Ads

যিনি ছিলেন দুই খলিফার স্ত্রী

আরিফুল ইসলাম

আধুনিককালে একজন প্রেসিডেন্টের স্ত্রীকে ‘ফার্স্ট লেডি’ বলে ডাকা হয়। একবার চিন্তা করুন, তুরস্ক/অ্যামেরিকা/রাশিয়ার ২০০০ সালের একজন প্রেসিডেন্টের স্ত্রীর কথা। ২০০৫ সালে তার প্রেসিডেন্ট স্বামী মারা যান, ২০০৮ সালে তার আরেকটি বিয়ে হয়। ২০২০ সালে দেখা গেলো, প্রেসিডেন্ট স্বামীর মৃত্যুর পর যার সাথে তার বিয়ে হয়েছিলো, তিনি প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন! এমন নিউজ সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে- হোয়াইট হাউজে দুইবার দুজন প্রেসিডেন্টের স্ত্রী হিশেবে ‘মিসেস ক’ প্রবেশ করলেন! সবাই বলবে- ‘কী সৌভাগ্যবতী তিনি’!

হিন্দ বিনতে আউফকে বলা হয় ‘ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ শ্বাশুড়ি’। তাঁর মেয়ের জামাই ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে শুরু করে শ্রেষ্ঠ সাহাবী, এমনকি কাফির গোত্রপতি। মাইমুনা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) এবং যাইনাব বিনতে খুজাইমা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রী।

আসমা বিনতে উমাইস (রাদিয়াল্লাহু আনহা), তিনি ছিলেন হিন্দ বিনতে আউফের আরেকজন মেয়ে। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইসলাম প্রচারের শুরুর দিকে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর বিয়ে হয় রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চাচাতো ভাই জাফর ইবনে আবি তালিবের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সাথে। তারা দুজন আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন।

আবিসিনিয়ায় হিজরতের প্রায় ১২ বছর পর যখন খাইবার বিজয় হয়, আসমা ও জাফর (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) মদীনায় ফিরেন। তাঁদেরকে দেখে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপ্লুত হোন।

একদিন আসমা বিনতে উমাইস (রা:) উম্মুল মুমিনীন হাফসার (রাদিয়াল্লাহু আনহা) ঘরে যান। হাফসার (রা:) বাবা উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সেখানে উপস্থিত হোন। তিনি মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন, “এই মহিলা কে?” হাফসা (রা:) জবাব দেন, “উনি হলেন আসমা বিনতে উমাইস (রা:)।”
উমর (রা:) বললেন, “সেই আবিসিনিয়ার মহিলা? (শোনো), মদীনায় হিজরতের মাধ্যমে আমরা মর্যাদার দিক থেকে তোমাদেরকে অতিক্রম করেছি। তোমাদের তুলনায় রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি আমাদের হক বেশি।” উমর (রা:) তাঁকে কথার মাধ্যমে খোঁচা দিলেন!
আসমা (রা:) জবাব দেন:“হ্যাঁ, তা আপনি ঠিক বলছেন। আপনারা রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে ছিলেন, তিনি আপনাদের ক্ষুধার্তদের আহার করাতেন আর মূর্খদের শিক্ষা দিতেন। অন্যদিকে, আমরা ছিলাম এমন এক দেশে, যা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বহুদূরে এবং সর্বদা শত্রু বেষ্টিত। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উদ্দেশ্যেই ছিলো আমাদের এই হিজরত।”
আসমা (রা:) জেদ ধরেন। উমর (রা:) তাঁকে যে কথার মাধ্যমে খোঁচা দেন, সেটা তিনি রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জানাবেন। রাসূলুল্লাহকে না জানানো পর্যন্ত তিনি মুখে দানা-পানি দেবেন না।

আসমা (রা:) রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উমরের (রা:) ব্যাপারে ‘বিচার’ দিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে সুন্দর একটি জবাব দেন:
“আমার প্রতি তোমাদের তুলনায় তাঁর (উমর) ও তাঁর সঙ্গীদের বেশি হক নেই (তোমাদের প্রতিই বরং বেশি হক)। কারণ, তাঁর ও তাঁর সঙ্গীদের জন্য আছে কেবল একটি হিজরত (মক্কা থেকে মদীনা)। অন্যদিকে, তোমাদের জন্য আছে দুটো (মক্কা থেকে আবিসিনিয়া, আবিসিনিয়া থেকে মদীনা) হিজরত।”
রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছ থেকে এমন স্বীকৃতি পেয়ে আসমা (রা:) অনেক খুশি হোন। দুটো হিজরতকারী সাহাবীদের কাছে এই হাদীসটি ছিলো খুবই প্রিয়। তারা আসমার (রা:) কাছে হাদীসটি শুনতে যেতেন।

ঐতিহাসিক মূতার যুদ্ধে জাফর ইবনে আবি তালিব (রা:) ছিলেন তিনজনের মধ্যে একজন কম্যান্ডার। সেই যুদ্ধে তিনি শাহাদাতবরণ করেন। আসমা (রা:) হারান তাঁর প্রথম স্বামীকে। স্বামীর বিয়োগ তাঁকে বেশ কয়েকদিন শোকাচ্ছন্ন করে রাখে। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুরোধে অবশেষে তিনি কান্নাকাটি বন্ধ করেন।
জাফরের ঘরে তাঁর তিনজন ছেলের জন্ম হয়। একজনের নাম ছিলো মুহাম্মদ ইবনে জাফর।
জাফর ইবনে আবি তালিবের (রা:) ইন্তেকালের ৬ মাস পর আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) –এর সাথে আসমার (রা:) বিয়ে হয়। বিয়েটি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পড়ান। তাঁদের ঘরে একজন ছেলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নাম ছিলো- মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর।
রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইন্তেকালের পর আবু বকর (রা:) খলিফা হোন। আসমা (রা:) হোন খলিফা-পত্নী। খলিফা হবার প্রায় ২ বছরের মধ্যে আবু বকর (রা:) ইন্তেকাল করেন। দ্বিতীয়বারের মতো আসমা (রা:) স্বামীহারা হোন। ইন্তেকালের পূর্বে আবু বকর (রা:) ওসিয়ত করে যান, তাঁকে যেনো আসমা (রা:) গোসল করান।

আমাদের সমাজে কোনো নারীর স্বামী মারা গেলে তাকে ‘অলক্ষ্মী’ বলে ডাকা হয়, তাকে নানানভাবে হেয় করা হয়। কারো কারো দুটো বিয়ে হলে, দুজন স্বামী অল্প সময়ে মারা গেলে বলা হয়- ‘তুমি/তুই তো স্বামী খেয়েছিস!’
অথচ ইসলামি সমাজ ব্যবস্থা তার ঠিক বিপরীত। স্বামীর স্বাভাবিক মৃত্যুতে স্ত্রীকে তো দোষারোপ করা হয় না, বরং কিছুদিন পর বিধবাকে বিয়ে দেবার জন্য পাত্র দেখা হয়।

একবার বিধবা হলে আর বিয়ে করতে পারবে না, এমন ধারণা ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় ছিলো না। আসমা (রা:) দুই-দুইবার বিধবা হবার পরও তৃতীয়বার তাঁর বিয়ে হয়। এবার তাঁর স্বামী হলেন ‘আল্লাহর সিংহ’ নামে খ্যাত আলী ইবনে আবি তালিব (রাদিয়াল্লাহু আনহু)। আলী (রা:) বিয়ে করেন কাকে? তাঁর আপন ভাইয়ের স্ত্রীকে (ভাবী)।

আলীর (রা:) পরিবারে বেড়ে উঠেন তাঁর সৎ ছেলেরা; জাফরের (রা:) ছেলে আবু বকরের (রা:) ছেলে। একদিন জাফর ইবনে আবি তালিবের (রা:) ছেলে মুহাম্মদ ইবনে জাফর এবং আবু বকরের (রা:) ছেলে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর ঝগড়া শুরু করেন। একই মায়ের দুই সৎ-ভাই ঝগড়া করছেন তাঁদের বাবাকে নিয়ে। কার বাবা শ্রেষ্ঠ ছিলেন? মুহাম্মদ ইবনে জাফরের বাবা নাকি মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরের বাবা?

আলী (রা:) দুই ভাইয়ের ঝগড়া দেখতে পান। এই মজার ঝগড়ার বিচার করবেন কে? আলী (রা:) তাঁদের মা আসমাকে (রা:) ডাকলেন। কারণ, দুই ছেলের বাবা তো তাঁরই স্বামী।দুই খলিফার স্ত্রী আসমা (রা:) ছিলেন বেশ বুদ্ধিমতী। তিনি এমন একটি উত্তর দিলেন, টেকনিক্যালি দুজনকেই সন্তুষ্ট করা গেলো। তিনি বললেন:

“আমি আরব যুবকদের মধ্যে জাফরের (রা:) চেয়ে ভালো কাউকে পাইনি। অন্যদিকে, আরব বৃদ্ধদের মধ্যে আবু বকরের (রা:) চেয়ে ভালো কাউকে পাইনি।”

অর্থাৎ, তাঁর যুবক স্বামীর মধ্যে জাফর (রা:) সেরা, বৃদ্ধ স্বামীর মধ্যে আবু বকর (রা:)। এবার তো আলী (রা:) মন খারাপ করলেন। তিনিও তো আসমার (রা:) স্বামী। এক যুবক আর এক বৃদ্ধা যদি সেরা হোন, তাহলে তিনি কী? স্ত্রীকে অভিমানের সুরে জিজ্ঞেস করলেন।
আসমা (রা:) আবারও বুদ্ধিদৃপ্ত জবাব দিলেন:
“তিনজনের মধ্যে আপনিই সেরা।”

দুই খলিফার স্ত্রী আসমা (রা:) বেশ কয়েকটি গুণে গুণান্বিতা ছিলেন। তারমধ্যে অন্যতম হলো- চিকিৎসা বিদ্যা এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা। তিনি ঝাড়ফুঁক জানতেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে ঝাড়ফুঁক দেবার অনুমতি দেন।
অন্যদিকে, তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে পারতেন। যার কারনে, উমর (রা:) প্রায়ই তাঁর কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শুনতে যেতেন।জীবদ্দশায় দুই খলিফার স্ত্রী আসমা (রা:) তাঁর তৃতীয় স্বামী আলীকেও (রা:) হারান। এর কিছুদিন পর তিনি ইন্তেকাল করেন।

লেখকঃ কলাম লেখক ও মিম্বার গ্রুপের অ্যাডমিন
আরও পড়ুন-

কাঠমিস্ত্রীর স্বপ্ন যেভাবে পূর্ণ করলেন সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী

আরও পড়ুন