Ads

একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আশালতা বৈদ্য

অনিক কুমার সাহা

মাত্র ১৬ বছর বয়সে দেশমাতৃকার টানে যুদ্ধে চলে যান আশালতা। মুক্তিযুদ্ধের সময় নেতৃত্ব দিয়েছেন ৪৫ জনের সশস্ত্র নারী গেরিলা দলকে। এ ছাড়া ৩৫০ নারীকে নিয়ে গঠিত একটি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। আশালতা বৈদ্য ১৯৫৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।

স্কুল জীবনে দেশের জন্য কিছু করার তাগিদেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ঘরে বসে থাকতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের ৮ ও ৯ নং সেক্টরে কোটালীপাড়া সীমানা সাব সেক্টর কমান্ডার হেমায়েত বাহিনীতে যোগ দেন তিনি। হেমায়েত বাহিনীতে মহিলা বাহিনী নামে আলাদা একটা বাহিনী গঠন করা হয়। এ মহিলা বাহিনীতে মোট ৩৫০ জন নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এই বিশাল নারী মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর একমাত্র কমান্ডার ছিলেন আশালতা বৈদ্য।

২২টি বড় বড় যুদ্ধে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের একমাত্র নারী কমান্ডার আশালতা বৈদ্য, মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি ছিলেন ৩০০ অধিক নারী মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডার। ১৯৭১ সালে আশালতা বৈদ্য ছিলেন এস. এস. সি পরিক্ষার্থী। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে একদিন রাজাকাররা উনার বাড়িতে এসে বাবা হরিপদ বৈদ্যর কাছে কয়েক লক্ষ টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে আশালতা ও তাঁর বোনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়। এই অবস্থায় হরিপদ বাবু মেয়েদের রক্ষায় সপরিবারে ভারতে চলে যাওয়ার চিন্তা করতে থাকেন। এই ঘটনার আদ্যপ্রান্ত সমস্তকিছু কানে যায় গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার হেমায়েত বাহিনীর প্রধান আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিনের। তিনি আশালতাকে দেশত্যাগ করে ভারতে না গিয়ে নিজের মাতৃভূমিতে থেকে দেশমাতৃকা তথা মা বোনের সম্মান রক্ষার্থে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করলেন। আশালতা বৈদ্য সিদ্ধান্ত নিলেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার। শুধু তাই নয়, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার নিজ এলাকার সাহসী ৪৫ মহিলাকেও আশালতা বৈদ্য উদ্বুদ্ধ করেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে। তাদের নিয়ে গঠন করেন মহিলা মুক্তিযোদ্ধা দল। মে মাসে এ দল পুরোপুরি সংগঠিত হলে তিনি তাদের নিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। হেমায়েত বাহিনীর তত্বাবধানে এই প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয় বরিশালের হেরেকান্দি হাইস্কুলে ও লেবুর বাড়ি প্রাইমারি স্কুলে। প্রশিক্ষণ হয় রাইফেল, মেশিনগান, গ্রেনেড চার্জ সহ বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র পরিচালনার। স্বল্পসময়ের প্রশিক্ষণে আশালতা বৈদ্য অস্ত্র পরিচালনা এবং যুদ্ধকৌশলের উপর আশ্চর্যজনক পারদর্শিতা লাভ করেন, যার কারনে আরো ৩০০ জন মহিলা সহ মোট ৩৪৫ জন নারী মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতৃত্ব অর্পিত হয় উনার ওপর। বিশাল এই মহিলা মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতৃত্ব পেয়ে আশালতা বৈদ্য দায়িত্ব পালনে দুঃসাহসিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেন। এবার যুদ্ধে গেরিলা অপারেশন শুরু হওয়ার পালা। ১৯৭১ এর ২৪ জুন কোটালীপাড়া, হরিণাহাটি, ঘাঘর বাজার, শিকের বাজার ও রামশীলে খান সেনাদের বিরুদ্ধে সরাসরি গেরিলা যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। এ যুদ্ধে আশালতা বৈদ্যের দুঃসাহসিকতা, সুনিপুণতা, দক্ষতা রূপকথাকেও হার মানায়। সেইদিন তাঁর বাহিনীর হাতে বহু পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয় এবং বন্দি হয় ২৫ পাকিস্তানি সেনা। বন্দি পাকিস্তানী সেনাদের ধরে আনা হয় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। সেখানে তাদের বিচার করা হয়। বিচারকদের একজন ছিলেন আশলতা বৈদ্য। বিচারে তাদের সবাইকে হত্যার রায় হয়। আশালতার নির্দেশে সে রায় কার্যকর করা হয়। অর্থাৎ সকল বন্দী পাকিস্তানি সেনাদের হত্যা করা হয়।

১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন শ্বাসরুদ্ধকর ৯টি মাসের ১টি দিনও তাঁর যুদ্ধ অথবা যুদ্ধের পরিকল্পনা ছাড়া কাটেনি। এই ৯ মাস দেশ মাতৃকার জন্য যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনো চিন্তাই উনার মাথায় ক্ষণিকের জন্যও আসে নাই। মাত্র ১৫/১৬ বছর বয়সে ৩৪৫ জন নারী মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতৃত্ব দিয়ে ৮ এবং ৯ নং সেক্টরের অধীন গোপালগঞ্জে ছোটোখাটো অনেক গেরিলা যুদ্ধ ছাড়াও ২২টি বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন আশালতা বৈদ্য। এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটিতে নেতৃত্ব দেন তিনি। অনেক পাকিস্তানি সেনা হত্যা করেন নিজ হাতে।

তিনি শুধু প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন নিজ হাতে। সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে সহযোদ্ধাদের সারিয়ে তুলে তাদের সঙ্গে নিয়ে আবার যুদ্ধে গেছেন। এই অপ্রতিরোধ্য নারী যোদ্ধা যুদ্ধকেই যেন ধ্যানজ্ঞান বানিয়ে ফেলেছিলেন।

দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি আবার পড়াশুনা শুর করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে তিনি উচ্চশিক্ষা শেষ করেন। ৮০-এর দশকে নারী উন্নয়নের লক্ষে গড়ে তোলেন “সূর্যমুখী সংস্থা”। বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগেও তিনি মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। আশালতা বৈদ্য তার বৈচিত্র্যময় জীবনের সেবামূলক কাজের জন্য ২০০৫ সালে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার বাছাই কমিটিতে মনোয়ন পেয়েছিলেন। এছাড়া তিনি শ্রেষ্ঠ মহিলা সমবায়ের প্রেসিডেন্ট স্বর্নপদক, রোকেয়া পদক, প্রশিকা মুক্তিযোদ্ধা পদকসহ অনেক পুরষ্কার লাভ করেছেন।

তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এত এত অবদানের পরও একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি আজও কোনো রাষ্ট্রীয় উপাধি পাননি। প্রজন্মও মনে রাখেনি বাংলা মায়ের এই বীরকন্যা আশালতা বৈদ্যকে।

লেখকঃ সাহিত্যিক ও কলামিস্ট

 

আরও পড়ুন