।। শাহানারা স্বপ্না ।।
৯ই ডিসেম্বর, মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুদিন—স্মরণের দিন। নারী জাগরণে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বেগম রোকেয়া আর নারীর অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিলেন কবি নজরুল—দুজনেই যেন বাংলাদেশের নারী মুক্তির অগ্রযাত্রার সমার্থক।
জুলাই -২৪ এর আন্দোলনে তাই , কবি ও বিপ্লবী হয়েছে একাকার। বিপ্লবের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে কবিতার জ্বলন্ত বাক্য। জুলুম নির্যাতনের দেয়াল গুঁড়িয়ে দিতে, নারী-পুরুষ একত্রে সোচ্চার হয়েছে দু:শাসনের বিরুদ্ধে –“ লাথি মার ভাঙরে তালা, যতসব বন্দিশালা আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি-”! যুগে যুগে এভাবে নজরুল প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন, জেগে ওঠেন দ্রোহে, বিপ্লবে।
বিপ্লব যে কোন দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে একটি মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। আর বিপ্লব ঘটে কিন্তু খুব সংক্ষিপ্ত সময়ে। জুলাই চব্বিশের বিপ্লব আমাদের মনে করিয়ে দেয় ফ্রান্সের বিপ্লবের কথা, যা ১৮৩০ সালের ২৬ জুলাই থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত, মাত্র চারদিন স্থায়ী ছিল, কিন্তু এ বিপ্লব ফ্রান্সের শাসন ব্যবস্থা, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটায়। ২০২৪শে আমাদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১ জুলাই থেকে। ১৫ জুলাই থেকে এ আন্দোলন নতুন মোড় নেয় এবং উত্তাল হয়ে ওঠে, শেষ হয় ৫ই আগস্ট—অর্থাৎ ৩৬ দিনের আন্দোলন।
এ আন্দোলনে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহন ও উপস্থিতি ছিল খুব গুরুত্বপুর্ন এবং তাৎপর্যপূর্ন। বলা যায় ছেলেদের সাথে সমানে সমান ছিল মেয়েরা। পুলিশ, RAB, বিজিবি, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্নাইপারদল কাউকে এতটুকু ভয় না করে তারা বীর বিক্রমে এগিয়েছে সামনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী হলে হলে থালা বাসনে উঠল বাদ্যযন্ত্রের ঝংকার এবং হাজারো কন্ঠে ধ্বনিত হলো হুংকার—-
“তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!
কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার! স্বৈরাচার!”
একটি আয়রনিক স্লোগান! নিষিদ্ধ শব্দের সশব্দ উচ্চারন ! এমন একটি শ্লোগান যে সন্ত্রাস ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মহাবিস্ফোরণ ঘটাতে পারে চব্বিশের জুলাই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। চারদিকে কুয়াশার আবরনের মতো কৃত্রিম ভয়ের সংস্কৃতি, পুরো জাতিকে পনের বছর ধরে জাপটে ধরে রেখেছে। ভয়ের সেই মিষ্টিক খোলস ছিন্ন-ভিন্ন করে অচলায়তন ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে দুর্বার পদাতিকেরা। আলোর যাত্রীরা আলো ছড়িয়ে দেয় স্তব্ধ হয়ে যাওয়া পুরো জাতির ওপর। আশা যোগায় দুর্মদের অত্যাচারে ম্রিয়মান হৃদয়ে। দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, দু:খ, যন্ত্রনায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার দল, শেষবারের মতো বাঁচতে চেয়ে মরনকে বরন করে নেয়। সর্বশক্তি দিয়ে অপরিমেয় পাপ, শোষন-শাসন, গুম, খুন , অনিয়ম অবিচারের বিরুদ্ধে লড়ে প্রতিবাদে।
এ আন্দোলনে সারিবদ্ধ মেয়েরা শুধু অংশগ্রহনই করেনি, প্ল্যাকার্ড হাতে, উচ্চকন্ঠে তারা সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, স্লোগান দিয়েছেন , উদ্দীপনা ও সংকল্পের সাথে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তারা না থাকলে কিছুতেই আন্দোলন এতো দুর্বার গতি পেতো না বলেই সবাই স্বীকার করেছেন।
আরও পড়ুন-
রাজধানী থেকে রাজপথে, শহর-বন্দর-গ্রামে সর্বত্র ছেলেদের সাথে এক কাতারে মেয়েরা সম্পৃক্ত ছিল আন্দোলনে। আমরা দেখেছি ঠাকুরগাঁওয়ের একটি মেয়ে পুলিশকে দেখিয়ে দেখিয়ে শ্লোগান দিচ্ছে—
“কে এসেছে, কে এসেছে,
পুলিশ এসেছে, পুলিশ এসেছে,
কী করছে, কী করছে,
স্বৈরাচারের পা চাটছে, স্বৈরাচারের পা চাটছে”!
