মোহাম্মাদ আমিনুল
এক
রাহেলা খাতুন ফুরফুরা অনুভব করছে। আজকে ছেলে অফিসে যাওয়ার সময় ছেলের কাছে বউয়ের ব্যাপারে নালিশ করা গেছে। অন্যান্য দিন সুমি রাহাত নাস্তা খাওয়ার সময় সামনেই থাকে। সুমির সামনে সুমির বদনাম করাটা বুদ্ধির কাজ হবে না। তাই রাহেলা খাতুন নিজেকে সংযত করে রাখেন। আজকে রাহাতকে একা নাস্তা করতে দেখে রাহেলা খাতুন ছেলের সঙ্গে বসে।
কি ব্যাপার রাহাত। সুমি কোথায়? জিজ্ঞেস করে রাহেলা।
মা সুমির গতরাতে মাইগ্রেনের ব্যাথাটা বেড়েছিলো। রাত তিনটার দিকে ঘুমিয়েছে। তাই সকালে আর ডাকিনি। একটু ঘুমিয়ে নেক। আর নাস্তা দেয়ার জন্য কাজের মেয়েতো আছেই।
মাথা ব্যাথা করবে না। সারাক্ষন মোবাইল দেখতে থাকলে মাথা ব্যাথাতো করবেই। তুইও বউকে আস্কারা দিয়ে মাথায় তুলেছিস। একটু মাথা ব্যাথা হতেই পারে। তাই বলে জামাই অফিসে যাওয়ার সময় বউ পাশে থাকবে না। যতই কাজের লোক থাকুক। জামাইকে রেডি করে দেয়া বউয়ের দায়িত্ব। এগুলো ভুললেতো চলবে না। তোর বাবা মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত কোনদিন তার যত্নআত্তির ত্রুটি করি নাই। আমাদের কি মাথা ব্যাথা করতো না। করতো। কিন্তু জামাই বাইরে যাবে সেসময় বউ পাশে থাকবে না এ কি হয় নাকি?
মা মানুষের শরীর খারাপ হয় না। রাহাত মৃদু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে।
বাবা এটা একটা নিয়ম। যদি একবার বউকে ছাড় দিস। দেখবি পরে বউ আর কথা শুনবে না। এইভাবে ছাড় দিতে দিতে তোর চাচাকে দেখিস না। এখন সে ঘরের বোঝা হয়ে গিয়েছে। ঘরের কোনে পরে থাকে কেউ খবরও নেয় না। তোর বউতো এমনিতেই কথা শুনে না। আমার ঠিকমতো খোজ খবর নেয় না। যখনি দেখি তখনি দেখি মোবাইল টিপাটিপি করছে। কার সঙ্গে যে এতো কথা বলে তাও বুঝি না। বউকে টাইট দিতে হয়। নাহলে বউ আর বউয়ের জায়গায় থাকে না। তখন বউ সংসারের কর্তা হয়ে যাবে আর তুই পরগাছা হয়ে যাবি।
রাহাত মা-র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অফিসে যায়। রাহেলা খাতুন জানে ছেলে মাকে খুব ভালোবাসে। আজকে হয়তো অফিস থেকে অথবা বাসায় আসার পর সুমিকে টাইট দিবে। রাহেলা খুব ভালো করেই ছেলেকে চিনে। মায়ের যত্ন হচ্ছে না এই কথাটা রাহাত শুনতে পারে না। এর আগে কয়েকবার এই নিয়ে সুমির সঙ্গে রাহাতের ঝগড়া হয়েছে।
রাহেলা খাতুন তৃপ্তি অনুভব করে। যেখানে ছেলে, মেয়েরা বাবা, মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতে চায়। বাবা মায়ের খোজ, খবর রাখে না। সেদিক দিয়ে রাহেলা খাতুন সফল। রাহাত মাকে অনেক ভালোবাসে। যেকোন কিছু করার আগে মা-কে জিজ্ঞেস করে। মা আমি এই কাজটা করছি। তুমি কি বলো।
তিনি পুলকিত অনুভব করেন। তার এখন ইচ্ছে করছে সফুরার সঙ্গে কথা বলতে। সফুরা রাহেলার বান্ধবী। খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। সফুরা রাহেলার ভাগ্য দেখে ঈর্ষান্বিত হয়।
