-তাজ রহমান
সেজুতিরা দুই বোন ও এক ভাই। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সেজুতি বড়। সেজুতি ছিল লেখাপড়ায় খুব ভালো।সে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায়।
এইচ এস সি তে নিজ জেলার মধ্যে সে তৃতীয় স্থান অর্জন করে। ইহাই যেন সেজুতির জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়। সেজুতির বাবার দূরসম্পর্কের এক মামাতো বোন ছিল। তিনি সেজুতিদের বাসায় বেড়াতে আসে এবং সেজুতির এ সাফল্যের কথা জানতে পারে।সেদিন থেকে তিনি উঠেপড়ে লাগেন সেজুতিকে তার মেজো ছেলের বউ করার জন্য।তিনি সেজুতির পরিবারকে বারবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন যে তারা সেজুতির লেখাপড়ায় কোন ব্যাঘাত ঘটাবে না।তারা সেজুতির লেখাপড়ার সমস্ত খরচ বহন করবে।
ছেলে সরকারি চাকরি করে এ কথা জেনে সেজুতির পরিবারের সকলে এ বিয়েতে রাজি হয়।
এ বিয়েতে সেজুতির মত ছিল না। সে অনেকবার ওর বাবা মাকে বলেছিল ও এখনই বিয়েটা করতে চায়না।কিন্তুু ওর বাড়ির লোকজনের চাপে শেষ পর্যন্ত ওর কোন আপত্তি ধোপে টেকেনি। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেজুতি নিজের সমস্ত ইচ্ছা জলাঞ্জলি দিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হয়।
সেজুতি ভাবে বিবাহ একটি ইবাদত।ইসলামের দৃষ্টিতে
মানবজীবনের যাবতীয় কর্মকালই ইবাদত। কিন্তুু সে এ কোন ইবাদতে মগ্ন হতে যাচ্ছে যে ইবাদতে তার মন একটুও সায় দিচ্ছেনা। তার মন সায় না দিলেও সে প্রবেশ করল দাম্পত্য জীবনে।
মহাধুমধাম করে সেজুতির বিবাহ হয়।সেজুতির বিবাহ দিতে গিয়ে সেজুতির বাবার অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়।
এরপর শুরু হয় সেজুতির শ্বাশুড়ির নানা বাহানা।সেজুতিকে কেনো ঘরের ফার্নিচার দেওয়া হলো না।যদিও এসবের কোন কিছুরই কথা ছিলনা দেওয়ার। এসব দেওয়া হয়ে গেলে তারা সেজুতির পরিবারের কাছে তিনলক্ষ টাকা যৌতুক দাবী করে।সেই সঙ্গে সেজুতির কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। সেজুতি ওদেরকে অনেক বোঝায়। কিন্তুু যতবারই সে বোঝাতে যায় ততবারই তার ভাগ্যে জোটে শারিরীকও মানসিক নির্যাতন। এমনকি পারিবারিকভাবে কয়েকবার বৈঠক করেও এর সুরাহা হয়নি।
সেজুতি তার সহপাঠীদের কলেজ যাওয়া দেখে কান্না করতো। কিন্তুু তারপরও কেউ এগিয়ে আসেনি তার স্বপ্নপূরনে। সে এখন আর কাঁদেনা। কান্নাগুলো বুকের ভিতরে গুমরে মরে। নিরবে কান্না জমতে জমতে বুকের ভিতরে হৃদয় নামক ছোট্ট ফিল্টারটুকু উপছে পড়ে। সে কান্না কেউ দেখেনা। কেউ বোঝেনা।
দিন যায় মাস যায় যৌতুকের জন্য সেজুতির উপর বাড়তে থাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। যা সেজুতি আর সহ্য করতে পারছিলনা।
শেষ পর্যন্ত সে শ্বশুর বাাড়ী ছেড়ে চলে আসে বাবার বাাড়ী।
সেজুতি তার বাবাকে বলে,বাবা ওরা তিনলক্ষ টাকা যৌতুক চায়।
সেজুতির বাবা বলে মা আমি এতটাকা কোথা থেকে পাব?
