।। জামান শামস ।।
বিশ্বে এখন নারী-পুরুষ সমতা নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। অনেকেই বলেন, ইসলাম নারীকে স্বাধীনতা দেয়নি। সমতা দেয়নি। একদল মানুষ নারীর পক্ষ নিয়ে ‘নারীবাদী’ হয়ে গেছেন। তাদের দেখাদেখি মুসলিম সমাজেও এ ধরনের চিন্তা ছড়িয়ে পড়ছে। যার ছায়া এসে পৌঁছেছে আমাদের বাংলাদেশেও। এসব বিষয়ে ইসলামের নীতিমালা ও নির্দেশনার বিলোপ চেয়ে আগেও তথাকথিত নারীবাদী সংগঠনগুলো সেমিনার সিম্পোজিয়াম করেছে,জনমত তৈরীর চেষ্টায় রাজপথে সোচ্চার ভূমিকা রেখেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সরকারকে দেয়া প্রস্তাব প্রতিবেদনের পর এই প্রচেষ্টা অনেকটাই আর্টিকুলেটেড পন্থায় উপস্থাপিত হয়েছে।
প্রস্তাবনা প্রতিবেদনটি প্রায় সাড়ে তিনশত পৃষ্ঠার।এতে সতেরোটি অনুচ্ছেদ এবং এগারোটি সংযুক্তির সাথে অনেকগুলো সুপারিশও করা হয়েছে। তারা বলেছে,
“নারী সমাজের বর্তমান অবস্থান পরিবর্তনে ইতিবাচক এবং দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ সনাক্ত করে আমাদের আশা এই সকল অধ্যায়ে সন্নিবেশিত সুপারিশমালা বর্তমান ও ভবিষ্যতে সরকার গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে এবং বাস্তবায়নে সচেষ্ট হবে। নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন একটি ঐতিহাসিক সুযোগ যা নারীর চাওয়া পাওয়াকে আলোচনা সমালোচনার মধ্য দিয়ে জাতি ও নীতি নির্ধারকদের কাছে পরিচিত করবে। নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন আশা করে এই প্রতিবেদন জনমানসে নাড়া দেবে, ভাবাবে এবং তর্ক-বিতর্ক সৃষ্টি করার মাধ্যামে নারীর সমতা অর্জনে সহায়ক করবে”।
তারা আরো বলেছে,”নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন এমন একটি সমাজের স্বপ্ন দেখে, যেখানে নারী ও পুরুষের মধ্যে প্রকৃত সমতা থাকবে এবং নারীরা তাদের জীবনে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।”
ইসলাম নিরপেক্ষ ও স্বাধীন চিন্তাধারার বিপক্ষে নয়। ইসলামের প্রাথমিক যুগে যারাই মুসলমান হয়েছিলেন তারা সকলেই জেনে বুঝেই ইসলাম গ্রহন করেছিলেন এবং এমনও ঘটেছে যে প্রথমে রাসুলের সা. দাওয়াত ও আন্দোলনের ঘোর বিরোধিতা করেছেন,ব্যাপক সমালোচনা করেছেন।এমনকি ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছেন।অবশেষে ভুল বুঝে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে ইসলামের দাওয়াত ও কর্মনীতির শুধু সমর্থকই হননি উপরন্ত ইসলামের জন্য প্রাণও উৎসর্গ করেছিলেন।
আরও পড়ুন-
কথাটি এজন্য বললাম যে,অনেকেই ভাবতে পারেন যে আমরা ব্যক্তির সমালোচনা করছি। মোটেও না। আমাদের সাথে প্রস্তাব উত্থাপনকারীদের,উনাদের ভাষায় যে তর্ক বিতর্ক তা কেবল নীতি ও আদর্শের।
তাদের মনে প্রশ্ন ইসলামে নারীরা পর্দায় কেন? সম্পত্তিতে ভাইয়ের অর্ধেক কেন? দুই নারীর সাক্ষী এক পুরুষের সমান কেন,বিবাহ তালাক ও তালাকপ্রাপ্ত নারীর ভরণ-পোষণে ইসলামী আইনের অনুসরণ কেন ইত্যাদি। আমরাও বলছি, উত্থাপিত বিষয়গুলো নিয়েই তো আপনাদের এলার্জি (?) সুতরাং এগুলোর ব্যাখ্যা জানা উচিত। একই সাথে সরকারেরও যারা সিদ্ধান্ত নিবেন তাদেরও ইসলামের এই নীতিগুলোর উপর পরিষ্কার ও নির্ভুল ধারণা থাকা সংগত। নারীর বিষয় বলেই আবেগতাড়িত হবার কোন অবকাশ নেই।