তোর ছেলে তোকে এতো প্রাধান্য দেয়। হায়রে। তোর রাজকপাল। আমার ছেলেতো আমার কথাই শুনে না। বউয়ের কথামতো উঠবস করে। দোস্ত রহস্যটা বল।
রাহেলা খাতুন হাসে। মানুষ বলে দেশে রাজনীতি হয়। পরিবারে রাজনীতি হয় এটা কেউ বলে না। রাহেলা খাতুন অল্প শিক্ষিত হলেও পরিবারের রাজনীতি বুঝেন। আর বুঝেন বলেই সবকিছু তার নিয়ন্ত্রনে। উনার মেয়ে জুলিয়া। উনার মতোই বুদ্ধিমতী। জামাইকে পুরা নিজের কব্জায় নিয়ে গিয়েছে। জামাই বাপের বাড়ি থেকে আলাদা হয়ে নিজের আলাদা বাসা নিয়েছে। রাহেলা কয়েকদিন গিয়ে মেয়ের বাসায় ছিলো। আরেব্বাস মেয়ের কি তেজ। জামাই কথা বলার সুযোগই পায় না। রাহেলার সঙ্গে জুলিয়ার বেশ জমে। কিন্তু বেশীদিন জুলিয়ার বাসায় থাকা যায় না। কোনদিক দিয়ে সুমি কি বলে রাহাতের কান ভারী করে তার আগেই রাহেলা খাতুন বাসায় চলে আসে।
আজকে কাজের মেয়েকেও টাইট দিতে হবে। আজকে হচ্ছে টাইট দিবস। সুমি কাজের মেয়েকে ডাকলেই রাহেলা বেগমের কাজের মেয়েকে ডাকার কথা মনে পরে। অনেক সময় কাজের মেয়ে আসতে দেরী করে। আজকে বুঝিয়ে দিতে হবে এই পরিবারে রাহেলা খাতুনের স্থান সুমির উপরে।
রাহেলা খাতুন নিজের রুমে বসে টিভি দেখে। ছেলে মায়ের রুমে টিভি লাগিয়ে দিয়েছে। যদিও তিনি মানা করেছিলেন;
বাবা এখন আমার ইবাদত বন্দেগীর সময়। এখন টিভি দেখলে হবে?
তারপরেও ছেলের এক কথা। মা তোমার সময় কাটতে হবে না। সবকিছুই করতে হবে। তাহলে মন ফ্রেশ থাকবে।
তবে টিভি দেয়াতে ভালো হয়েছে। সময় কাটে। সিরিয়ালগুলো খুব শিক্ষণীয়। বউরা শাশুড়ির সঙ্গে কত পলিটিক্স করে। সিরিয়াল দেখে রাহেলা খাতুনের মুখ শক্ত হয়। তিনি মনে মনে বলেন সুমি সেই সুযোগ তুমি পাবে না। আমি এতো সহজ শাশুড়ি না।
সুমির কণ্ঠস্বর শুনা যাচ্ছে। কাজের মেয়ে মুনিয়াকে ডাকছে। রাহেলাও তখন মুনিয়াকে ডাক দেয়।
মুনিয়া আমার চা টা দিয়ে যা।
মুনিয়া সেদিক থেকে বলছে
আসতেছি নানু। মামীরে নাস্তা দিয়ে আসি।
মুনিয়া রাহাতকে মামা ডাকে। সুমিকে মামী। রাহেলা খাতুনের মুখ গম্ভীর হয়। কাজের লোকের উপর কন্ট্রোল বড় কন্ট্রোল। এই কন্ট্রোল হাত ছাড়া হলে বাইরের মানুষের কাছে ইজ্জত থাকবে না। দেখা যাবে কোনদিন রাহেলা খাতুনের বান্ধবী সফুরা বাসায় এসেছে। মুনিয়াকে বললেন চা দিতে। মুনিয়া তখন সুমির কাজে ব্যস্ত। বললো নানু মামীর কাজটা করে আসতেছি। সফুরার কাছে তাহলে ইজ্জত থাকবে না। আজকে মুনিয়াকে টাইট দিতে হবে।
মুনিয়া চা নিয়ে রুমে আসে। রুমের ঢুকার সাথে সাথে রাহেলা খাতুন চিৎকার দিয়ে উঠেন।
লাগবে না তোর চা। এই চা জানালা দিয়ে ফেলে দে। সেইসময় ডাকলাম তখন আসলি না কেন? আমারে ফেলনা মনে হয়। মনে হয় এই বুড়ী কি করবে। তোর চায়ে আমি থুতু দেই।
আমিতো মামীরে নাস্তা দিচ্ছিলাম।
আমাকে চা দিয়ে মামীরে নাস্তা দিতি। কোথায় লেখা আছে মামীরে নাস্তা দিয়ে আমারে চা দিতে হবে।
নানু আপনি বড় ঝামেলা করেন। সবকিছুতে প্যাচ ধরেন।
রাহেলা খাতুন মুনিয়ার গালে চড় বসিয়ে দেয়।
এরমধ্যে সুমি এসে রুমে ঢুকে।
কি হয়েছে মা?
কি আর হবে। কাজের মেয়েকে বেয়াদবী শিখালে যা হয়।
মুনিয়া চিল্লাচিল্লি শুরু করেছে।
আমি আর এইখানে কাজ করবো না। মুনিয়ার কাজের কোন অভাব নাই। লোকজন আমারে নিয়া টানাটানি করে। আমি আর এইখানে কাজ করবো না।
সুমি মুনিয়াকে বুঝানোর চেষ্টা করে।
রাহেলা খাতুনও চিৎকার করতে থাকে। ও কাজ না করলে ওরে বিদায় দিয়ে দাও। আগে আমরা একাই কাজ করতাম। কোন কাজের লোক লাগতো না। তোমরা এদের মাথায় তুলছো। তুমিও ওর গালে একটা চড় বসিয়ে দাও। বেয়াদব মাইয়া।
রাহেলা খাতুন মনে মনে হাসে। মুনিয়া চলে গেলে সুমিকে আরো শিক্ষা দেয়া যাবে। তখন সুমিকে সব কাজ করতে হবে। কাজেতো ভুল হবেই।
দুই
সুমি কিছুতেই বুঝতে পারছে না। তার কি করা উচিত। তার শাশুড়ি তাকে দেখতে পারে না। সুমির বিয়ে হয়েছে এক বচ্ছর। এই এক বচ্ছরে শাশুড়ি কোনদিন সুমির সঙ্গে সুন্দর করে কথা বলে নাই। খোঁচা মারা ছাড়া কথা বলে না। সুমির প্রতিটি কাজে ভুল ধরে। সুমির বিয়েটা প্রেমের বিয়ে। ইউনিভার্সিটির একটা প্রোগ্রামে সুমির সঙ্গে রাহাতের পরিচয়। রাহাত সুমির থেকে পাচ বছর সিনিয়র। কিন্তু তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। একসময় বন্ধুত্ব ভালোবাসায় রুপ নেয়। সুমির পরিবার মধ্যবিত্ত পরিবার। সুমির বাবা ব্যাংকে চাকরী করতো। এখন রিটায়ার করে বাসায়। রাহাত একটা নামী প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরী করে। প্রাইভেট কোম্পানি হলেও কোম্পানির সুযোগ সুবিধা ভালো। সুমির বাবা যখন দেখলো ছেলের পড়াশুনা ভালো, ভালো কোম্পানিতে চাকরী করে তখন আর অমত করেনি। রাহাতের মা এবং বোন সুমিকে দেখতে আসে। সুমিকে রাহাতের মায়ের পছন্দ হয়নি। রাহাতকে কি বলেছে সেটা রাহাত কখনো সুমিকে বলেনি। পরবর্তীতে রাহাত তার মা এবং বোনকে রাজি করায়।
বিয়ের আগে রাহাত খুব কেয়ারিং ছিলো। সারাক্ষন সুমির খোজখবর রাখতো। সুমি একটু অভিমান করলেই রাহাত অস্থির হয়ে যেতো। গান শুনাতো। কবিতা লিখতো। নানাভাবে সুমির রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করতো। বিয়ের আগে ঘর সংসার নিয়ে সুমির তেমন কোন অভিজ্ঞতা ছিলো না। রাহাতকে বললেই রাহাত বলতো
চিন্তা করো না। আমি আছে তোমাকে হেল্প করার জন্য। আমার মা আছে। তোমার কোন চিন্তা নেই।
কিন্তু এই বাসায় আসার পর থেকেই রাহাতের মা কথায় কথায় সুমিকে বুঝানোর চেষ্টা করেছে। এই বিয়েতে উনার মত ছিলো না। শুধুমাত্র ছেলের জন্য উনি রাজি হয়েছেন। সুমিকে ঘর সংসারের সব দায়িত্ব নিতে হবে। উনি এখন বিশ্রাম করবেন।
সুমিও খুশী মনে সব দায়িত্ব নেয়ার চেষ্টা করে। সুমি একটু ইন্ট্রোভার্ট টাইপের মেয়ে। মানুষজনের সাথে কথা বলার থেকে নিজে চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে। সুমি একদম ঢং করতে পারে না। শাশুড়ির সঙ্গে গল্প করতে পারে না। সুমি নিজের থেকে গিয়ে শাশুড়ির সঙ্গে হাসি ঠাট্টা করতে পারে না। এই নিয়ে রাহাতের অভিযোগের অন্ত নেই। তুমি মায়ের সঙ্গে ফ্রি হতে পারো না। একটু গল্প গুজব করবে। সুমি কয়েকবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু শাশুড়ি ঘুরে ফিরে সুমির পরিবারের কথা তুলে।
