Ads

প্রিয় সন্তানের কাছে মায়ের চিঠি

শাহীনা হোসেইন

সন্তানের কাছে মায়ের চিঠি

প্রাণাধিক প্রিয় সন্তান,

আজ তোকে গল্প শোনাতে ইচ্ছে করছে। কতদিন তোকে গল্প শোনাইনা। রাজা-রাণীর গল্প, রাক্ষসের গল্প, চাঁদের বুড়ির গল্প। তুই এখন অনেক বড় হয়ে গেছিস বাবা এখন আর গল্প শোনার জন্য বায়না করিস না।তোর এখন অনেক বন্ধু, একসময় আমারও অনেক বন্ধু ছিলরে। অনেক সাথী ছিল গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা খেলার সাথি, পুতুল বিয়ে দেয়ার সাথি। তাদের নামও ভুলে গেছি। কিন্তু আজ তুই ছাড়া আমার কোন বন্ধু নেই। তাইতো বারবার তোর সাথেই কথা বলতে আসি।

বুদ্ধি দিয়ে ভালমন্দ বিচার করার বয়স হওয়ার আগেই চলে আসি নতুন পরিবারে। নতুন জীবনে।আবেগ ছিল মুলত চালিকাশক্তি। বাবা- মা উপদেশ দিলেন – মনে রেখো ওটাই এখন তোমার আসল বাড়ি। ওবাড়ির সবাইকে ভালবাসবে। বড়দের কথা মেনে চলবে।আমিও নিজের ক্যারিয়ার গড়ার কথা ভুলে মনোযোগী হলাম নতুন পরিবারকে আপন করতে।

কিন্ত আমার ভালবাসা তাদেরকে বোঝাতে ব্যর্থ হলাম। যাকে ভরসা করে এ বাড়িতে এলাম তাকেও ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। নিজেকে পরগাছা মনে হতো। আমার উচ্ছল হাসিখুশি জীবনটা থমকে গেল। বিয়ের পর প্রথম বুঝলাম মেয়েরা অসহায়। ক্রমে ক্রমে বুঝলাম আমি কতটা অকাজের। পদে পদে দোষত্রুটি যুক্ত জীবন বহন করে আমি হাপিয়ে উঠি। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট পেতাম। পরে মেনে নিয়েছি, মনকে সান্ত্বনা দিয়েছি এটাই আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজের ঐতিহ্য। –

পান থেকে চুন খসলেই শাশুড়িমা মা- বাপ তুলে বকবেন। এবং বউ চুপ করে থাকবে। প্রতিবাদ করলেই বউ খারাপ। আর স্বামীও ” বউ গেলে বউ পাওয়া যাবে ” নীতিতে বিশ্বাস করে ভাল ছেলেটি হয়ে মায়ের পক্ষ নেন।

মানসিক ভাবে যখন একেবারেই নিঃসঙ্গ তখন তুই এলি মোর জীবনে আশার আলো হয়ে। সকল কষ্টের সান্ত্বনা হয়ে। তোকে পেয়ে ভাবি আমার আর কষ্ট কিসের! আমিতো পেয়েছি আল্লাহর তরফ থেকে উপহার। বিশ্ব সংসার যখন অসহনীয় হতো তোকে বুকে চেপে কষ্ট ভুলেছি কতদিন! আর আশায় বুক বেঁধেছি তুই বড় হয়ে আমায় বুঝবি। তোর ঐ ছোট্ট দু’হাতের স্পর্শে যে কী মোহিনী শক্তি ছিল তা তোকে লিখে বোঝানো যাবে না। কত ছোট্ট ছিলি তুই।

একেবারে শক্তিহীন। ক্ষুধা, ব্যথা, যেকোন অসুবিধা বোঝানোর জন্য একটাই ছিল ভাষা ” কান্না” । রাতে বিছানা ভিজিয়ে ঘুমুতে পারতিস না। ভেজা পোশাক, ভেজা কাঁথা পাল্টাতে কত রাত যে আমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটেছে তার হিসেব নেই। কিন্ত জানিস, আমার মনে একদম কষ্ট হয়নি।

আমার হাত ধরে হাঁটতে শিখলি, কথা বলতে শিখলি, অক্ষরজ্ঞান ও হলো আমার কাছেই। যেদিন তোকে প্রথম স্কুলে নিয়ে গেলাম তুই আমার আঁচল ছাড়তেই চাসনি। তুইতো জানিস না আমি কতটা মিস তোর সেই আঁচল আঁকড়ে থাকা। কতটা মিস করি গলা জড়িয়ে গল্প শোনার বায়না। আজ আর তুই আমার বিছানা ভিজিয়ে দিসনা ঠিকই কিন্ত আমি যে ঘুমুতে পারিনা বাবা। রাতে তোর বাসায় ফিরতে দেরী হলে, তোকে লেখাপড়ায় অমনোযোগী মনে হলে এক অজানা আশংকায় বুকটা কেঁপে ওঠে। এতটা বয়স হলো তবুও মনকে শক্ত করতে পারলামনা যখন কোনকিছু নিয়ে আমার সাথে বিরক্ত হয়ে কথা বলিস তখন আমার চোখে পানি চলে এলেও অজানা আশংকায় উদ্বিগ্ন হই। মানুষ যে বলে – মায়ের চোখে পানি এলে সন্তানের অমঙ্গল হয়। তাইতো তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি তোর হয়ে। আমাদের দেশের সাধারন মায়েদের অবস্থা এরকমই। তারা বাইরের জগত চেনেনা। সমস্ত আনন্দ, বিনোদন,ও সান্ত্বনা খোঁজে সংসার আর সন্তানের মাঝে।

আমার যত কষ্টই হোক তোর ছোট্ট কোমল মনে যেন কোন হিংস্রতা দাগ না কাটে সে চেষ্টা করেছি সব সময়। আমি কখনোই চাইনি এমন কোন ঘটনা তোর সামনে ঘটুক যার জন্য তোর মনে বড়দের প্রতি ঘৃণা জন্মায়।কিন্ত পারলাম না। আমি অধিকার সচেতন হতে চেষ্টা করায় তোর সামনেই চরম ঘৃণ্য ঘটনাটি ঘটলো। তোর বাবা ক্ষোভ প্রকাশ করলেন চরম পৌরষত্বের দাপটে, পেশী শক্তি দিয়ে। তার মা-বাবার উপস্থিতিতেই। এমন ঘটনা এ সমাজে বিরল নয় তবুও আমার আত্মসম্মান বোধ আমাকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছিল। আমি মুক্ত হতে চেয়েছিলাম কিন্ত পারিনি। তোর মায়াবী মুখ আমাকে বাধা দিয়েছে।

আমি চাকুরী করিনি কখনো। সব প্রয়োজন তোর বাবাই মিটিয়েছে। বিনিময়ে মুল্য চুকিয়েছে কথা শুনিয়ে, সুযোগ বুঝে। তারপরেও নিজের হাতখরচ বাচিয়ে, নিজের শখকে বিসর্জন দিয়ে যাকিছু জমিয়েছি তোর ভবিষ্যতের কথা ভেবে কাজে লাগিয়েছি। আমারও তো তোকে কিছু দিতে ইচ্ছে করে।

আজ আমার বয়স হয়েছে। তুইও এখন অনেক বড় হয়ে গেছিস। আজ আমি তোর কাছেও কম বুদ্ধি সম্পন্না একজন যেমন ছিলাম তোর বাবার কাছে।

দিন দিন শরীর দূর্বল হয়ে পড়ছে। নানা অসুখ ধরেছে। আজকাল চোখেও কম দেখি যে হাত দিয়ে তোকে নিপুন ভাবে ঔষধ খাওয়াতাম আজ সে হাতে নিজের ঔষধ খেতে কষ্ট হয়। সময়ের সাথে সাথে শরীর আরও দূর্বল হয়ে গেলে তুই কি আমায় ঔষধ খাইয়ে দিবি বাবা? আমার মাথায় হাত রাখবি আমার অসুস্থতায়? জানতে চাইবি না আমার কোথায় কষ্ট হচ্ছে? আজকাল আশা করতেও ভয় পাই। (কত আশাইতো করেছিলাম। – স্বামী ভালবাসবে। দুঃখ কষ্টে সান্ত্বনা দিবে, ভরসা দেবে) নাকি বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিবি? তোকে দেখতে নাপেলে আমার যে খুব কষ্ট হবে রে বাবা।

যেখানেই দেখি বৃদ্ধাশ্রম চালানোর জন্য কেও সাহায্য চাচ্ছে চেষ্টা করি সাহায্য করার। জানিনা এই সাহায্য নিজের ভবিষ্যতের জন্য জমানো কিনা।

বাবা, তোকে ছোট বেলায় যে গল্প শোনাতাম সেগুলো ছিল কল্পকাহিনী। আজকের গল্প এদেশের সাধারন মায়েদের জীবনের কাহিনী।

ভাল থাকিস বাবা। চারিদিকে আলো ছড়িয়ে নিজ মহিমায় সমাজের অন্ধকার দূর করিস।

ইতি,
তোর মমতাময়ী মা।

সন্তানের কাছে মায়ের চিঠি লেখাতির সাথে আরও পড়ুন-

বাঙালি নারীর মতো রান্নার পিছনে সময় নষ্ট হয় না যুক্তরাষ্ট্রের কোন নারীর

আরও পড়ুন