এ বিষয়ে সঠিক বুঝ লাভ করতে হলে, চোখ থেকে পশ্চিমা অপপ্রচারের রঙিন চশমা খুলতে হবে। বুঝতে হবে যে, পাশ্চাত্যের নারী-পুরুষ সমতার ধারণা ভুল। এ ধারণা থেকে চিন্তা করলে ইসলামের সমতার দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা যাবে না। চিন্তাটি করতে হবে মানুষের স্রষ্টা ও রব আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নীতি অনুযায়ী। কেননা তিনিই নারী পুরুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর সৃষ্টি সুষমায় তিনি নারী পুরুষকে সমান করেননি। আসুন অধিকারের প্রসঙ্গ আলোচনার আগে বিবেচনায় নিই, সত্যিই নারী পুরুষ সমান কিনা?
প্রথমত,এই দুয়ের মধ্যে লৈঙ্গিক পার্থক্য বিদ্যমান। সচারচর জীবপ্রজাতির পুরুষ ও স্ত্রীর মধ্যে বিদ্যমান জৈবিক এবং মানসিক বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য আছে,এটা চাঁদ সূর্যের মতো সত্য। এই পার্থক্যগুলো উভয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, সাধারণত এবং গড়ে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ উচ্চতায় প্রাপ্তবয়স্ক নারীর চেয়ে লম্বা,কিন্তু একজন নির্দিষ্ট নারী একজন নির্দিষ্ট পুরুষের চেয়ে লম্বা হতে পারেন। পুরুষ নারীর তুলনায় বেশি শক্তিশালী। পুরুষের উচ্চ মাত্রার টেস্টোস্টেরন ক্ষরণের ফলে পেশি বিকাশ সুগঠিত হওয়ায় এমনটি হয়। পুরুষের শরীরের নারীর চেয়ে লোমের পরিমাণও বেশি। পুরুষের ত্বক, নারীর ত্বকের তুলনায় বেশি মোটা (বেশি কোলাজেন সমৃদ্ধ) এবং তৈলাক্ত। নারীর ত্বক পুরুষের ত্বকের তুলনায় বেশি কোমল। পুরুষের তর্জনী, অনামিকার তুলনায় ছোট। অপরদিকে নারীর তর্জনী, অনামিকার তুলনায় বড়। পুরুষের কণ্ঠমণি (Adam’s Apple) রয়েছে, যার ফলে ভোকাল কর্ড বড় এবং কণ্ঠস্বর ভারী ও গম্ভীর হয়।
পুরুষের রক্তচাপ নারীর তুলনায় বেশি। এবং নারীর হৃৎস্পন্দন পুরুষের তুলনায় বেশি, এমন কী যখন তারা ঘুমিয়ে থাকে তখনও। পেশি কলার ঘনত্ব নারীর থেকে পুরুষের বেশি, বিশেষ করে উর্ধ্বাঙ্গে। পুরুষ ও নারীর কিছু হরমোনের ক্ষেত্রে মাত্রা ভিন্ন। যেমন: পুরুষের অ্যান্ড্রোজেন ক্ষরণের হার বেশি। অপরদিকে নারীর ইস্ট্রোজেন হরমোন ক্ষরণের হার বেশি।প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের প্রতি ঘন মিলিমিটার রক্তে লোহিত রক্ত কণিকার সংখ্যা প্রায় ৫২ লক্ষ, অপরদিকে প্রাপ্ত বয়স্ক নারীর ক্ষেত্রে এই পরিমাণ ৪৬ লক্ষ। প্রায় ১৪ থেকে ৫১ বছর বয়স পর্যন্ত নারীদের সাধারণত পুরুষদের তুলনায় বেশি আয়রনের প্রয়োজন হয়। নারীদের মাসিকের সময় তাদের রক্ত ঝরে। যা সাধারণত ২৮ থেকে ৪০ দিনের একটি চক্রে ঘটে থাকে। তাই নারীদের তুলনামূলক বেশি আয়রন প্রয়োজন।পুরুষের এই সমস্যাটি নেই।
আরও পড়ুন-
