Ads

মেয়ে তোমার বাড়ী কোথায়?

ফারজানা মাহবুবা

বাংলাদেশে কাউকে বা বাইরে থাকা বাংলাদেশী কাউকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় ‘তোমার বাড়ী কোথায়?’, সবসময় উত্তরটা হয় বাবার অরিজিনাল গ্রাম বা দাদার বাড়ী যেটা সেটা। খুব ছোটবেলা থেকেই এই প্রশ্নে আমি খুব কনফিউজড থাকতাম। আমার বাড়ী শুধু দাদার বাড়ী হলে আমার নানার বাড়ী কী দোষ করলো?! আমি কি শুধু আমার বাবার মেয়ে? মা’র মেয়ে না? মা’র পেটে দশমাস থেকে মা’র বডি থেকে আমি বের হওয়ার পরও আমার বাড়ী শুধু বাবার বাপের বাড়ী কেনো? জানি, এগুলো সবই সিলি প্রশ্ন অনেকের কাছে।

কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন এগুলোই কিন্তু খুব বেসিক প্রশ্ন।একদম ফাউন্ডেশনাল প্রশ্ন। মানুষের বিশেষ করে একজন মেয়ের নিজের আইডিন্টি ফাইন্ড আউট করার ক্ষেত্রে। তো একজন সিনিয়র আপু উত্তরে বলেছিলেন ‘এই বিষয়টা হচ্ছে বাবার সারনেম’র মত। ইসলামে যেমন মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ বলে। মুহাম্মদ বিন আমিনাহ বলে না। একইভাবে মানুষের বাড়ী তার বাপের বাড়ী। তার মা’র বাড়ী না।’ কথাটা কেমন যেন ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইজতিহাদী ভঙ্গিতে লজিক্যাল মনে হলেও, আমি কখনোই কেনো যেন মন থেকে এই উত্তর মানতে পারিনি।

বিশেষ করে পরবর্তীতে যখন কেনো সন্তান তার বাবার নামে পরিচিত হয় তার ব্যাখ্যা বুঝার পর, আরো বেশী করে এই ‘তোমার বাড়ী কোথায়?’ তার উত্তর দিতে গিয়ে কনফিউজড হয়ে যেতাম। বাবার সারনেইম সন্তান নেয়, কারন বাবা “ক্বাওয়্যামুনা আ’লাননিসা” – সরাসরি কোরানের আয়াত থেকে বললাম, কারন বাংলায় এর শাব্দিক অনুবাদ অসম্ভব প্রবলেমেটিক। একটূ বুঝিয়ে বললে,
ছেলে আর মেয়ে দু’জনেই আল্লাহ’র খলিফা/ এম্বেসেডর/ গার্ডিয়ান টু দ্য ওয়ার্ল্ড এন্ড হিউম্যানকাইন্ড। কিন্তু এরমধ্যে মেয়েদের আলাদা একটা দায়িত্ব আছে হিউম্যান রেইস কে বাঁচিয়ে রাখতে বাচ্চা পয়দা করা। এটা করার জন্য আল্লাহ তার বডিকে একটা সার্টেন ওয়েতে বানিয়েছেন। ভলনারেবল করেছেন। সফট করেছেন। বাচ্চা কনসিভ করার জন্য এবং হওয়ার পরে পালার জন্য তার বডি যেমন হওয়া দরকার তেমন করে বানিয়েছেন।

যেহেতু মেয়েদের উপর এই অসম্ভব গুরু দায়িত্ব দিয়েছেন, তাই ছেলেদেরকে দায়িত্ব দিয়েছেন মেয়েদের টেইক কেয়ার করার।আল্লাহ তো ভালোই জানেন, বাচ্চা পয়দা কী জিনিষ।তাই ছেলেদের উপর দায়িত্ব দিয়েছেন মেয়েদেরকে সম্পূর্ণ সাপোর্টের। সব রকমের সাপোর্টের। মেয়েদের ফুল পটেনশিয়ালকে বিকশিত হতে দেয়ার সব দায়িত্ব ছেলেদের মাথায় চাপিয়েছেন তাই। ইটস ডিভাইন ব্যালেন্স। (আর ইন জেনারেল মুসলিমরা এটাকে উলটা ছেলেদেরকে “মালিক” বানিয়ে দেয়ার জন্য জাষ্টিফাই করে!)।এই যে “ক্বাওয়্যামুন” শব্দটা আল্লাহ বলেছেন,আরবীতে এই শব্দটার মূল এসেছে “ক্বামা” থেকে। এর অর্থ ‘দাঁড়িয়ে থাকা/ দাঁড়ানো’।খুব র’ অনুবাদ করে বুঝাতে গেলে বলতে হয়- ছেলেদেরকে আল্লাহ মেয়েদের টেইক কেয়ার করার জন্য সারাক্ষন এটেনশান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছেন। এটাই স্বাভাবিক।

