Ads

আসক্তির অন্তরালে ডোপামিন হরমোন !

।। রফিকুল ইসলাম ।।

 

পৃথিবীতে সকল মানুষ সুখী হতে চায়। আসলে এই সুখ বা হ্যাপিনেস মানসিক এক অবস্থার নাম। একজন রিকশা চালক সারাদিন রিক্সা চালিয়ে ৩০০-৫০০ টাকা আয় করতে পারলেই নিজেকে খুব সুখী মনে করে, অন্যদিকে পুতিন ও জেলেনেস্কি একে অন্যের চেয়ে ভয়াবহ আক্রমণ, ধংসযজ্ঞ চালানোর মাঝে সুখ খুঁজে পাচ্ছেন। বিজ্ঞানের মতে আমাদের সুখানুভূতির জন্য মস্তিস্কের পিটুইটারি গ্ল্যান্ড থেকে নিসৃত ডোপামিন, সেরোটোনিন, অক্সিটোসিন, ও এন্ডোরফিন নামক হরমোন ভূমিকা রাখে। এই হরমোনগুলো মুলত এক প্রকার জৈব রাসায়নিক তরল। এই হরমোনগুলো জীবনযাপন (লাইফস্টাইল) দ্বারা প্রভাবিত হয়। এদেরকে হ্যাপি হরমোন বলা হয় । আজ শুধু ডোপামিন নিয়েই আমাদের আলোচনা।

ডোপামিনঃ ডোপামিন নামক হ্যাপি হরমোন একটি নিউরোট্রান্সমিটার হিসেবে কাজ করে। যা মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস থেকে নির্গত হয়। আমাদের সার্বিক মুড(mood) বা মনের ভাবকে নিয়ন্ত্রণ করে ডোপামিন। শুধু তাই নয় আবেগ বা উত্তেজনায় আমরা কিভাবে সাড়া দেব সেটাও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। একে ফিল গুড হরমোন বলা হয় । ডোপমিন আমাদের লক্ষ্য, আকাঙ্ক্ষা, প্রয়োজন পূরণে আমাদের মোটিভেট করে, প্রত্যয়ী করে তোলে। এই হরমোন আমাদের খুব প্রয়োজন কিন্তু এর অনেক ক্ষতিকর দিক আছে। আসুন ডোপামিনের কিছু ক্ষতিকর দিক জানার চেষ্টা করিঃ

১. ডোপামিনের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হল, এটি এডিক্টিভ বা আসক্তি- সৃষ্টিকারী। আরো সহজ করে বললে এই ডোপামিনের মাত্রাতিরিক্ত ক্ষরণে মানুষ নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। একই সাথে এটি দীর্ঘস্থায়ী নয়। এটি মানুষের অভ্যাসের সাথে সম্পৃক্ত।

২.ডোপামিনের মুল কাজ নিজের সন্তুষ্টি/তৃপ্তি। আমাদের লোভি, আত্নকেন্দ্রিক করে । তোলে ডোপামিনের ফলে মানুষ শুধু রিসিভার/ গ্রাহক হয়ে থাকতে চায়। শুধু পেতেই চাই, দিতে নয়। নিজের তৃপ্তির জন্য পিতা-মাতা সন্তানকে, সন্তান পিতামাতাকে হত্যা করার অসংখ্য উদাহরণ প্রিয় মাতৃভূমিতেই রয়েছে।

৩. ডোপামিন নির্গত হবার পর যে সেন্টারে জমা হয়, এই সেন্টার পূর্ণ হয়ে গেলে তার সাইজ বড় হয়, এই সেন্টার বড় হলে, একই কাজের জন্য পরবর্তিতে আরো বেশি পরিমান ডোপামিন দরকার হয়। ধরুন আমাদের সামনে কেউ আমার প্রশংশা করল, পরের বারের সাক্ষাতে একই পরিমান প্রশংশায় আমি তার প্রতি আর খুশি হতে পারব না। আগের চেয়ে বেশি প্রশংশা প্রয়োজন হবে।

