।। শিমুন লিজা ।।
নারী শিক্ষিত হবে—এটা আজ আর নতুন দাবি নয়। চারপাশে আমরা দেখতে পাই, নারী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে, ডিগ্রি অর্জন করছে, কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই শিক্ষা নারীর ভেতরে কী রূপান্তর আনছে? সে কি আত্মবিশ্বাসী, চিন্তাশীল, আত্মপরিচয়ে দৃঢ় হয়ে উঠছে?
কিন্তু প্রশ্ন হলো, সমাজ কি সত্যিই চায় নারী চিন্তাশীল হোক? নাকি চায় সে যেন শুধু ‘শিক্ষিত’ নামে পরিচিত হয়, কিন্তু চিন্তার জগতে রয়ে যায় নিয়ন্ত্রিত?
আমাদের সমাজ আজ এমন এক দ্বিচারিতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে একদিকে উচ্চশিক্ষিত নারীর প্রশংসা করা হয়, অন্যদিকে তার স্বাধীন চিন্তা, যুক্তি বা মতপ্রকাশকে ‘বিদ্রোহ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এক শ্রেণি তো নারীর চিন্তাকে ধর্মবিরোধী বলেও প্রচার করে। অথচ সেই ধর্ম—ইসলাম—যার নামেই এসব কথার ভিত্তি খোঁজা হয়, সেটিই ছিল নারীর মুক্তি ও মর্যাদার প্রথম বাহক।
ইসলামের আলোয় নারীর স্থান
ইসলাম নারীর অবস্থানকে প্রথম যে উচ্চতায় নিয়ে যায়, তা ছিল সেই যুগে, যখন নারীর কোনো সামাজিক স্বীকৃতি ছিল না।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “যে কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিল, তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে—কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল ।” (সূরা তাকভীর, আয়াত ৮-৯)
এই আয়াত একদিকে যেমন সেই বর্বরতা বন্ধের বার্তা দেয়, অন্যদিকে নারীর প্রতি অপরাধের জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে দায়ী করে।
প্রথম ওহির শব্দ ছিল “ইক্রা”—পড়ো। মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-কে এই নির্দেশনার মাধ্যমে শিক্ষা ও জ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। এই নির্দেশনার ভেতর নারী-পুরুষের কোনো ভেদাভেদ ছিল না। বরং হাদীসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে:
“জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর ও নারীর ওপর ফরজ।” (ইবনে মাজাহ, হাদীস ২২৪)
হজরত আয়েশা (রা.) ছিলেন সেই নারী, যিনি শুধু নবীজির (সা.) সহধর্মিণী ছিলেন না—তিনি ছিলেন ইসলামি জ্ঞানের এক বিশাল উৎস। তার থেকে শত শত হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তিনি সাহাবিদের শিক্ষক ছিলেন। তিনি শুধু গৃহকোণেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, ছিলেন চিন্তার জগতে অগ্রগামী।
আরও পড়ুন-
নারীর মর্যাদা ও আধুনিক বিভ্রান্তিঃ ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক বাস্তবতা
সমাজের মোড়কে ধর্মের বিকৃতি
আজকের সমাজে, এই ইসলামকেই বিকৃতভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে নারীর বিরুদ্ধে। এক ধরনের সামাজিক ইসলাম তৈরি হয়েছে, যেখানে শালীনতার মানদণ্ড কেবল নারীর পোশাক দিয়ে মাপা হয়, কিন্তু পুরুষের আচরণ নিয়ে নেই তেমন কোনো সমাজচাপ বা জবাবদিহি।
এ এক নির্মম প্রহসন—ধর্মের নামে সমাজ তৈরি করেছে এক “নির্বাক নারী মডেল”, যেখানে নারী শুধু অনুগত থাকবে, প্রশ্নহীন থাকবে, ভাবনাহীন থাকবে। এই বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামের প্রকৃত বার্তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইসলাম নারীর মর্যাদা দিয়েছে তার চিন্তা, চরিত্র ও বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে।
“পুরুষরা নারীদের অভিভাবক, কারণ আল্লাহ তাঁদের একের উপর অন্যের শ্রেষ্ঠতা দিয়েছেন এবং তারা তাঁদের উপার্জন হতে ব্যয় করে।”(সূরা নিসা, আয়াত ৩৪)
এই আয়াতে দায়িত্ব ও রক্ষণশীলতার কথা বলা হয়েছে, কর্তৃত্ব নয়। দায়িত্ব পালনের নামে নারীকে দমন করার বৈধতা এখানে নেই।
চিন্তা করা নারীকে ভয়
সমাজ ভয় পায় চিন্তাশীল নারীকে। কারণ সে আর নিয়ন্ত্রণযোগ্য থাকে না। সে প্রশ্ন তোলে, বুঝে কথা বলে, নিজের পথ নিজে বেছে নেয়। এই ভয় থেকেই সমাজ তাকে চুপ করিয়ে দিতে চায়, তার শিক্ষাকে শুধু সার্টিফিকেটে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। অথচ ইসলাম বলেছে:
“বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না—তারা কি সমান হতে পারে?”(সূরা যুমার, আয়াত ৯)
জ্ঞান ও চিন্তার মাঝে ভেদ নেই ইসলামিক দৃষ্টিতে। বরং নারী যখন জানবে, বুঝবে, তখনই সে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হবে। নারীর চিন্তা করা অপরাধ নয়, বরং তা তার ইবাদতেরই এক রূপ। যে নারী সত্য জানতে চায়, প্রশ্ন তোলে, ধর্মের প্রকৃত আলোয় নিজেকে জানতে চায়—সে বিদ্রোহী নয়, সে পথপ্রদর্শক।
শিক্ষিত নারী কেবল মুখস্থ করবে না,সে সত্য জানবে, যুক্তি খুঁজবে, এবং নিজের আত্মপরিচয় নিজেই গড়ে তুলবে। এমন নারীর ভয় সমাজ করে ঠিকই, কারণ তার ভেতরেই থাকে পরিবর্তনের বীজ।
একদিন এই সমাজ বুঝবে—
নারীর চিন্তার স্বাধীনতাই সমাজের প্রকৃত মুক্তি।
আর সেই নারী, যে নিজের পরিচয় নিজের কলমে লিখে,
সে-ই হবে আলো, সে-ই হবে পরিবর্তনের নীরব বিপ্লব।
লেখক পরিচিতিঃ শিমুন লিজা একজন কলমসৈনিক, যিনি সমাজ, নারীর অবস্থান এবং ইসলামিক মূল্যবোধ নিয়ে লেখালেখি করতে ভালোবাসেন। মানবিক ও বাস্তব অভিজ্ঞতার মিশেলে তিনি পাঠকের মনে জায়গা করে নিতে আগ্রহী।
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল, আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেইজ মহীয়সী/Mohioshi-তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হ্যাঁ, মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইল-
[email protected] ও [email protected] -এ; মনে রাখবেন, “ধন দৌলত খরচ করলে কমে যায়, কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়”। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকেই দ্বীনি জ্ঞান দান করেন।” (সহিহ বুখারী- ৭১, ৩১১৬, ৩৬৪১, ৭৩১২, ৭৪৬০; মুসলিম- ১০৩৭; ইবনে মাজাহ- ২২১) ।
মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম; আজই আপনি যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে। আসুন, ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ, সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি। আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমীন।