Ads

কর্মক্ষেত্রে নারীর পদচারণা : ইসলামী মূলনীতি ও সতর্কতা

।। জামান শামস ।।

প্রথমে এটা স্বীকার করতেই হবে যে নারীর আসল কর্মক্ষেত্র তার গৃহ। পবিত্র কুরআন ও হাদীসের Reference অন্তত তাই বলে। কিন্তু সাহাবাগণের যুগ থেকেই গৃহাভ্যন্তর থেকে নারীরা বাইরে যে কাজ করেছেন তার Practice যে ছিলো তাও প্রমাণিত সত্য। গতকালের একটি লিখায়ও এ কথাটি বলেছি।এ কারণে একজন পুরুষের জন্য সমাজে যে সব অধিকার স্বীকৃত মেয়েদের বেলায়ও তেমন।
গৃহভ্যন্তরে নারীদের থাকার বিষয়টা শুধু নবী পত্নীদের বেলায় প্রযোজ্য এটা কুরআনের আয়াতেই সুস্পষ্ট যা অন্য নারীদের বেলায় কঠোরভাবে প্রয়োগযোগ্য নয়।
یٰنِسَآءَ النَّبِیِّ لَسۡتُنَّ کَاَحَدٍ مِّنَ النِّسَآءِ اِنِ اتَّقَیۡتُنَّ فَلَا تَخۡضَعۡنَ بِالۡقَوۡلِ فَیَطۡمَعَ الَّذِیۡ فِیۡ قَلۡبِہٖ مَرَضٌ وَّقُلۡنَ قَوۡلًا مَّعۡرُوۡفًا ۚ
وَقَرۡنَ فِیۡ بُیُوۡتِکُنَّ وَلَا تَبَرَّجۡنَ تَبَرُّجَ الۡجَاہِلِیَّۃِ الۡاُوۡلٰی وَاَقِمۡنَ الصَّلٰوۃَ وَاٰتِیۡنَ الزَّکٰوۃَ وَاَطِعۡنَ اللّٰہَ وَرَسُوۡلَہٗ ؕ اِنَّمَا یُرِیۡدُ اللّٰہُ لِیُذۡہِبَ عَنۡکُمُ الرِّجۡسَ اَہۡلَ الۡبَیۡتِ وَیُطَہِّرَکُمۡ تَطۡہِیۡرًا ۚ
وَاذۡکُرۡنَ مَا یُتۡلٰی فِیۡ بُیُوۡتِکُنَّ مِنۡ اٰیٰتِ اللّٰہِ وَالۡحِکۡمَۃِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ لَطِیۡفًا خَبِیۡرًا
হে নবী-পত্নীগণ ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও ; যদি তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর তবে পর-পুরুষের সঙ্গে কোমলকণ্ঠে এমনভাবে কথা বল না, যাতে অন্তরে যার ব্যাধি আছে, সে প্রলুব্ধ হয় এবং তোমরা ন্যায়সংগত কথা বলবে। আর তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাচীন যুগের মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না। তোমরা সালাত কায়েম করবে ও যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের অনুগত থাকবে। হে নবী-পরিবার! আল্লাহ্ তো কেবল চান তোমাদের হতে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। আল্লাহ্ র আয়াত ও জ্ঞানের কথা যা তোমাদের গৃহে পঠিত হয়, তা তোমরা স্মরণ রাখবে ; নিশ্চয়ই আল্লাহ্ অতি সূক্ষ্মদর্শী, সর্ববিষয়ে অবহিত। (সূরা আহযাব : ৩২-৩৪)
পূর্বেই বলেছি কোন কোন স্কলার এই আয়াতের নির্দেশ সকল যুগের সকল নারীর জন্য সমানভাবে পরিপালনযোগ্য বলে ধরে নিয়েছেন যদিও আল্লাহ নিজেই তাদের বলছেন যে তোমরা অন্যান্য নারীদের মত নও। নবী পত্নীদের সাথে অন্য মুসলিম নারীদের পার্থক্য তারা ভুলেই গিয়েছেন। অন্য নারীরা বিধবা হলে ইদ্দত পালন শেষে তাদের বিয়ে হতে বাধা নেই কিন্তু নবী পত্নীদের বেলায় এ সুযোগ নেই। এ রকম আরো বিষয় রয়েছে যেখানে নবী পত্নীগণের মর্যাদা সাধারণ নারীদের চেয়ে অনেক অনেক বেশী সে কারণে তাদের চলাফেরা ও বাইরের জগতে প্রবেশে নিষেধ করা হয়েছিল।

 

তবুও কি মেয়েরা এমনকি রাসুলের স্ত্রী হযরত আয়েশা (রাঃ) উষ্ট্রের যুদ্ধে অংশ নেননি? মেয়েরা সৈনিকদের খাবার রান্না করেছেন, জখম হওয়া সৈন্যদের সেবা শুশ্রূষাও করেছেন-এমন প্রমাণ হাদীসে বহু রয়েছে। আধুনিককালে মেয়েরা আরো এগিয়েছে— লেখাপড়া শিখে এখন তারা শিক্ষক হচ্ছেন । পেশাদার ব্যাংকার, বিচারক, চিকিৎসক ও প্রকৌশলী হচ্ছেন। এসব ক্ষেত্রে কেউ কেউ শীর্ষ ধাপেও এগিয়ে এসেছেন। আধুনিক স্কলারগণ তার জন্য মনোনীত কোন পেশা নির্বাচনে বিশেষতঃ শিক্ষকতা, নার্সিং ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে এবং কাউন্সিলিং জাতীয় কাজে তাদের বাঁধা মনে করেন না  । তবে যেসব পেশায় শরীর, বিচার ক্ষমতা ও মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে নারী ভুল করতে পারেন সে ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন যেমন প্রধান সেনাপতি, প্রধান বিচারপতি, আকাশযানের চালক, সাংসদ ও রাজনীতিক।
একটা কথা এখানে বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য যে নারীদের দেহমন পুরুষদের থেকে পৃথক। আল্লাহ পাক মহান স্রষ্টা হিসাবে তাকে গৃহভ্যন্তরে সন্তান প্রতিপালন, স্বামীর সম্পদ সংরক্ষণ ও সেবাধর্মী কাজের উপযোগী করে তৈরী করেছেন- এই কাজগুলো সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে তার জন্য জাহাজের ক্যাপ্টেন, যুদ্ধের সেনাপতি, আদালতের এ্যাডভোকেট ও ব্যস্ত ব্যাংক কর্মীর কাজ মোটেও উপযুক্ত নয়। তবে কোন মেয়ে যদি শ্যাম ও কুল দুটো ঠিক রেখে অথবা স্বামী-স্ত্রী কাজ ভাগাভাগি করে সংসার সামাল দিয়ে নিজ নিজ পেশায় সফলতা দেখাতে পারে তাহলে তা কিছুকাল চলতে পারে। সেটাকে নিয়ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে অনেক স্কলারের আপত্তি রয়েছে। আমার দেখা,অনেক আগ্রহ ও দক্ষতার সাথে ব্যাংক বীমায় কয়েক বছর চাকুরী করার পর স্ব ইচ্ছায় শুধুমাত্র সন্তানদের স্বার্থে চাকুরী ছেড়েছেন,এমন অনেকের কথা জানি। আমার ব্যাংকেই শাখার নেতৃত্বদানের সকল যোগ্যতা থাকার পরও তাদেরকে রাখতে পারিনি কারণ একসময় সংসারের টানে তারা চাকুরী ছাড়তে বাধ্য হোন।
রাসুল (সাঃ) এর যুগের কয়েকটা ঘটনা এখানে উল্লেখ্য আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) এর স্ত্রী হস্তশিল্প ও কারিগরি জ্ঞানে দক্ষ ছিলেন। এটাকে কাজে লাগিয়ে তিনি স্বামী ও সন্তানদের ব্যয় নির্বাহ করতেন। একদিন তিনি নবী (সাঃ) কে বললেন- হে আল্লাহর রাসুল আমি কারিগরি বিদ্যায় দক্ষ । আমি বিভিন্ন হস্তশিল্প তৈরি করে বিক্রয় করি। তারা আমাকে ব্যস্ত রাখার ফলে আমি আমার আয় থেকে ছাদাকা করতেও পারি না। তাদের জন্য খরচ করা হলে আমি কি কোন পুরস্কার পাবো? রাসুল (সাঃ) হ্যাঁ বলেন। (আহমাদ)।
খাওলা বিনতে ছালাবার সাথে তার স্বামী জিহার করলে রাসুলুলাহ (সাঃ) ছালাবাকে তার স্বামী থেকে আলাদা থাকতে বললেন। তখন ছালাবা রাসুলুল্লাহ সালাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন- আমার স্বামীর কোন আয় রোজগার নেই। আমি তার থেকে বিচ্ছিন্ন হলে সে কিভাবে জীবনযাপন করবে? (আত তাবাকাবুল কুবরা)
যাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন আমার খালাকে তালাক দেয়া হলে তিনি ইদ্দতের মধ্যে গাছ থেকে খেজুর কাটতে চাইলো। কিন্তু কেউ কেউ তাকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করলেন। তিনি রাসুল (সাঃ)-এর কাছে জিজ্ঞাসা করলে রাসুল (সাঃ) বলেন-বের হয়ে যাও এবং খেজুর কাট। এই টাকা দিয়ে তুমি হয়তো দান খয়রাত করতে পারবে অথবা অন্য কোন ভাল কাজ করতে পারবে। (মুসলিম)।
কাজেই এসব হাদীস থেকে সুস্পষ্ট যে রুটি রুজির-তালাশে মহিলাদের যে কোন উত্তম পেশা নির্বাচনে বাঁধা নেই। বিশেষ করে বর্তমানকালে হস্তশিল্প ও ক্ষুদ্র ব্যবসা (SME) শিক্ষকতা, নার্সিং সেবা এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ অনিবার্য হয়ে পড়েছে। এর বাইরে ইমিগ্রেশান, শুল্ক ও কর গ্রহীতা ব্যাংকিং হিসাব নিকাশ ইত্যাদি পেশাও তাদের সঙ্গে মানানসই।
রিসেপসানিস্ট, বিক্রয়কর্মী, তথ্য প্রদানকারী, খাদ্য পরিবেশনকারী, গাড়ী চালনা, যন্ত্র কৌশল, বিচার-শালিস এমন সব পেশা নারী চরিত্রের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কেননা এর কয়েকটাতে নারীর সাজসজ্জা প্রকাশ পায় ও কোমল কণ্ঠের আদান প্রদান হয় যা শরীয়াহ সমর্থিত নয় । আর ভারী কাজগুলো তাদের শারীরিক সক্ষমতার বাইরে। আমলা পেশাও পরিবেশ পরিস্থিতি ও কুট কৌশল মানিয়ে নেয়ার বিষয় সে কারণে তাও নারী প্রকৃতির সাথে খাপ খায় না ।
একথা অনস্বীকার্য যে পুরুষের শক্তিমত্তা, কষ্ট সহিষ্ণুতা এবং প্রতিকুলতার মধ্যে চলা আর নারীদের শক্তিমত্তা কোমলতা ও নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা বিবেচনায় দুজনের প্রকৃতি দুই ধরনের। পেশা নির্বাচনে তাই নারীকে হতে হবে সতর্ক, পর্যবেক্ষণমুলক এবং শক্তি মেধার সাথে সামঞ্জস্যশীল। একই সাথে যেখানে নিজকে পবিত্র রাখার আশঙ্কা বিদ্যমান, পর্দার বিধান লঙ্ঘন চাকরির শর্ত, অসততার পথ অবলম্বনই ঐ পেশার চরিত্র এমন পেশার কাছে না যাওয়াই শ্রেয়।
কর্মক্ষেত্রে নারীর যোগদানের ক্ষেত্রে আরো কয়েকটা বিষয় অনুসরণীয়-
১. কাজটা মৌলিকভাবে শরীয়ার সুস্পষ্ট সীমা লংঘন করে না
২. কাজটার প্রতি ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রয়োজন থাকতে হবে
৩. পুরুষের সাথে যথাসম্ভব কম মেলামেশা ও কথা বিনিময় হতে হবে
৪. শরীয়া নির্ধারিত পোশাক পরিধান করতে কোন বাঁধা দেয়া হবে না
৫. নিজের ইজ্জত ও আব্রুর নিরাপত্তা বিধানের নিশ্চয়তা থাকবে
৬. স্বামী ও মুরুব্বীদের ঐ কাজের প্রতি সমর্থন ও অনুমতি থাকবে
৭. নারীর অসম্মান ও অপমান হয় এমন কর্মে নিয়োজিত হওয়া যাবে না
৮. পথে বা কর্মস্থলে ফিতনা থেকে বিরত থাকতে পারবে
৯. পারিবারিক দায়িত্ব অর্থাৎ স্বামী ও সন্তানাদির সেবার ব্যাপারে চাকরি যেন প্রতিদ্বন্ধী না হয়। ১০. কর্মপরিবেশ নারীর ব্যক্তিসত্তা বিকাশের পথে বাধা হবে না।
আল্লাহ আমাদের বুঝার ও মানার তৌফিক দিন।আমিন।
উৎসঃ  লেখকের “আল্ কুরআনে নারী প্রসংগ” বই থেকে
লেখকঃ  কলাম লেখক ও সাবেক  এ এম ডি , ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড

 

ফেসবুকে লেখকের প্রোফাইলের লিংক-Zaman Shams

কর্মক্ষেত্রে নারীর পদচারণা : ইসলামী মূলনীতি ও সতর্কতা – কর্মক্ষেত্রে নারীর পদচারণা : ইসলামী মূলনীতি ও সতর্কতা – কর্মক্ষেত্রে নারীর পদচারণা : ইসলামী মূলনীতি ও সতর্কতা

আরও পড়ুন