সেজুতি বলে বাবা আমিতো টাকা নিতে আসিনি।আমি একেবারে চলে এসেছি ও সংসার ছেড়ে।
সেজুতির বাবার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।সমাজের লোকেরা কি বলবে? তা ভেবে।
সেজুতি বলে বাবা যে লোকগুলো তোমাকে দেওয়া কথার একটিও রাখলনা। যারা যৌতুকের টাকার জন্য আমাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে। পারবনা বাবা তাদেরে সঙ্গে আপোষ করে সংসার করতে। তুমি যতগুলো টাকার ফার্নিচার ওদেরকে দিয়েছ, তা হলে আমার অনার্স মাস্টার্স শেষ হয়ে বি সিএস কোচিং পর্যন্ত হয়ে যেত বাবা। ওরা কোনোদিন ও শোধরাবে না বাবা।
আর যে সমাজের কথা বলছ বাবা, সে সমাজের ভয়ে আজ যদি তুমি আমাকে তিনলক্ষ টাকা দিয়ে পাঠাও সংসার করতে। তবে পরবর্তীতে ওদের চাহিদা আরো বেড়ে যাবে। কোনোদিনও মেটাতে পারবেনা ওদের এ অলিখিত ও অনির্ধারিত যৌতুকের চাহিদা। কোনো একদিন দেখবে যৌতুকের জন্য তোমার মেয়ে পত্রিকায় খবরের শিরোনাম হয়ে গেছে।
” যৌতুকের জন্য হত্যা বা আত্নহত্যা”
তখন তুমি আমার হত্যাকান্ডের বিচার চাইবে। আর সমাজের কতিপয় লোক হয়তো তোমার পাশে দাঁড়াবে। পোস্টার,ব্যানার ছাপিয়ে এ হত্যাকান্ডের বিচার চাইবে, মিছিল করবে, শ্লোগান দিবে। কিন্তুু তবুও কি তুমি বিচার পাবে? এ নিশ্চয়তা তো সমাজ দিতে পারবেনা বাবা। কারণ যৌতুক বা যে কোনো কারণেই নারী নির্যাতন ঘটুক, তা ঘটে থাকে মেয়ের শ্বশুর বাড়ীতে। তাই স্বাভাবিকভাবে স্বাক্ষীও থাকে শ্বশুর বাড়ীর লোকজন। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রমাণ করা সম্ভব হয়না যে মেয়েরা নির্যাতিত হচ্ছে।
এযৌতুকের কারণে অনেক মেয়ের জীবন প্রদীপ অকালে নিভে যায়।অধিকাংশ ক্ষেত্রে হত্যা করে চালিয়ে দেয় আত্নহত্যা বলে।
মৃত্যুর পরও মুক্তি পায় না অপবাদ থেকে।
তুমি কি চাও বাবা এরকম মৃত্যু তোমার মেয়ের জীবনেও ঘটুক। সেজুতির বাবার চোখদুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠে।আর কোনো কথা বলতে পারলেন না। অশ্রুসজল নয়নে মেয়ের সিদ্ধান্তকে সন্মতি দিলেন।
সেজুতির ডির্ভোস হয়ে যায়।সেজুতি পুনরায় লেখাপড়া শুরু করে।
ডির্ভোসের মাধ্যমে সেজুতি শারিরীক নির্যাতন থেকে মুক্তি পেলেও, মুক্তি পায়না মানসিক নির্যাতন থেকে। আপনজন ও সমাজের লোকজনের বাকা কথা ও বাকা চাহনীতে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে সেজুতির জীবন।
সেজুতি লোকজনের বাকা কথা ও বাকা চাহনীর তোয়াক্কা না করে লেখাপড়া চালিয়ে যায় এবংএগিয়ে চলে নিজের জীবনের স্বপ্নপূরনের পথে।
অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সেজুতি লেখাপড়া শেষ করে এবং সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারি শিক্ষিকা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে।
আর এ কর্মজীবনে প্রবেশের পর থেকে সেজুতি লোকজনের বাকা কথাও বাকা চাহনী থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পায়।
অবশেষে সেজুতি মুক্ত পায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন থেকে।
তাজ রহমান – সাহিত্যিক।