Ads

“পুরুষের বাম পাঁজরের হাঁড় থেকে নারীর সৃষ্টি”- হাদীসটির তাৎপর্য কি ?

জামান শামস

“পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকে নারী র সৃষ্টি” এই কথা প্রায় প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তি জানেন। কেউ কেউ আবার পাঁজরের ডান বাম উল্লেখ্য করে বলেন “পুরুষের বা পাশের পাঁজরের হাড় থেকে নারী র সৃষ্টি”। আমরা এই হাদীসটা এমনভাবে বলি যেন পুরুষের পাঁজরের হাঁড়ের একটা খন্ড নারীর শরীরে বসিয়ে দেয়া হয়েছে এবং সেই খন্ড নিয়েই নারীর সৃষ্টি এবং বোধকরি সব নারীর সৃষ্টিই এভাবে। সত্যি কি তাই? এটি হাদীসের একটি অংশ এবং পূরো হাদীসটি আপনি পড়লে বিস্মিত হবেন যে কিভাবে এর মূলকথা বিকৃত হয়েছে এবং নারী চরিত্র সম্পর্কে একটি নেগেটিভ ইমেজ তৈরী করা হয়েছে।

সূরা আন নিসা’র প্রথম আয়াতে আল্লাহপাক উল্লেখ করেছেন:
‎يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُواْ رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالاً كَثِيرًا وَنِسَاء وَاتَّقُواْ اللّهَ الَّذِي تَسَاءلُونَ بِهِ وَالأَرْحَامَ إِنَّ اللّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا
হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন; আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী। আর আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাচঞা করে থাক এবং আত্নীয় জ্ঞাতিদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে সচেতন রয়েছেন।

আবার অন্য এক জায়গায় আল্লাহপাক বলেছেন:
‎هُوَ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَجَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا لِيَسْكُنَ إِلَيْهَا فَلَمَّا تَغَشَّاهَا حَمَلَتْ حَمْلاً خَفِيفًا فَمَرَّتْ بِهِ فَلَمَّا أَثْقَلَت دَّعَوَا اللّهَ رَبَّهُمَا لَئِنْ آتَيْتَنَا صَالِحاً لَّنَكُونَنَّ مِنَ الشَّاكِرِينَ
তিনিই সে সত্তা যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক ব্যক্তি থেকে এবং তার থেকে বানিয়েছেন তার সঙ্গিনীকে, যাতে সে তার নিকট প্রশান্তি লাভ করে। অতঃপর যখন সে তার সঙ্গিনীর সাথে মিলিত হল, তখন সে হালকা গর্ভ ধারণ করল এবং তা নিয়ে চলাফেরা করতে থাকল। অতঃপর যখন সে ভারী হল, তখন উভয়ে তাদের রব আল্লাহকে ডাকল, ‘যদি আপনি আমাদেরকে সুসন্তান দান করেন তবে অবশ্যই আমরা কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হব’।
(সূরা আল আ’রাফঃ ১৮৯)

উপরের আয়াত দুটি বিশ্লেষন করলে দেখা যায়, “তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন একটি মাত্র সত্তা থেকে”। এখানে তোমাদেরকে বলতে সমগ্র মানবজাতিকে বুঝানো হয়েছে,নারী পুরুষ আলাদা নয়। তাহলে সমগ্র মানবজাতিকে তিনি একটি মাত্র সত্তা বা ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন।তিনি হলেন পৃথিবীর প্রথম নবী ও পুরুষ আদম আ: আর “বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী” এই কথাটি দ্বারা তো পরিষ্কার যে সারা বিশ্বে মানব বংশ ছড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি একথা বলেননি যে প্রত্যেক পুরুষ থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন। কাজেই ধর্মীয় দিক থেকে এব্যাপারটি পরিষ্কার যে আল্লাহ হযরত আদম (আ:) কে সৃষ্টির পর তার থেকে হযরত হাওয়া (আ:) কে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের থেকে পর্যায়ক্রমে সকল পুরুষ-নারী সৃষ্টি করে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন।

এবার পাঁজরের হাঁড় বিষয়ক হাদিস শুনি:

আবু হুরায়রা সূত্রে ইমাম বুখারি ও মুসলিম বর্ণনা করেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তোমরা নারীদের ব্যাপারে কল্যাণকামী হও, কারণ নারীকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। পাঁজরের মধ্যে উপরের হাড্ডি সবচেয়ে বেশী বাঁকা, যদি তা সোজা করতে চাও ভেঙ্গে ফেলবে, ছেড়ে দিলেও তার বক্রতা যাবে না। অতএব নারীদের ব্যাপারে কল্যাণকামী হও।(মুত্তাফাকুন আলাইহে)

এখানেও বলা হয়নি যে প্রত্যেক নারী তার স্বামীর পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি।

প্রত্যেক নারী তার “পুরুষ সংগীর পাঁজরের হাঁড় থেকে সৃষ্টি” এটি মেনে নিলে নিন্মোক্ত কয়েকটি ইস্যুরইবা কি হবে-
১.যেসব মেয়েরা বিবাহের আগেই মৃত্যুবরন করেছে
২.যেসব মহিলা তালাক প্রাপ্ত হয়ে বা স্বামী মারা যাওয়ার কারনে অন্য পুরুষের সাথে বিয়ে হয়েছে
৩.যে সব পুরুষের একাধিক স্ত্রী বহাল আছেন
সুতরাং এটি তো সন্দেহাতীত যে সব নারীই তার পুরুষ সংগীর বাম পাঁজরের হাঁড় থেকে সৃষ্ট নয়।অন্ততঃ কুরআন ও যুক্তির নিরিখেই তাই সত্য। তাহলে হাদীসে কি উদ্দেশ্যে এই উপমা ?
আল্লাহপাক সর্বপ্রথম হযরত আদম আ: কে সৃষ্টি করেছেন। এরপর,হতে পারে, তার পাঁজরের হাড় থেকে হযরত হাওয়া আ: কে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের দু’জন থেকে পর্যায়ক্রমে সমগ্র মানবজাতি সৃষ্টি করে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে ছিয়েছেন। কাজেই প্রথম নারী হযরত হাওয়া আঃ প্রথম পুরুষ হযরত আদম আঃ এর বাম পাঁজরের হাঁড় থেকে সৃষ্টি।

পাঁজর হল শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। আর এই পাঁজরের সবথেকে জটিল জিনিস হলো এর উপরের অংশ। আপনি যদি এই অংশে একটু জোরে চাপ দেন তবে তা ভেঙ্গে যাবে। সেজন্য আমাদের নবীজী সাঃ বলেছেন, স্ত্রীর সাথে ব্যবহার সহনশীল হতে হবে। তাদের প্রতি দয়া দেখাতে হবে, সহানুভূতি দেখাতে হবে। তার সাথে ভাল ব্যবহার করতে হবে। অর্থাৎ পুরো হাদীসের সারমর্ম হচ্ছে “স্ত্রীর সাথে ভালো ব্যবহার করো”।

অনেকে নারীবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে মনে করেন এটি নেগেটিভ হাদীস, নারীকে ছোট করা হয়েছে। পাঁজরের জটিল অংশ থেকে বানানো হয়েছে মানে নারী জটিল। বিষয়টি মোটেও তা নয়। শরীরের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাঁজর,নারী যেমন গুরুত্ববহ সমাজ সংসারে। পাঁজরের হাঁড় আমাদের ফুসফুস, হার্ট,যকৃত ,পাকস্থলির ইত্যাদি ঢেকে রেখে আমাদেরকে রক্ষা করে। আর হাঁড়গুলো বাঁকা বলেই এটা সম্ভব। এটা খাঁচা ও দৃড় আবরণের মত কাজ করে। আমাদের শরীরে ধাক্কা লাগলে পাঁজর সেটা সামলায়। এই হাঁড় যদি বাঁকানো না হতো তবে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ফুসফুস, হার্টকে রক্ষা করা যেতোনা। আর তাই নবীজী সাঃ নারীকে পাঁজরের সাথে তুলনা করেছেন। কেননা, নারীদের ভেতরে স্নেহ, ভালোবসা, মায়া, আবেগ বেশি দিয়ে আল্লাহ বানিয়েছেন এবং এই কারণেই নারীরা অধিক সম্মানিত। তাঁরা ভালো মা, ভালো বোন, ভালো স্ত্রী হয়ে মমতার সাথে একেকটি সম্পর্ক আগলে রাখেন। যেমনটা পাঁজর আগলে রাখে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশকে। তাই নারীদের কোমল স্বভাবের কারণে তাদের প্রতি যত্নশীল হতে হয়। হাদীসকে নেগেটিভ ভাবার কোন কারণ নেই।

আবার, পাঁজরের নেগেটিভ দিক সম্পর্কেও হাদীসে বলা হয়েছে। তা হলো পাঁজরের হাঁড়টাকে সোজা করতে গেলে তা ভেংগে যায়। এখন নারীদের তুলনা করা হয়েছে পাঁজরের সাথে। তাই সাবধান হতে হবে যাতে নারীদেরকে প্রেশার দেয়া না হয়, তাদের উপর জুলুম করা না হয় কিংবা কিছু চাপিয়ে দেয়া না হয়। যদি এটা করা হয় তাহলে তারা আবেগের কারণে দুর্ঘটনা ঘটাতে পারেন। তাই নারীদের প্রতি আচরণে পুরুষদের সহনশীল হতে হবে, তাদের সম্মান দিতে হবে, তাদের সাথে ভাল ব্যাবহার করতে হবে, তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। কোনভাবেই তাদের উপর জুলুম করা যাবে না, বিপথে ঠেলে দেয়া যাবে না।

শায়খ আব্দুল আজিজ বিন বাজ রহ: এই হাদিস প্রসঙ্গে বলেছেনঃ

“এটি স্বামী, বাবা, ভাই এবং অন্য পুরুষদের প্রতি নারীদের সাথে সদয় আচরণ করার, তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করার, তাদের প্রতি ন্যায়পরায়ন হবার, নারীদেরকে তাদের অধিকার প্রদান করার এবং তাদেরকে উত্তমের দিকে পরিচালিত করার নির্দেশ।”

আল্লাহ আমাদের বুঝার তৌফিক দিন।

লেখকঃ কলাম লেখক ও প্রাক্তন ব্যাংকার 

“পুরুষের বাম পাঁজরের হাঁড় থেকে নারী র সৃষ্টি” এই হাদিসের তাৎপর্য কি? এই লেখার সাথে আরও পড়ুন-

নবী পত্নী আয়েশা রাঃ এর উপর মিথ্যা অভিযোগঃ প্রতিক্রিয়া ও সমাধান (প্রথম পর্ব)

আরও পড়ুন