তার সাথীরাও তুমুল চিৎকারে অন্যায়কারীর হৃদয় কাঁপিয়ে দিচ্ছে, নাড়িয়ে দিচ্ছে ফ্যাজমের ভিত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী সাংবাদিকদের জানাচ্ছেন– “আমরা এখানে মাথায় কাফন বেঁধে আসছি।…এখন আর পিছনে যাওয়ার রাস্তা নাই। পেছনে পুলিশ, আর সামনে স্বাধীনতা।” স্বতঃস্ফূর্ত এ উচ্চারণ! মাথা নিচু করে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুকেই তারা শ্রেয় মনে করেছেন—এটাই বিপ্লবী স্পিরিট।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাঁচ সমন্বয়কের সাথে ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন নুসরাত তাবাসসুম। একটা মেয়ে এবং তার পরিবারের জন্য এ সংবাদ কতটা উদ্বেগ ও আশংকার তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু তারা সমস্ত ভয়কে জয় করে নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশ-পরিবর্তনের এ বিপ্লবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক চৌধুরী সামিনা ফেরদৌস ছাত্রদের গায়ে হাত তোলার পর রাস্তায় নেমেছেন। চরমভাবে ফুঁসে উঠছেন পুলিশী হামলার বিরুদ্ধে—“একটা স্বাধীন দেশে এতো ভয়ে বাঁচবো কেন?… আমার ছাত্রের মুখ চেপে ধরার সাহস কে দিয়েছে আপনাদের? আমার ছাত্রের গলা ধরার সাহস কে দেয় আপনাদের? কতজনের জবান বন্ধ করবেন আপনারা? একজনের করবেন, দশজন দাঁড়াবো, দশজনের বন্ধ করলে হাজার মানুষ দাঁড়াবে। আঠারো কোটি বাঙালি নামবে। ” এবং বাস্তবে তাই হয়েছিলো।
১৭ থেকে ২১ জুলাই এই পাঁচদিনে পুলিশী হামলায় মৃত্যুবরণ করেন প্রায় দুইশ’ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী এবং আহত হন আরও কয়েকশ মানুষ। এরপর পুলিশ ব্লক রেইড দিয়ে গন-গ্রেফতার অভিযানে নামে। এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে গ্রেফতার অভিযান বন্ধ, হত্যার বিচারসহ নানারকম দাবি জানানো হতে থাকে।
শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, মৃত্যু, গ্রেফতারে বদলে গেছে আন্দোলনের ধরন ও কর্মসূচি। পথে নেমে এসেছিল দলে দলে সর্বস্তরের স্কুল-কলেজের ছাত্রী, শিক্ষিকা, পেশাজীবী ,অভিভাবক, গৃহিনী এবং সাধারণ নারীরা। স্লোগানে, স্লোগানে আর অভিনব সব গ্রাফিতিতে কাঁপিয়ে দিয়েছিল চারদিক। এর পর থেকে আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ আরো বাড়তে থাকে। হেনস্তার শিকার হয়েও নারীরা দমে যাননি, ঘুরে দাঁড়িয়েছেন– এটাই আমাদের ইতিহাস।
আন্দোলনে নারীদের প্রভাব ও অংশগ্রহন সবসময়ই ছিল ইস্পাত কঠিন মনোবল নিয়ে। । সফল আন্দোলন শেষে নারী শিক্ষার্থীরা পরবর্তী সেবা কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তারা কমিউনিটিতে দৃশ্যমানভাবে অবদান রেখেছে সড়ক পরিষ্কার, ট্রাফিক পরিচালনা, গ্রাফিতি আঁকা, উদ্দীপ্ত গানে আন্দোলনের স্পিরিট জারী রাখা ইত্যাদি কাজে।
আন্দোলনকারী নারী শিক্ষার্থীদের এই প্রচেষ্টা শুধু প্রতীকী নয়, তারা একটি শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে। তাদের সংগ্রাম শুধু পুরনো বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা ভাঙার জন্যই নয় বরং একটি নতুন, আরও ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ নির্মাণের জন্যও। নতুন যুদ্ধের অংশীদার গৌরবদীপ্ত আজকের বাংলাদেশের নারী। তাই অবাক বিষ্ময়ে কবি উচ্চারণ করেন—“বাংলাদেশের মেয়ে, অবিশ্বাস্য বিষ্ময়ে আজ বিশ্ব আছে চেয়ে !”
আজকের দিনে মেয়েরা যে অবস্থানে উন্নীত করেছেন নিজেদের এর পূর্বসূরী রাহবার তো বেগম রোকেয়া। তিনি চেয়েছেন নারীদের সম্মানের সাথে স্বাধীনতার সাথে বাঁচা। এ পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ-মাধূর্য নারীরাও উপভোগ করুক। পশুর মতো ভারভাহী জীবন মানুষের হতে পারে না, আল্লাহ্ মানুষকে তৈরী করেছেন স্বাধীন রূপেই। সেকালের অজ্ঞতার বেড়াজাল থেকে নারীকে মুক্ত আলোয় নি:শ্বাস নিতে তিনি উপায় খুঁজেছেন সর্বান্তকরনে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণই এটিকে সফল করেছে। কারণ সমাজে অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে বাইরে রেখে কোনো গণআন্দোলন সফল হতে পারে না। শতবর্ষ আগে বেগম রোকেয়া উপলব্ধি করেছিলেন, মেয়েদের সুস্থ জীবন চাইলে শিখতে হবে, বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ঘটাতে হবে, তবেই নারীমুক্তি সম্ভব। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বেগম রোকেয়া তাই আজও পথ-প্রদর্শক হয়ে আছেন।
লেখকঃ আইনজীবী ও প্রাবন্ধিক
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল, আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেইজ মহীয়সী/Mohioshi-তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হ্যাঁ, মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইল-
[email protected] ও [email protected] -এ; মনে রাখবেন, “ধন দৌলত খরচ করলে কমে যায়, কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়”। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকেই দ্বীনি জ্ঞান দান করেন।” (সহিহ বুখারী- ৭১, ৩১১৬, ৩৬৪১, ৭৩১২, ৭৪৬০; মুসলিম- ১০৩৭; ইবনে মাজাহ- ২২১) ।
মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম; আজই আপনি যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে। আসুন, ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ, সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি। আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমীন।