Ads

মেয়েদের লেখাপড়া এবং চাকরি

অধ্যাপিকা মৌলুদা খাতুন মলি

হঠাৎ প্রভা’র ফোন!
দীর্ঘদিন পর। অবাক না হয়েই পারিনি! বাইরে ‘টু-লেট’ বোর্ড দেখে ফোন দিয়েছে সে।’করোনা’র অজুহাতে এক বছর হয়– প্রভা’র স্বামীর চাকরিটা চলে গেছে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ভাল বেতনের চাকরি করত সে। প্রভা প্রাইমারির টিচার। আলহামদুলিল্লাহ্‌ আজ ওর চাকরি আছে বলেই- হয়ত ছেলেমেয়ে, প্রতিবন্ধী বোন, আর বেকার স্বামীকে নিয়ে দু’মুঠো ভাত জুটছে।তাই- মেয়েদের লেখাপড়া শিখে- শিক্ষিত হওয়া খুবই জরুরি!! চাকরি যে করতেই হবে– এমনটা নয়। বরং চাকরির যোগ্য করে নিজেকে গড়ে তোলাটাই আসল কথা। ভাগ্যের কথা তো বলা যায় না!মনে পড়ছে প্রভা’র মা– রেবা আপার কথা…সন-তারিখ একজ্যাক্ট মনে নেই।

 

সম্ভবত পনেরো/ষোলো বছর আগের কথা। সাহেব তখন চাকরির সুবাদে ঢাকায় থাকতেন। বাচ্চাকাচ্চা (মাশুক, জিহান, আশিক) তখন ছোট ছোট। মা বেঁচে ছিলেন সেসময়। তিনি আমার কাছেই থাকতেন। আমি তখন চাকরির পাশাপাশি জলেশ্বরীতলায় একটা কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিতাম। সপ্তাহে তিন দিন। বিকেল পাঁচটা থেকে ছ’টা পর্যন্ত। ফলে কলেজ থেকে বাসায় ঢুকেই আমার ব্যস্ততা দেখে কে? তাড়াহুড়ো করে নামাজ পড়ে, নাকেমুখে ভাত গুঁজে, বিকেলের নাস্তা রেডি করে মা এবং বাচ্চাদের সাথে শুধু হাসিমুখে এটুকু কথা বলতাম–
– আগে চট করে ক্লাসটা নিয়ে আসি–প্লিজ। তারপর রাতভর তোমাদের সাথে জমিয়ে গল্প করবো। তোমাদের সব কথাই শুনবো। অনেক মজার মজার গল্প স্টকে আছে আমার..হুম..!!

 

বাচ্চাদের কাছে একটা আকর্ষণ রেখে- শুধু ‘আল্লাহ্‌ হাফেজ’ বলেই তড়িঘড়ি বের হয়ে পড়তাম। দম ফেলার মত সময় তখন হাতে নেই আমার। চরম ব্যস্ত জীবন! কোনো ক্লান্তি যেন স্পর্শ করত না আমায়। কি উদ্যম-উদ্দীপনা নিয়ে চলতাম..!!
মাশা-আল্লাহ! বাচ্চারাও আমার সাংঘাতিক ট্রেইন্ড। একটুও জিদ করতো না, কোনো প্রশ্নও তুলতো না। যা বলতাম- প্রশ্ন ছাড়াই হাসিমুখে তা মেনে নিতো। ওরাও হাত নেড়ে শুধু বলতো
-‘আল্লাহ হাফেজ মামনি’ ।

 

কিন্তু আমার কোচিং এ ক্লাস করা নিয়ে মা’র বরাবরই একটু আপত্তি ছিল। তিনি গম্ভীর মুখে বলতেন–
– সারাটা দিন এত দৌড় ঝাঁপ করিস মা; বাসায় এসেও আবার হরেক পদের রান্নাবান্না…। বাচ্চাদের বেশি সময়ই দিতে পারিস না। তাছাড়া শরীরের উপর এতটা ধকল- হঠাৎ না অসুস্থ হয়ে পড়িস! কোচিং সেন্টারে না গেলে হয়না মা?
আমাকে নিয়ে মা’র দুশ্চিন্তার যেন অন্ত ছিল না।।মা’র কথায় আমি শুধু হাসতাম। কিছু বলতাম না।আমার ক্লান্তিহীন জীবনের রুটিন চলছিল ঠিক এভাবেই…।

 

হঠাৎ একদিন ওয়েটিং রুমে এক মায়ের সাথে আলাপ হলো। তিনি উচ্চশিক্ষিত, দারুণ স্মার্ট। বেশ পেটানো শরীর। খুব এনার্জিটিক ভদ্রমহিলা। উনাকে দেখে উনার সঠিক বয়স পঁয়তাল্লিশ না পঞ্চাশ ঠাহর করা মুশকিল। হাত নেড়ে নেড়ে তিনি কি সব লেকচার দিচ্ছিলেন। প্রথম দেখাতে এবং আলাপচারিতায় ভীষণ ভাল লাগলো উনাকে।কথায় কথায় জানলাম–উনার ডাক নাম ‘রেবা’।পুরো নাম- রুকাইয়া ইসলাম রেবা। আমি ‘রেবা আপা’ বলেই ডাক শুরু করলাম।

 

পরে জেনেছি-রেবা আপার শুধু দুই মেয়ে। বড়মেয়েটা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। বয়স বাইশ প্লাস। বিয়ে থা’র চিন্তা করেনি কেউ।আর ছোট মেয়ে ‘প্রভা’ সেবার এইচএসসি দেবে। রেবা আপা মেয়েকে তাঁর মত উচ্চশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর।।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘অর্থনীতি’ নিয়ে মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর রেবা আপা একজন আদর্শ হাউজ ওয়াইফ। চাকরির চিন্তা করেননি কখনোই। মেয়েদের চাকরি করা তিনি একদমই পছন্দ করেন না। এর পেছনে নাকি অনেক অকাট্য কারণ আছে। কিন্তু মেয়েরা লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হোক– এটি তিনি মনেপ্রাণে চান।
উনার হাজব্যান্ড একজন ব্যবসায়ী।মাশা-আল্লাহ! আমার দেখা খুব সুখি একটি পরিবার। মাস খানেকের মাথায়-কেন জানি রেবা আপার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা আরো বেড়ে গেল। শুধু আমার না, অন্যান্য মায়েদেরও। উনি যেচে পড়ে সবার সাথে আলাপ করতেন, সংসারের খোঁজখবর নিতেন, পরামর্শ দিতেন। উনার সেদিনের কিছুকথা এখনো ভীষণ মনে পড়ে আমার—
– ম্যাডাম ডোন্ট মাইন্ড, মেয়েদের চাকরি করা কি খুব জরুরি? বিশেষ করে আপনার? লেখাপড়া শিখেছেন- ‘ইটস ওকে’- একদমই ঠিক আছে। কিন্তু চাকরি কি করতেই হবে?

 রেবা আপার সরাসরি এ রকম অপ্রত্যাশিত এবং আক্রমণাত্মক প্রশ্নে আমি এক্কেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মৃদু হেসে বললাম-

– হ্যা অবশ্যই জরুরি । সংসারে টাকার অনেক প্রয়োজন আছে রেবা আপা। তাছাড়া- টাকা-পয়সা কারো বেশি হয় নাকি?
– কিন্তু ম্যাডাম, যাদের ঘরে ছোট ছোট দুধের বাচ্চা আছে, বৃদ্ধ বাবা-মা অথবা অসুস্থ শ্বশুর-শাশুড়ি আছে, যাদের স্বামী ভাল বেতনের চাকরি করে, ভাত- কাপড়েরও কোনো অভাব নেই যাঁদের, সেই মেয়েদেরও কি চাকরি করা জরুরি?

 

রেবা আপাকে এবার কেন জানি একজন ‘বেক্কল’ মহিলা বলে মনে হলো আমার। কাকে, কোথায়, কি বলতে হয়– তিনি যেন সে আদব জানেন না ।
অন্যান্য মায়েরা আমার উত্তরের অপেক্ষায় অতি উৎসুক ভরে তাকিয়ে আছে। আমি একটু বিরক্তি নিয়েই বললাম-
– দূর, আপনি একজন উচ্চশিক্ষিত মেয়ে হয়ে এসব কি উল্টাপাল্টা কথা বলেন রেবা আপা! মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানো, পারিবারিক, সামাজিক মর্যাদার জন্যও চাকরি করা খুব দরকার বলে আমি মনে করি। আর- বাসায় যাঁদের কাজের খুব সমস্যা- প্রয়োজনে তারা ২/৩ টা কাজের লোক রাখবে! অসুবিধা কি? মেয়েদের চাকরি করা একান্ত জরুরি। এমনকি ছেলেদের চেয়েও বেশি…
আমার এভাবে জোরালো কথায় রেবা আপা একটু আহত হলেন। না সূচক মাথা দুলিয়ে ব্যঙ্গভরে বাঁকা হাসলেন শুধু, কথা বললেন না। বুঝলাম- আমার কথাগুলো রেবা আপার মোটেই পছন্দ হয়নি।

 

কয়েক মাস পর–ইচ্ছে করেই রেবা আপার সাথে আর দেখা করিনি, কথা বলিনি, খোঁজখবরও রাখিনি। এর মধ্যে হঠাৎ আমার মা দ্বিতীয় বার স্ট্রোক করলেন।তবে- আলহামদুলিল্লাহ্‌ এবারও তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। কিন্তু আমি আর কোচিং এ যাই না, মানে যেতে পারি না। শুধু কলেজ করি আর বাচ্চাদের এবং মা’র গা ঘেঁষে ঘেঁষে চলি। পুরোনো দিনের অনেক সুখ-দুখের স্মৃতি মা’র সাথে শেয়ার করি। বাচ্চাকাচ্চা আর মা’কে নিয়ে তখন আমার সুখময় এক পৃথিবী!! ভাসতি ‘লীনা’ তখন আমার কাছে থেকে সিটি স্কুলে পড়তো।

 

সাহায্যকারী হিসেবে ছিল- মালেকা বুয়া।আরও থাকতো- এতিম দুইবোন- নাজু, সাথী। ওদের মৃত মায়ের অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী- ওরা আমার ঘাড়ে এসে পড়লো। সাথে যোগ হলো আরেক এতিম- ৭/৮ বছরের ‘সাগর’। গফুর ভাই হঠাৎ মারা যাবার পর- বলা-কওয়া নেই একদিন মা সাগরকে সাথে নিয়ে হাজির। এরা সবাই এলো আমাদের গ্রাম থেকে। সবাই-ই আমার কোনো না কোনো দিক থেকে আত্মীয়গোছের- আপনজন। অগত্যে কি আর করা। বাড়ি আমার বিশাল জমজমাট তখন!!
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো-সব ক’টাকেই আমার মা’র সুপারিশক্রমে রাখা। তিনি তাদের ব্যথায় ব্যথিত হয়ে প্রায়ই আমাকে বুঝাতেন-
– রিজিকের মালিক স্বয়ং আল্লাহ্‌! তোর চিন্তা কি? মানুষ খেলে কমেনা- বাড়ে। এতিমদের রাসুল(স) পছন্দ করতেন। তিনিও এতিম ছিলেন।
মা’র কথা আজও ভাবি আর একান্তে আনন্দে কাঁদি।

 

মা আমার খুব সুন্দরি ছিলেন। সবার মা-ই সন্তানের কাছে অপ্সরী হয়। কিন্তু আমার ‘মা’ সত্যিই অসাধারণ দূরদর্শী একজন আদর্শ ‘মা’ ছিলেন। থাকতেন গ্রামে- কিন্তু তাঁর আচরণে বিশাল আভিজাত্য প্রকাশ পেতো। সে যাহোক।

 

আরও কিছুদিন পর-রেবা আপার সাথে দেখা করলাম- উনার বাসায় গিয়ে। মায়ের অসুস্থতার খবর জানালাম। আমি যে আর কোচিং সেন্টারে যাই না- তাও বললাম।রেবা আপা এবারও শুধুই হাসলেন, কিছু বললেন না।দুপুরের খাবার শেষে আমাকে তিনি এক্কেবারে উনার বেডরুমে নিয়ে গেলেন। আরাম করে উনার চেয়ারে বসালেন। তিনি বসলেন আমার পাশের চেয়ারে। এবার শুরু করলেন লেকচার-
– মেয়েদের চাকরি করা একদমই ঠিক না। শুধুমাত্র সামাজিক মর্যাদা আর বাড়তি কিছু টাকার জন্য সংসারের শান্তি নষ্ট করা কি ঠিক? আমি প্রভাকে কিছুতেই চাকরি করতে দেব না। সেই শর্তেই বিয়ে দেবো।

 

মেয়েদের চাকরির বিরুদ্ধে সেদিন তিনি আরও অনেককিছু বলেছিলেন।আমি কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। আমতা-আমতা করে শুধু বললাম– শালীনতার সাথে প্রয়োজনে মেয়েরা চাকরি করলে অসুবিধা কোথায় রেবা আপা?

 

রেবা আপা এবারো হতাশ হলেন। আর কথা বাড়ালেন না। কিন্তু তিনি শেষপর্যন্তও মেয়েদের চাকরির এক্কেবারে ঘোরবিরোধী ছিলেন। ফোনে প্রভার সাথে কথা বলছিলাম আর সেদিনের রেবা আপার সেই কথাগুলো নিয়ে ভাবছিলাম। আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন, তাহলে প্রভা’র চাকরি করাটাকে তিনি কিভাবে দেখতেন…??

 

লেখকঃ সাহিত্যিক ও কলেজের শিক্ষক

 

লেখকের প্রকাশিত লেখা-
আরও পড়ুন