তোমার বাবাতো তোমাকে বিয়ের সময় তেমন ভালো কিছু দেয় নাই। আগে আমাদের বাসায় যে ছুটা বুয়া কাজ করতো; সেও তার মেয়েকে বিয়ের সময় তিন ভরি সোনা দিয়েছে। আর তোমার বাবা তোমাকে দিয়েছে সাত ভরি সোনা। ফার্নিচার কি দিয়েছে? একটাও ভালো ব্র্যান্ডের ফার্নিচার না। আমার ছেলে সোনার টুকরা ছেলে। তার জন্য কত উচু ঘর থেকে প্রস্তাব আসতো। কিন্তু ছেলের তোমাকে পছন্দ। কিন্তু পছন্দ হলে কি হবে। তাই বলে তোমার বাবা মা আমাদের এইভাবে অপমান করবে এটা ঠিক না। লোকজন নানান কথা বলে। সমাজে মুখ দেখানো দায়।
সুমি বলার চেষ্টা করে। মা আমাদেরতো বড় পরিবার। আমরা চার বোন এক ভাই। সবাই পড়াশুনা করে। সবার এতো খরচ। সবার খরচ চালাতে আমার বাবার অনেক কষ্ট হয়। আর রাহাতকে বিয়ের আগেই আমি সব বলেছি। আমাদের পরিবারের অবস্থার কথা।
তাও শাশুড়ির এক কথা। শুনো ছেলেতো প্রেমে অন্ধ হয়ে অনেক কথাই বলবে। কিন্তু যখন বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে তুলনা করবে তখন সে বুঝবে সে কি হারালো। আর এখনকার সময়ে সবাই দেয়। আমরাতো বিশেষ কিছু চাইনি।
সুমি এই ধরনের কথা বার্তার সঙ্গে পরিচিত না। তার কান্না পায়। সুমি কখনো কাউকে দুঃখ দিয়ে কথা বলতে পারে না। আর এই ধরনের কথা শুনতে হবে সে কখনো তা ভাবে নি। সুমি রাহাতের সঙ্গে অভিমান করে
তুমিতো জানতেই আমাদের পরিবারের অবস্থা কি? জানতে না?
রাহাত বলে; আরে মা কি বলেছে। এইগুলো এতো ধরলে হবে। রাহাত সুমির কাছ থেকে মায়ের বিরুদ্ধে কমপ্লেইন শুনতে একদম রাজি না। রাহাতের কথা আমিতো তোমার পরিবারের কাছ থেকে কিছু চাইনি। চাইও না। তোমার পরিবার দিয়েছে। আর মা এইগুলো নিয়ে তোমাকে বলেছে। এটাকে শাশুড়ি বউয়ের মধ্যে গল্প ধরে নাও। নাথিং সিরিয়াস।
কিন্তু সুমি গল্প হিসেবে ধরতে পারে না। সুমি কষ্ট পায়। সুমি এটাও বুঝে শাশুড়ি তাকে কষ্ট দেয়ার জন্যই বলছে। সুমি বুঝে সে যাই করবে না কেন শাশুড়ি তাতে কখনোই খুশী হবে না। সুমি অনেকবার চেষ্টা করে দেখেছে।
সুমির আজকে এমনিতেই মাথা ব্যাথা। ব্যাথার ওষুধ খাওয়ার পর থেকে মাথা ঝিম ধরে আছে। এরমধ্যে কাজের মেয়ে মুনিয়া চিৎকার শুরু করেছে সে আর এই বাসায় কাজ করবে না। সুমি বুঝে উঠতে পারছে না তার কি করা উচিত। মাঝে মাঝে সুমির ইচ্ছে করে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে। সে যেই সংসারের স্বপ্ন দেখে রাহাতের সঙ্গে সংসার শুরু করেছে সেই সংসার তার কোনদিন হবে না। সুমিকে সুমির মা বুঝায়।
মা সংসারে এমন হয়। ধৈর্য ধরে থাকতে হয়। মেয়েদের ধৈর্য হতে হবে মুনি ঋষিদের মতো ধৈর্য।
রাহাত ফোন দিয়েছে।
সুমি ফোন ধরতেই রাহাত অভিযোগ শুরু করে। তোমার এমন কি মাথা ব্যাথা তুমি সকালবেলায় নাস্তার টেবিলে ছিলে না। তুমি আমার মাকেও দেখতে পারো না। সুমি আমি কিন্তু পারছি না। এইভাবে আমার পক্ষে সংসার করা সম্ভব না।
সুমির আবার মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে। সুমি মাথা ধরে বসে পরে। রাহাত বলেই যাচ্ছে