পুরুষ এবং মহিলা মস্তিষ্কের গঠন পদ্ধতি, মানে তারা কীভাবে তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করে এবং রাসায়নিক সংকেতের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। পুরুষদের আরও তথ্য-সম্বলিত ধূসর পদার্থ থাকে, কিন্তু মহিলাদের আরও বেশি সাদা পদার্থ থাকে, যা মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশকে সংযুক্ত করে। এছাড়াও পুরুষদের তুলনায় নারীদের স্মৃতিশক্তি বেশি হয়। ৪০ বছর বয়সের পর পুরুষ এবং নারী হাড়ের শক্তি হারাতে শুরু করে। মেনোপজ নারীদের হাড়ের ক্ষয় ত্বরান্বিত করে। সুতরাং ৫১-৭০ বছর বয়সী নারীদের একই বয়সের পুরুষদের তুলনায় ২০০ মিলিগ্রাম (মিলিগ্রাম) ক্যালসিয়াম বেশি প্রয়োজন। মহিলাদের জন্য প্রতিদিন ১২০০ মিলিগ্রাম এবং পুরুষদের জন্য ১০০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন হয়।
এমন আরো অসংখ্য পার্থক্য দিয়েই আল্লাহ পুরুষ ও নারীকে সৃষ্টি করেছেন যার অনিবার্য প্রভাব তার মন মস্তিষ্ক, কার্যকারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।সে কারণে তাদের উভয়ের কর্মক্ষেত্র আলাদা হওয়াই বাঞ্ছনীয়। একজনকে আল্লাহ কোমল ও কমনীয় করেছেন যাতে সে ঘরের আভ্যন্তরীণ কাজগুলোর সর্বোত্তম সেবাদানকারী ও রক্ষক হতে পারে। আর অপরদিকে পুরুষকে অপেক্ষাকৃত রুঢ়, গম্ভীরভাষী ও নিয়ন্ত্রণকারী স্বভাবের করেছেন যেন সে বাইরের শক্ত সামর্থ্য কাজগুলো আন্জাম দিতে পারে। এটা আল্লাহর হিকমাহ। আপনি এর বাইরে দু’জনই সমান বলে নারীকে তাল গাছে তুলে দিবার অনুরোধ আর পুরুষকে দিয়ে গর্ভধারণের চিন্তা করতে পারেন না, কেননা এগুলো স্বভাবের খেলাপ।
আমাদেরও দাবী নারীর যথার্থ মূল্য দিন যা সে পাবার হক রাখে। তাকে ঠকাবেন না,তার সাথে অবজ্ঞাসূচক ও বেইনসাফী আচরণ করবেন না। আর আপনারা বলছেন নারী পুরুষ আলাদা নয়,পুরুষের সমান কাজ ও প্রাপ্য যেন সে পায়। আমরা বিষয়গুলো আরো ক্লিয়ারলী কয়েকটি পর্বে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
চলবে…
লেখকঃ কলাম লেখক এবং সাবেক এডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল, আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেইজ মহীয়সী/Mohioshi-তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হ্যাঁ, মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইল-
[email protected] ও [email protected] -এ; মনে রাখবেন, “ধন দৌলত খরচ করলে কমে যায়, কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়”। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকেই দ্বীনি জ্ঞান দান করেন।” (সহিহ বুখারী- ৭১, ৩১১৬, ৩৬৪১, ৭৩১২, ৭৪৬০; মুসলিম- ১০৩৭; ইবনে মাজাহ- ২২১) ।
মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম; আজই আপনি যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে। আসুন, ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ, সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি। আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমীন।