।। মুহাম্মদ সাব্বির বিন জাব্বির ।।
পিঠ পোড়া রোদ মাখা দিন। রোদের চাদর ফেলে ছায়া সবেমাত্র মুখ বের করেছে। বসে আছি আমি একা একা নিরালায়। সূর্যিমামা রক্তিম হ’য়ে বিদায়ের জন্য উঁকি দিচ্ছে। কেন যেন নীল আকাশটাও থমকে গেছে! ঘনঘোর মেঘ এসে ভীড় করছে তার বুকে। স্রোতস্বিনীও এক স্রোত দুঃখ নিয়ে ঢেউ তুলছে। পাখিগুলোও কিচিরমিচির সুরে গান গেয়ে নীড়ে ফিরছে। তাদের প্রত্যেকর দুঃখ আমি বুঝি। যখন আমার সব ছিল তখন হারানোর এমন করুণ স্বর আমার মনন গহীনে বাজেনি।এখন আমার সব থেকেও যেন কিছুই নেই।
সময়টা ১১ এ নভেম্বর ২০১৮!! বিষাদ ও মর্মযন্ত্রণার সাক্ষর করা একটি দিন। সামনে পরীক্ষা। ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সেদিন অন্য সকলের মতো খেলাধুলা, ঘুরাঘুরি বা গালগল্পে মত্ত ছিলাম না। বিকেলেও বইয়ের সাথে আমার মিতালি ছিল দিব্যি। কি একটি বই যেন পড়ছিলাম! সম্ভবত এ্যারাবিক কোন বই হবে। তবে যাই পড়ছিলাম, বইয়ে ডুব দিয়েছিলাম নিবিড়। সহসা ঘড়ির দিকে চোখ পড়লো। মাগরিবের আযানের আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। নামাজের প্রস্তুতির জন্য বই রেখে উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথেই একজন এসে বললো – সাব্বির ভাই! আপনাকে ওস্তাদজী খোঁজছেন।
আমি ওস্তাযের নিকট চলে গেলাম। তিনি আমাকে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করে বললেনঃ এক্ষুনি তোমাকে বাড়িতে যেতে হবে। আমি হকচকিয়ে গিয়ে বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলাম, কেনো? তিনি ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন “তোমার মা আর এ-ই দুনিয়াতে নেই! ওপারে পাড়ি জমিয়েছেন”। মনে হল, আকাশ ভেঙে বুঝি আমার মাথায় পড়লো, পায়ের নিচের মাটি ফেটে মনে হয় আমি নিম্নগগনে চলে যাচ্ছি; হিমালয় পর্বত বুঝি আমার মাথায় তুলে দেয়া হয়েছে~ কথাটা এতে ভারী লাগলো। অশ্রনদ দিয়ে গাল বেয়ে টিপটিপ করে পানি ঝরছে। ক্ষীণ সময়ের মধ্যেই আমার অক্ষিদ্বয় রক্তিম হয়ে গেলো।
কালক্ষেপণ না করে ঢাকা থেকে আমি গ্রামে মায়ের উদ্দেশ্যে ছুটে চল্লাম। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু কনকনে শীতে আমাকে রিসিভ করে বাসায় নিয়ে গেল। তখন রাত দুইটা। দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশের সাথে সাথেই অক্ষিপটে দৃশ্যমান হল মায়ের শুয়ানো লাশ। আমি হাউমাউ করে চিৎকার করে উঠলাম। আত্মহারা হয়ে গেলাম। মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে, আমার মা মরতে পারে। হঠাৎ আল্লাহ তায়ালার সেই অমীয় বাণীর কথা স্মরণ হয়ে গেল-
প্রত্যেক প্রাণীকেই একদিন মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। (আল-কুরআন)
আমি কাঁদলে সবাই কাঁদবে। কাঁদলে মায়ের কষ্ট হবে ভেবে কাঁদা বাদ দিলাম এবং সবাইকে বলে দিলাম এখানে কেউ কাঁদতে পারবেনা।
রাতের চাদর ফেলে দিন মুখ বের করলো। মায়ের মৃত দেহ দাফনের বন্দোবস্ত শুরু হয়ে গেল। সকাল ৯.৩০ এ জানাযায় আমি ইমামের স্থানে দাঁড়ালাম। তেলাওয়াত করছিলাম আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম। কোন মতে সালাত শেষ করে মায়ের মৃত দেহ রাখা খাটিয়া কাঁধে নিলাম। আল্লাহর কসম! ছেলের কাঁধে মায়ের লাশ এর চেয়ে আর কঠিন কিছু দুনিয়াতে হতে পারেনা। তখন আমি জীবন্মৃত; একেবারে অনুভূতি শূন্য হয়ে গেলাম। অবশেষে চিরাচরিত নিয়মের ধূম্রজালে আটকে নিজ হাতে মাকে জনশূন্য ঘর কবরে রেখে বাড়ি ফিরে এলাম।
সেই দিনটা ছিলো আমার নাতিদীর্ঘ ইতিহাসের বিষাদ-বেদনা মাখা ও মর্মযন্ত্রণার সাক্ষর করা একটি দিন। সেদিন আমি চিৎকার করে কাঁদতে চাইলেও, কাঁদতে পারিনি। পারিনি বিলাপ করতে, কারণ রবের অপ্রিয় হতে চাইনি। চাইনি আমার কারণে মায়ের রুহের কষ্ট হোক। চাপা কান্না আর যন্ত্রণার ভারে বাতাস সেদিন ভারী হয়ে গিয়েছিলো। সেদিন থেকে আমি নতুন এক পরিচয়ে আবদ্ধ হলাম “আমি মা হারা ছেলে”।
আগে যখন কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করতো আমার ফ্যামিলিতে কে কে আছেন। আমি নির্ভাবনায় বলতাম বাবা-মা, ভাই সবাই আছেন। কিন্তু আজ কেন বলতে পারিনা আমার মা আছেন! কেনো বলতে হয় আমি মা হারা ছেলে! মা আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছেন; কিন্তু যখনি তাঁর জন্য কিছু করতে চাইলাম তখনি তিনি আমাকে না বলে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আজ চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে মা, মা, মা বলে।কিন্তু কেঁদেই বা কি লাভ! তিনি তো আর শুনতে পাননা!!
দেখো মা! তোমার হাত ধরেই আমি হাঁটতে শিখেছি। আধো আধো বুলিতে প্রথম শব্দটা তোমার কাছ থেকেই শেখা। তুমি বিনা এ পৃথিবীতে আমি বড্ড অসহায়, সবখানে অনুভব করছি তোমার শূন্যতা। তুমি চলে যাওয়াতে ভেতরটা আমার একদম অন্ধকার। অসীম এক স্তব্ধতার প্রতি গ্রাস করে রাখে আমার দুর্বল মন-প্রাণ।
জানো মা!! কত রাত তোমাকে হারানোর যন্ত্রণায় আমি নির্ঘুম কাটিয়েছি। যতদিন বেঁচে থাকবো কোনদিন তোমার শূন্যতা পূরণ হবে না। কিন্তু সেই শূন্যতাকে পূরণ করতে আমার চেষ্টা- তোমার সততার আদর্শকে লালন করা, অন্যের কষ্টে হাত বাড়িয়ে দেয়া, তোমার দেখানো আদর্শ পথ দ্বীনের পথে চলা।
ক্ষমা করো মা!! তোমার জন্য কিচ্ছুই করতে পারিনি। এখন আছেই বা আর কি করার! দান-সাদকা আর দু’আ ছাড়া নাই যে কিছু করার। ওপারেতে আল্লাহ তায়ালা তোমাকে ভালো রাখুন।
হে আল্লাহ! আমার মা যেমন আমাকে ছোটবেলা আদর-যত্নে লালন-পালন করেছেন ঠিক তেমনি তুমিও আমার মাকে আদর-যত্নে রাখো।(আমীন)
লেখকঃ গল্পকার ও কলাম লেখক
আরও পড়ুন- জীবন চলার পথে বন্ধু