আমি কিন্তু আমার মায়ের কাছ থেকে আর অভিযোগ শুনতে চাই না। আর শুনতে চাই না তুমি আমার মায়ের টেক কেয়ার করো না। আমার টেক কেয়ার করো না। রাহাত ফোন রেখে দেয়।
ব্যাথায় সুমির মাথা ফেটে যাচ্ছে। সুমি ব্যাগ গুছায়। এই সংসার কোনদিন তার হবে না। যেই সংসারে প্রতি পদে পদে তার ভুল ধরা হয় সেই সংসার তার হবে না।
সুমি শাশুড়ির কাছে যায়।
মা আমি চলে যাচ্ছি।
রাহেলা খাতুন চমকে যায়।
চলে যাচ্ছ মানে?
সুমি চুপ করে থাকে।
তুমি কি মনে করেছো। তুমি চলে গেলে রাহাত তোমার পেছন পেছন তোমার বাসায় গিয়ে উপস্থিত হবে। সুমি নিজেকে এতো গুরুত্বপূর্ণ ভাবার কিছু নাই। যদি যাও তবে ধরে নিও একবারেই যাচ্ছ। এই বাসায় তোমার আর জায়গা হবে না।
সুমি কিছু বলে না। ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যায়।
তিন
রাহাত সুমির উপর ভীষণ ক্ষেপে যায়। সুমি তাকে না বলে চলে গেলো। রাহেলা খাতুন তাতে ঘি ঢালে
আমি সুমিকে বলেছিলাম। তুমি যাবে। রাহাত আসলে তার সঙ্গে কথা বলে যাবে। কিন্তু সুমি আমার কথার কোন পাত্তাই দেয়নি। আমাকে বললো থাকেন আপনি আপনার ছেলে নিয়ে।
বাবা এই মেয়ে এবং তার পরিবারের সঙ্গে আসলে আমাদের যায় না। তুই ভুল করেছিস।
রাহাত সুমির সঙ্গে যোগাযোগ করে না।
রাহেলা খাতুন বলতে থাকে। যাবে কই। পরিবারের যেই অবস্থা। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তুই চুপ করে থাক। কয়দিন পর সুড়সুড় করে ফেরত আসবে।
রাহাত কোন কিছু বলে না। রাহাতও আশা করে সুমি কয়দিন পর নিজের থেকেই ফেরত আসবে। কিন্তু সুমি আসে না। দিন যায়, মাস যায়। রাহাতের খারাপ লাগা শুরু হয়। রাহাত বন্ধের দিন তার পুরাতন স্মৃতির ঝাপি খুলে বসে। ও কত চিঠি লিখতো সুমিকে; সেই চিঠিতে কত প্রমিজ থাকতো। আমি তোমাকে কখনো দুঃখ পেতে দিবো না। সবসময় তোমার সঙ্গে থাকবো।
রাহেলা খাতুন ছেলের জন্য পাত্রী দেখা শুরু করেছে।
বাবা যেই মেয়ে নিজের থেকে আসে না। যেই মেয়ের দেমাকে মাটিতে পা পরে না। তাকে আমাদের দরকার নাই। আমরা তোকে নতুন করে বিয়ে দিবো। তোর জন্য এইবার আমি মেয়ে পছন্দ করবো। রাহাতের বোনও মায়ের সঙ্গে তাল মিলায়।
ভাইয়া জীবনে অনেক মেয়ে দেখেছি। কিন্তু এই ধরনের মেয়ে দেখি নাই। শ্বশুর বাড়িতে কত কিছু হয়। তাই বলে একবার না বলে চলে যাবে আর যোগাযোগ করবে না। এটা কেমন ধরনের মেয়ে।
রাহাত সবসময় মন মরা থাকে। অফিসের কাজে মনোযোগ দিতে পারে না। অফিসের কাজে ভুল হয়। রাহাত বুঝে তার পারফরম্যান্স দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে। এইভাবে কিছুদিন চললে তার চাকরীর সমস্যা হবে।
রাহেলা খাতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজকে ছেলের সঙ্গে কথা বলবেন। একটা মেয়ে পছন্দ হয়েছে। মফস্বলের মেয়ে। রাহেলা খাতুনের কথাতে উঠবস করবে। বিয়ে হলেও সংসারের পুরো নিয়ন্ত্রন থাকবে রাহেলা খাতুনের হাতে। ছেলের রুমের দরজায় ধাক্কা দেয়। ছেলেটা শুয়ে আছে। কিন্তু ছেলের শুয়ে থাকার ধরন দেখে রাহেলা খাতুনের বুক কেঁপে উঠে। ছেলের অর্ধেক শরীর বিছানার বাইরে। রাহেলা খাতুন দৌড়ে যায়।
কি হয়েছে রাহাত?
রাহাত আধো চোখে রাহেলা খাতুনের দিকে তাকায়।
রাহাতের হাতের কাছে একটা কাগজ। সেখানে লেখা
মা আমি হেরে গিয়েছি। আমি ভালো স্বামী হতে পারেনি। ভালো ছেলে হতে পারিনি। ভালো কর্মচারী হতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করো। আমি অনেক ঘুমের ওষুধ খেয়েছি। অনেকদিন শান্তিতে ঘুমাই না। এইবার এক ঘুম দিবো। আর উঠবো না।
হাসপাতালে রাহেলা খাতুন বসে আছে। তার চোখ দিয়ে অঝোরধারায় পানি পরছে। পাশে সুমি বসা। সুমি চিৎকার করে কাদছে।
রাহেলা খাতুন সুমিকে বলছে মা আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমার উপর অনেক অত্যাচার করেছি। সবসময় তোমাকে নিচু দেখানোর চেষ্টা করেছি। সবসময় চেয়েছি আমার ছেলে যেন তোমাকে না ভালোবাসে। তোমাকে অপছন্দ করে। আমার ছেলে যেন শুধুমাত্র আমাকে ভালোবাসে। তোমাদের সংসার জীবন আমি নরক বানিয়ে রেখেছি। ইচ্ছে করেই প্রতি পদে পদে তোমাকে অপমান করতাম, কষ্ট দিতাম। কোনদিন বুঝতে পারি নাই। তুমি ছাড়া আমার ছেলের কষ্ট হবে। কোনদিন বুঝতে পারি নাই। ও তোমাকে ভুলতে পারবে না।
আমি আমার ছেলের জীবনকে নষ্ট করে দিয়েছি। আমি আমার ছেলেকে নিজের হাতে হত্যা করেছি। আমি হাসপাতাল থেকে ঝাপ দিবো। এই জীবন আমি রাখবো না।
সুমি রাহেলা খাতুনকে জড়িয়ে ধরে রাখে।
না মা। আপনার ছেলে আপনাকে অনেক ভালোবাসে। সবসময় বলতো আপনার যেন কষ্ট না হয়। আমি যেন আপনার অনাদর না করি। আসলে আমি ভুল করেছি ওকে ছেড়ে চলে এসে।
মা তুমিতো যাও নাই। আমি তোমাকে বাধ্য করেছি যাওয়ার জন্য। আমার ছেলে যে বুকে এতো বড় কষ্ট নিয়ে ঘুরছিলো আমি একবারও বুঝতে পারি নাই। আহারে ছেলে। আমাকে একবার বলতি। আহারে আমার ছেলেটা কি কষ্টে দিন কাটাচ্ছিলো। রাতে ঘুমাতো না। চোখের নীচে কালি পরে গিয়েছিলো। কিন্তু তাও একবার তোমার কথা বলতো না। পাছে আমি কষ্ট পাই। কিন্তু নিজেকে শেষ করে দিচ্ছিলো তিলে তিলে।
সুমি এবং রাহেলা খাতুন জড়াজড়ি করে কাদছে।
একজন ডাক্তার বের হয়ে এসেছে। তাদের কাছে এসে বললো; আমরা উনার স্টোমাক ওয়াশ করে দিয়েছি। আশা করছি উনি সুস্থ হয়ে যাবেন।
তাদের কান্নার আওয়াজে কোন কিছু শুনা যাচ্ছে না।
লেখকঃ কবি ও সাহিত্যিক