মেয়েদেরকে আল্লাহ যেভাবে বানিয়েছেন, তাকে প্রটেক্ট করতে, তার পটেনশিয়াল অনুযায়ী তাকে ফুল সাপোর্ট দিতে, ছেলেরা বাধ্য। এটা তার উপর আল্লাহ’র দেয়া দায়িত্ব।এই দায়িত্বের কারণেই বাচ্চারা বাপের সারনেইম নিবে। কারণ বাপই সবকিছু সেজন্যে না, বাপের উপর মা বাচ্চা সবাইকে প্রটেক্ট করে সংসারকে টেইক কেয়ার করার দায়িত্ব দেয়া আছে, তাই। সো, আমার কাছে এটা জাষ্টিফাইড। ঠিক আছে। আমার কোনো প্রবলেম নাই।তাই উলটা আমার দুই মেয়ে হওয়ার পর সবার সব রকমের নামের সাজেশানকে বিনা দ্বিধায় কেটে দিয়ে দুই মেয়ের নামের শেষে তাদের বাপের সারনেইম লাগিয়ে দিয়েছি।আর যেহেতু বাপের সারনেইম তারা পাচ্ছে তাই তাদের নাম রেখেছি আমি।ভাগাভাগি।ব্যালেন্স।আচ্ছা কথা সেটা না।কথা হলো, বাপের নাম নিবে, এটার সাথে বাপের বাড়ীকে আমার বাড়ী বলা লাগবে- এটার লজিক্যাল কানেকশান কী?!?

আমার কাছে কোনো লজিক্যাল কানেকশান নাই।উলটা ধরেন ধর্মীয় লজিক দিলে তো মা’র বাড়ীকে আমার বাড়ী বলা উচিত! কারণ মা’র অবস্থান বাবার চেয়ে তিনগুন বড়!আবার, মা’র পায়ের নীচে আমার বেহেশত, আমার বাপের পায়ের নীচে না! তাহলে?

আসলে ঘটনা হলো আমাদের মানসিকতায়।যেহেতু বাংলাদেশীরা তাদের মেয়েদেরকে ঘরের বাচ্চা মনে করে না, জন্ম থেকেই ভাবে এই ‘পরের ঘরের বউ’, এই মেয়েকে তারা সম্পত্তি দেয় না, বিয়ের সময় যা পারে দেয়, মোটকথা একটা মেয়ের তো আসলে আমাদের দেশে কোনো বাড়ী নেই!

তার বাবার বাড়ী তার ভাইদের বাড়ী! আর তার জামাই’র বাড়ী তার জামাই আর জামাই’র ভাইদের বাড়ী! এজন্যেই কাউকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় ‘তোমার বাড়ী কোথায়?’, উত্তরে আমরা বাবার বাড়ী কোথায় সেটা বলি।
কারণ আমাদের মা’দের তো কোনো বাড়ীই নেই!! অতএব আমার ছত্রিশ বছর লাগলো এই সিলি বিষয়টা বুঝে উঠতে!!

এই কিছুদিন আগেও কেউ ‘বাড়ী কোথায়’ জিজ্ঞেস করলে, মনে মনে খচখচ করলেও ঠিকই বলতাম, চিটাগং। দাদার বাড়ী।যতবার বলতাম, মেজাজ খিঁচে যেতো। নিজেই কনফিউজড হয়ে যেতাম। ভাল্লাগতো না। আর বিজনিস যেহেতু করি, রেগুলার বাংলাদেশ থেকে আসা আংকল আন্টিরা আসেন তাদের মেয়েদের সাথে। সপ্তাহে অন্ততঃ কয়েকবার এই প্রশ্ন শুনতে হয়। কী জানি এতবছর কেনো লাগলো এই উত্তর রেডী করতে,

গত সপ্তাহে একজন আংকল যখন জিজ্ঞেস করলেন,কীভাবে যেন অটোতে বললাম, আংকল, আম্মু ময়মনসিং’র আর আব্বু চট্রগ্রামের। বলার পর খেয়াল করলাম কী বলেছি! তারপর নিজেই কেমন যেন চমৎকৃত হয়ে গেলাম! আরে, এত সোজা উত্তর! কেনো এতবছর এই উত্তর খুঁজে পাইনি!?
আজকেও মেয়েকে পার্কে খেলতে নিয়ে গেলে, পাড়ায় মেয়ের বাসায় বেড়াতে আসা নতুন এক আন্টি জিজ্ঞেস করলেন, ‘মা তোমার দেশের বাড়ী কোথায়?’আমি খুব কেমন যেন খুশী খুশী হয়ে উত্তর দিলাম, আন্টি, আমার মা ময়মনসিং’র আর বাবা চট্রগ্রামের।সিরিয়াসলি, কখনো কখনো খুব সোজা উত্তর-ও এত কঠিন! এতই কঠিন যে সে উত্তর খুঁজে বের করতে ছত্রিশ বছর লেগে যায়!!

লেখকঃ সাহিত্যিক ও প্রবাসী বাংলাদেশী, সিডনী, অস্ট্রেলিয়া

আরও পড়ুন