিহাসে হযরত ফাতিমা (রা.) তার ধর্মীয় আদর্শ, আত্মত্যাগ, এবং উচ্চতর নৈতিকতা নিয়ে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
এছাড়াও, বেগম রোকেয়া একজন সামাজিক আন্দোলনকারী, তিনি মুসলিম সমাজে নারীশিক্ষা ও আত্মমর্যাদার প্রবর্তক ছিলেন। তিনি বলেছেন, “নারী যে মানুষ—এই সহজ সত্যটি আমরা বহুবার ভুলে যাই।”
আরও পড়ুন-
নারীবাদ এবং ইসলামের মধ্যে সংঘাত: কোথায় সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্ব?
ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে, নারী তার জীবনযাত্রায় স্বাধীনতা পেতে পারেন, তবে সেই স্বাধীনতা ধর্মীয় নীতির সাথে একাত্ম হতে হবে। অন্যদিকে কিছু নারীবাদী ধারায় দেখা যায়, স্বাধীনতা ইসলামিক মূল্যবোধ ও সামাজিক কাঠামোর বিরুদ্ধে চলে যায়।
এখানে নারীবাদী চিন্তাবিদদের মধ্যে কিছু দ্বন্দ্ব তৈরির আশঙ্কা থাকে। শরীরের অধিকার, পোশাক এবং সম্পর্কের স্বাধীনতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কিছু কিছু নারীবাদী চিন্তা আলাদা ধারণা রাখে। কিন্তু এক্ষেত্রে, ইসলাম এই স্বাধীনতাকে নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সীমাবদ্ধ রাখে।
মুক্তির পথ: সংঘাত থেকে সমঝোতার দিকে যাত্রা
নারীর অধিকার, মর্যাদা এবং স্বাধীনতা নিয়ে ইসলাম এবং নারীবাদী আন্দোলনকে একটি সুশৃঙ্খল সমঝোতার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। ইসলামে নারীকে তার অধিকার দেওয়ার পাশাপাশি, তার নৈতিকতা ও সামাজিক দায়িত্ব নিশ্চিত করা হয়। যারা ইসলামের মাধ্যমে নারীর অধিকার সুনিশ্চিত হয় বলে বিশ্বাসী আর যারা তথাকথিত নারীবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে নারীর অধিকার আদায়ে বিশ্বাসী তারা উভয়েই যদি ইসলামের মানবিকতা এবং নারীবাদী আন্দোলনের কারণ বুঝে এবং সম্মান করে, তবে নারীর স্বাধীনতা এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে একটি সুন্দর, ন্যায়সঙ্গত এবং মানবিক পথ সৃষ্টি করা সম্ভব। সবশেষে বলা যায় যে,
তথাকথিত নারীবাদীরা যদি ইসলামের মধ্যে নারী স্বাধীনতার বিকল্প ব্যাখ্যা অনুসরণ করেন, তবে তারা অনেক বড় সমস্যার সমাধান পেয়ে যেতে পারেন।
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল, আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেইজ মহীয়সী/Mohioshi-তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হ্যাঁ, মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইল-
[email protected] ও [email protected] -এ; মনে রাখবেন, “ধন দৌলত খরচ করলে কমে যায়, কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়”। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকেই দ্বীনি জ্ঞান দান করেন।” (সহিহ বুখারী- ৭১, ৩১১৬, ৩৬৪১, ৭৩১২, ৭৪৬০; মুসলিম- ১০৩৭; ইবনে মাজাহ- ২২১) ।
মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম; আজই আপনি যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে। আসুন, ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ, সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি। আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমীন।