।। ড. মো. নূরুল আমিন ।।
বৃন্দাবনের নাম পাঠকদের অনেকেই শুনেছেন। শতাব্দীকাল ধরে এই বৃন্দাবনকে বাঙালি হিন্দু বিধবাদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। কোনও বিধবার যদি সেখানে মৃত্যু হয়, তাহলে সে মোক্ষ লাভ করে বলে একটা ধারণা-বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। অবশ্য বৃন্দাবন সম্পর্কে আলোচনার আগে আমি হিন্দু বিধবাদের সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা জরুরি বলে মনে করি।
সধবা হিন্দু মহিলারা সর্বদা পতিকে ‘সতির দেবতা’ হিসেবে গণ্য করে আসতো। এই পতিকেন্দ্রিক মহিলাদের ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী ‘পতি হো তো ঘর হো, পতি নাহি তো ঘর নাহি’ অর্থাৎ স্বামী আছে তো ঘর আছে, পরিবার আছে, স্বামী নাই তো ঘরও নেই পরিবারও নেই। বিধবাদের পুনর্বিবাহের প্রচলন না থাকায় স্বামীর মৃত্যুর পর মহিলারা চরম দুর্দশার শিকার হতো। পিতৃগৃহে তাদের স্থান হতো না। পৈতৃক সম্পত্তির যেমন তাদের উত্তরাধিকার ছিল না তেমনি স্বামীর সম্পত্তির উপরও তাদের বৈধ অধিকার ছিল না। পুত্রের সংসারেও তারা ছিল অবাঞ্ছিত। এলাকায় সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া সারা ভারতবর্ষে বিধবাদের অবস্থা প্রায় একই রকম ছিল। একটি মাওড়ারী প্রবাদে সম্ভবতঃ বিধবাদের সম্পর্কে সাধারণ ধারণার একটা প্রতিফলন পাওয়া যায়। প্রবাদটি হচ্ছে-
‘‘তিতার ভরানি বাদলী
না বিধওয়া কাজল রেখ
বা বরষে বা ঘর করে
বি মি মিন না মেখ’’
অর্থাৎ ‘মেঘ দেখে তিতির পাখির মনে যদি রং ধরে তখন পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, বৃষ্টি অবশ্যম্ভাবী। একইভাবে বিধবারা যদি কাজল পরে তখন সংসার ধ্বংসের বিষয়টিও নিশ্চিত হয়ে ওঠে।’ এই অবস্থায় ভারতবর্ষের হিন্দুসমাজে বিধবাদের আত্মহত্যাই ছিল মুক্তির একমাত্র পথ। জি বাংলার সুবর্ণা নাটকে বাল্য বিধবা মল্লিকার দুঃখ-গ্লানি ও অবজ্ঞার যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা আসলে তাদের প্রকৃত অবস্থার এক-সহস্রাংশ থেকেও কম। বিধবাদের এই গ্লানিকর অবস্থা থেকে মুক্ত করার একটা প্রচেষ্টা হিসেবে হিন্দু ভারতের সমাজপতি ও ধর্মবেত্তারা সহমরণ প্রথার প্রচলন করেছিলেন। এই রীতি অনুযায়ী মৃত স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় বিধবা স্ত্রীকে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুকে বরণ করতে হতো। কিন্তু এরপরও পরিবার-সমাজের জঞ্জাল হিসেবে অনেক হিন্দু বিধবা বেঁচে থাকতো। এদেরই একাংশের জন্য (যারা পিতা-মাতা, ভাই, পুত্র, কন্যা ও স্বামীর স্বজনদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হতেন) হরদ্বার, গয়া, কাশি, হৃষীকেশ, বৃন্দাবন প্রভৃতি স্থানে আশ্রম গড়ে তোলা হয়েছিল। এই আশ্রমসমূহ তাদের তীর্থ স্থান হিসেবেও পরিচিত হয়ে আসছে। এই তীর্থ তৈরির আগে ভাগ্যবতি দু’একজন ছাড়া বৃদ্ধা ও মধ্যবয়সী বিধবারা ভিক্ষা করে দিনাতিপাত করতো।
এখন বৃন্দাবনের কথায় ফিরে আসি। হিন্দু বিধবাদের দুঃসহ অবস্থা থেকে রক্ষা করার জন্য ১৯১০ সালে একজন বিত্তবান মাওড়ারী বৃন্দাবনে একটি ভজন আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এই আশ্রমে যে কোনও সময়ে ২০০০ বিধবার থাকার ব্যবস্থা রয়েছে এবং বাঙালি বিধবাদের এটা হচ্ছে প্রধান আশ্রম। প্রথম অবস্থা থেকে এখানে কীর্তন গাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে এবং এজন্য তাদের দৈনিক এক টাকা করে মজুরি দেয়া হতো যদিও এখন রেইট একটু বেড়ে তিন টাকা হয়েছে। এই আশ্রম দেখার আমার সুযোগ হয়েছিল। অন্ধকার কারাগারের আলোবাতাসহীন গুহাসদৃশ কক্ষে বিধবারা থাকেন। ভোর ৫টায় তাদের ঘুম থেকে ওঠে জানালাবিহীন একটি হল ঘরে একত্র হয়ে ছয়টা পর্যন্ত কীর্তন করতে হয়। এসব বিধবার মাথা ন্যাড়া করতে হয়। কপালে সাদা তিলক ও সাদা শাড়ি পরে নিরাবরণ দেহে নিঃশব্দে অবনত মস্তকে দাইদের তত্ত্বাবধানে চার ঘণ্টা ধরে ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ জপতে হয়। এখানে ক্লান্ত হওয়া চলে না; জপ বন্ধ হলে কিংবা কেউ ঘুমে বা ক্লান্তিতে ঢলে পড়লে দাইদের গলা ধাক্কা ও পিটুনি খেতে হয়। কীর্তন ও জপে তাদের হাজিরা তোলা হয় এবং জপ শেষে ২৫০ গ্রাম চাল ও এক চিমটি লবণ জোটে। এটাই তাদের সারাদিনের খোরাকী। বিকেল চারটেয় গেট থেকে তারা মজুরির পয়সা নিয়ে আরো চার ঘণ্টা জপ করে। এরপর তারা নগরীর বিভিন্ন স্থানে অদৃশ্য হয়ে যায়।
মথুরার বাবু শিবনাথ আগরওয়াল কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক অশোক বর্ণশালের মতে, বিধবা পুনর্বাসন ও কীর্তনের সুবাদে বৃন্দাবনে অনেক সম্ভাবনার দ্বার খুলে গিয়েছিল। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার দানশীল ব্যক্তি এখানে শত শত কোটি টাকা দান করেছে। কিন্তু এই টাকার হিসাব এবং জবাবদিহিতা কোনটাই নেই। বিধবাদের জন্য যে ‘খাঁচাগুলো’ তৈরি করা হয়েছে সেগুলো বস্তি মালিকদের হাতে চলে গেছে। বখাটে চাঁদাবাজরা নিয়মিত বিধবাদের শোষণ করে। যে কক্ষগুলোতে বিনা পয়সায় তাদের থাকার কথা সেগুলোর জন্য প্রতিমাসে তাদের ৪০-৫০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। আবার প্রত্যেক বিধবাকে মৃত্যুর পর তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য ১২০ টাকা আগাম দিতে হয়। আবার যখন তাদের মৃত্যু হয়, তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের মরদেহ রাস্তায় পড়ে থাকে। সুইপাররা ময়লা-আবর্জনার সাথে এই লাশ যমুনায় ফেলে দেয়। অধ্যাপক অশোকের তথ্যানুযায়ী বিধবাদের স্বপ্নপুরী বৃন্দাবন এখন কিছুসংখ্যক পান্ডা, দুর্বৃত্ত, চাঁদাবাজ বদমাশদের স্বর্গরাজ্য, বিধবাদের জন্য বধ্যভূমি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের লীলাক্ষেত্র।
আরও পড়ুন-
এই নিবন্ধে বৃন্দাবন আর বিধবাদের নিয়ে আলোচনা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু ৫ আগস্টের আগে আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশের অবস্থার প্রেক্ষিতে বৃন্দাবনের চিত্রটি আমার চোখের সামনে ফুটে উঠে বারবার। পাকিস্তান আমলে মুখ্যত গণতান্ত্রিক অধিকার ও অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলাম এবং লক্ষ প্রাণ ও মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে এই বিজয় অর্জন করে একটি স্বাধীন পতাকার অধিকারী হয়েছি। পাকিস্তানী শাসকরা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। আমাদের মৌলিক অধিকার, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক অধিকার তথা বাক-স্বাধীনতা, মিটিং-মিছিল- অন্যায়ের প্রতিবাদ করার স্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল। তারা পত্রপত্রিকা ও গণমাধ্যমকে কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে প্রেস ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেছিল। রেডিও-টেলিভিশনের ওপর সরকারি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। সরকারি চাকরি-আইন-শৃঙ্খলা ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর নিয়োগ পদোন্নতিতে বাংলাভাষীদের বঞ্চিত করেছিল। অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল পাহাড়সম। আওয়ামী লীগের দৃষ্টিতে তারা ‘সোনার বাংলাকে শ্মশান’ বানিয়েছিল। তাদের শোষণ এবং নির্যাতন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে আমাদের পঙ্গু করে রেখেছিল। এই অঞ্চলটিকে পাকিস্তানী শাসকরা তাদের কলোনী হিসেবে ব্যবহার করে এসেছিল। ফলে অমিত সম্ভাবনার এই ভূখন্ডটি বিকাশের সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েছিল। এই অবস্থায় আমরা স্বাধীন হয়েছি এবং এখন প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব কষা হয়। প্রশ্ন উঠে যে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্নকে আমরা লালন করেছিলাম গত ৫৩ বছরে তার কতটুকু আমরা পেয়েছি? এ ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি পুরুষ বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। ২০২২ সালে তিনি বলেছিলেন, “স্বাধীনতার ৫১ বছর পার হয়ে গেলেও দেশে প্রকৃত স্বাধীনতা এখনো অর্জিত হয়নি। এখনো দেশের মানুষ দু’বেলা পেট ভরে খেতে পায় না। এখনো দেশ বিদেশীদের কাছে বন্দী।”
৫ আগস্টের পূর্ব পর্যন্ত সিংহভাগ মানুষ মনে করতো যে, স্বাধীন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অধিকার ও মূল্যবোধ ক্ষমতাসীনদের পদতলে প্রতিদিন পিষ্ট হচ্ছে। এই মূল্যবোধ রক্ষার জন্য কোনও watchdog নেই। রাজনৈতিক নির্যাতন, দমন, নিপীড়ন ও দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত মানুষের প্রতিবাদের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে মানুষ বঞ্চিত। যারা প্রতিবাদ ও মিছিল-মিটিং করতে যেতেন তারা পুলিশ, ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের যৌথ হামলা-মামলায় যেমন নির্যাতিত হতেন তেমনি তাদের উন্নত মাথাও লাঠিপেটায় ভূলুণ্ঠিত হয়ে পুলিশের বুটের নিচে পিষ্ট হত। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি যে আচরণের জন্য আমরা পাকিস্তানীদের ঘৃণা করতাম তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি নিকৃষ্ট আচরণ আমরা তাদের প্রতি করে এসেছি। প্রকাশ্যে সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ‘শত্রু’ বলে ঘোষণা করেছেন। রাজনৈতিক শিষ্টাচার দেশ ছেড়ে পালিয়েছিল। গুণী ব্যক্তির কদর, জ্যেষ্ঠ ও মানি ব্যক্তিদের সম্মান করার কালচার আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম। কেউ কেউ বলেছেন, প্রশাসন এবং দেশ পরিচালনায় নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আওয়ামী শাসনামলে গ্র্যাসামের সূত্র বাংলাদেশে কার্যকর করা হয়েছে। গ্র্যাসাম পচা নোটের উল্লেখ করে বলেছিলেন, “Bad money drives good money out of circulation” তারই সূত্র ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আরেকটি প্রবচন চালু হয়েছিল তা হচ্ছে, “Bad people drive good people out of service”। সর্বত্র খুনী, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ, টেন্ডারবাজ ও তোষামোদকারী ব্যক্তিদের কদর অত্যন্ত বেশি ছিল। ক্ষমতার মোহমদমত্ততায় মূল্যবান মানবিক মূল্যবোধগুলোকে আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার সামর্থ্য হারিয়ে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার উন্মত্ততা আমাদের অনেক রাজনৈতিক নেতানেত্রীকে হিংস্রতার নিকৃষ্টতম স্তরে পৌঁছিয়ে দিয়েছিল।’
এরই ধারাবাহিকতায় রাজনীতি থেকে আদর্শবাদ বিদায় নিয়েছে। সৃষ্টির শুরু থেকে আদর্শ ও নৈতিকতার উৎস হিসেবে ধর্ম চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রায়ই একশ্রেণির ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধর্মকেই আক্রমণের প্রধান টার্গেট বানিয়ে নিয়েছিল। ক্ষমতাসীনরা ধর্ম ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। আওয়ামী সরকারের বিগত ১৫ বছর আমলের আগে অতীতে কখনো দেখা যায়নি । আওয়ামী নেতাদের এই টার্গেটের ধর্ম হিন্দু, খৃস্টান কিংবা বৌদ্ধ ধর্ম নয়, এদেশের নববই ভাগ মানুষের ঈমান আকীদার উৎস ইসলাম। তারা কুরআন থেকে জিহাদের উৎখাত চায়, ইসলামী সাহিত্যকে জিহাদী পুস্তক আখ্যা দিয়ে কটূক্তি করে। তাদের দৃষ্টিতে জিহাদ মানে সন্ত্রাস। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর চেয়ারে বসে আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর নামে মিথ্যাচার করে মসজিদের অর্ধেক হিন্দুদের পূজার জন্য ছেড়ে দেয়ার বাসনা প্রকাশ করে।
২০২২ সালে জাতিসংঘ ঘোষিত মানবাধিকার দিবস উদযাপন উপলক্ষে অধিকার নামক একটি মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কিছু ঘটনা প্রকাশ করেছিল। ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে ঐ সময় দেশে ৭৮ ব্যক্তি বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন এবং আওয়ামী সরকারের আমলে এ ধরনের হত্যার সংখ্যা হয়েছে তিন হাজারেরও বেশী। এই হত্যাযজ্ঞগুলো ঘটেছে ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার প্রভৃতির নামে। যদিও ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের দ্বারা প্রকাশ্য দিবালোকে সাপের মতো পিটিয়ে মানুষ হত্যার বিষয়টি তাদের এই রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত ছিল না ।
আরও পড়ুন-
এখানে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, দেশের উচ্চ আদালতের তরফ থেকে বিচার বহির্ভূত এই হত্যাকান্ড বন্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি নির্দেশ ও রুল জারি করা হয়েছিল। এই রুল কোনও কাজে আসেনি বরং ২০০৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর জারি করা হাইকোর্টের রুলের পর র্যাব ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ১৩৩ ব্যক্তিকে ক্রসফায়ারের হত্যার অভিযোগ উঠেছিল। ৫ আগস্টের আগে বিচারবহির্ভূত হত্যার সাথে নতুনভাবে সংযোজন হয়েছিল গুম। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক র্যাব ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর গুমের সংখ্যা কিছু কমলেও ৫ আগস্টের আগে তা অব্যাহত ছিল। যারা গুম হয়েছিল তাদের সকলেই ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী; সিভিল ড্রেসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী লোকজনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল এবং কয়েকদিন পর এদের লাশ পাওয়া যাচ্ছিল । অথচ এই উপসর্গটি একুশ শতকের আওয়ামী বর্বরতার আগে সেভাবে ছিল না বাংলাদেশে। সেই সময় রিমান্ডতো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে পড়েছিল।
বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে রাজবন্দীরা রাজার মর্যাদা পেতেন। শেখ মুজিবুর রহমানসহ রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই তখন গ্রেফতার হয়েছিলেন। তাদের ডান্ডাবেড়ি ও হাতকড়া পরানো হয়নি।এমন কি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায়ও রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের কথা শোনা যায়নি। আওয়ামী শাসনে সম্মানিত রাজনীতিকদের হাতকড়া, ডান্ডাবেড়ি পরানো হয়, রিমান্ডে চরম নির্যাতন করা হয়। সরকারের গুণকীর্তন করলে সব ঠিক, সমালোচনা করলে জিহবা কাটার কসরত চলছিল যেন। ৫ আগস্ট বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনের পর আওয়ামী লাঠিয়ালরা এখন সরাসরি কাউকে আক্রমণ করতে না পারলেও আবার নতুন কায়দায় তাদেরই ছত্রছায়ায় বা উস্কানিতে বিশৃঙ্খল জনতা কর্তৃক ‘মব জাস্টিস’ এর নামে কঠিন মানবাধিকার লঙ্ঘনের খেলা শুরু হয়েছে বাংলাদেশে! এটা কি আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নের অংশ ছিল?
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি ৫ আগস্টের আগে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল। মানবাধিকার বঞ্চিত বাংলাদেশের মানুষের যাবার কোনও জায়গা ছিল না। পুলিশ তাদের আশ্রয় দিত না, আদালতে তারা সুবিচার পেত না।
ইভটিজিং-এর নামে দেশব্যাপী গত দেড় দশক ধরে নারী নির্যাতন ও নারীর প্রতি যৌন সন্ত্রাস দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। ছাত্র নেতা, রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের মনোরঞ্জনের জন্য ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরীহ ছাত্রীদের ব্যবহার করেছে। এটি আমাদের জাতীয় লজ্জা এবং স্বাধীনতার কলঙ্কজনক অধ্যায়।
আওয়ামী সরকারের নানা দুর্নীতি এবং লুটপাটের কারণে অর্থনীতির দিক থেকে দেশ প্রায় দেউলিয়া হয়ে পড়েছে, কিন্তু তারা তাদের আমলে সেটাকে ধামা চাপা দিয়ে রেখেছিল নানা কায়দায়। উন্নয়নের তথাকথিত গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াতো যেন জাতিকে । ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর এখন সেসব দুর্নীতি ও লুটপাটের খবরগুলো সামনে চলে আসছে । অর্থনৈতিক এবং ব্যাংকিং সেক্টর দুর্বল করে দিয়েছে এস আলম এবং সালমানের মতো আওয়ামী দোসর ও ব্যবসায়ীরা । দুর্নীতির এমন নজীর বাংলাদেশ আগে কখনও প্রত্যক্ষ করেনি ।
তাদের সময় সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছিল। সিভিল প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও বিচার বিভাগের নিয়োগ-পদোন্নতিতে কোনও মেধার স্থান ছিল না। পাকিস্তান আমলে এসব ক্ষেত্রে পশ্চিম পকিস্তানীরা যেমন প্রাধান্য পেত, আওয়ামী শাসনামলে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের লোকেরা একইভাবে চাকুরীতে প্রাধান্য পেত । আওয়ামী লীগ না করলে চাকরি ও পদোন্নতি পাওয়া যেত না। মেধাবীরা হয় বেকার, না হয় ওএসডি অথবা কর্মচ্যূত। দেশবাসীর সমস্যা সমাধানের কোনও উদ্যোগ ছিল না। কিন্তু প্রতিবেশী দেশের তোষণ ও তার সুবিধার্থে অধিক সুদে ধার নিয়ে তাকে ট্রানজিট করিডোর ও বন্দর প্রদানে আমাদের সরকার ছিল অজ্ঞান। আমরা ছিলাম মৌলিক পরিসেবা থেকেও বঞ্চিত। দেশের সামাজিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক উত্তাপ এবং জনদুর্ভোগ এতই বৃদ্ধি পেয়েছিল আগামী দিনগুলোতে কি হবে কেউই বলতে পারছিল না। ৫ আগস্টের পর থেকে অবশ্য মানুষ নতুন বাংলাদেশ গড়ার আশায় বুক বেঁধে আছে ।
আলোচনার শুরুতে আমি বৃন্দাবনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলাম। এর চেতনা ছিল মহৎ । কিন্তু, কিছু মোহন্ত, পান্ডা ও অর্থলিপ্সা ব্যবসায়ী এই মহৎ প্রচেষ্টাটিকে নিজেদের ভাগ্য গড়ার কাজে লাগিয়ে বিধবাদের আরো দুর্দশার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
আওয়ামী শাসনে আমাদের দেশেরও কিছু রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ীও একই পথ অনুসরণ করে জনদুর্ভোগ বাড়িয়ে নিজেদের আখের গুছিয়েছে । এখনও তারা নানাভাবে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে ড. ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিপর্যস্ত ও দিকভ্রান্ত করার জন্য । আমরা কী ঐক্যবদ্ধভাবে এই অপশক্তির হাত থেকে দেশকে রক্ষা করে মানুষকে বাঁচানোর জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে পারি না?
লেখকঃ প্রাবন্ধিক , গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক যুগ্ম সচিব এবং সিনিয়র সহকারী সম্পাদক, দৈনিক সংগ্রাম
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে- [email protected] ও [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে । আসুন ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।