৪. একবার বেশি ডোপামিন নির্গত হয় এমন কাজে অভ্যস্ত হয়ে গেলে কম ডোপামিন নির্গত হয় এমন কাজ আর ভালো লাগবে না। এজন্য আমরা, সম্পদ, মর্যদা, সম্মান যত পাই তত আরো বেশি পেতে আগ্রহী হয়ে উঠি। কারণ ডোপামিন যে লেভেলে নির্গত হয়েছে তা ধরে রাখতে হবে। অন্যথায় সুখানুভূতি স্থায়ী হবে না।

৫. মানব প্রকৃতির (Human nature) স্বাভাবিক কাজ গুলোতে উচ্চলেভেলের ডোপামিন নির্গত হয় না, যখন কেউ হাই লেভেলের ডোপামিন নির্গত হয় এমন সব কাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে তখন সে মানব প্রকৃতির স্বাভাবিক কাজ করে মজা পায় না। বিনোদন নামক illusion এর পেছনে ছুটে বেড়ায় ।

লেখকের আরও লেখা পড়ুন- আত্মীয়তার সম্পর্ক ও বাস্তবতা

উচ্চমাত্রার ডোপামিন নির্গত হয় এমন কয়েকটি উদাহরণঃ

১। ভার্চুয়াল জগতঃ বিশ্বের সেরা কম্পানি গুলোর এলগোরিদম এমন যে আমাদের মস্তিষ্ক থেকে ক্রমাগত হাই লেভেলের ডোপামিন নির্গত হবে, ফলে সময় কোন দিক দিয়ে চলে যাবে আমরা বুঝতে পারব না এবং এই কাজগুলো সহজে বন্ধ করতে পারব না। যেমন ফেসবুক, ইউটিউব।

২। যে কোন নেশা জাতীয় দ্রব্য, পনীয় , মদ, জুয়া খেলা, এগুলোতে অনেক হাই লেভেলের ডোপামিন নির্গত হয় , ফলে ঐ সব কাজ করতে না পারলে খুন করতেও দিধা করে না। ইসলামে এগুলো হারাম।

৩। সিগারেটের একটি টান/ হিরোইনের একটি টিকা নেবার ফলে যে পরিমান ডোপামিন নির্গত হয়, ঠিক একই পরিমান ডোমামিন নির্গত হয় ফেসবুকে পিকচার আপ্লোডের পর একটি লাইকে। এজন্য একটা পোস্ট দেবার পরে কতটা লাইক হল এটার জন্য বারবার চেক করার প্রবনতা তৈরি হয়। এক পোস্ট থেকে পরের পোস্টে লাইক, কমেন্ট বেশি না হলে পোস্টদাতা ডিমোটিভেটেড হয়, হতাশ হয়।

৪। ভিডিও গেসমঃ আজ শিশু থেকে শুরু করে বয়স্করা পর্যন্ত মোবাইল/ ল্যাপটপে গেম খেলে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে পারে। কারণ, যত বেশি গেম খেলি তত বেশি ডোপামিন পাই, ঐ সময় চারপাশে কি ঘটছে তা নিয়ে কোন চিন্তা মাথায় কাজ করে না।

৫। ডিজিটাল স্ক্রিনঃ প্রযুক্তির ছোয়ায় আজ সর্বত্র ডিজিটাল স্ক্রিনের সয়লাব। আমাদের মনে হয় মানবজাতির আজ কোথায় পোঁছে গিয়েছে। সত্যিকার অর্থে আমাদের মস্তিষ্কে ডোপামিন সেন্টার সবসময় খুলে রাখার সকল ব্যবস্থা বন্দোবস্ত হয়েছে। উচ্চলেভেলের ডোপামিন নির্গমন মূলত মানুষ নিজেকে ও সমাজকে ধংসের দিকে ধাবিত করে। অত্যধিক পরিমান ডোপামিন নির্গত হওয়ায় আজ আমরা ক্রেডিট হাংরি (খ্যাতি পাওয়ার ক্ষুধা )হয়ে গেছি। আরো বেশি ক্রেডিট, আরো বেশি।

ক্রেডিট হাংরি (খ্যাতি পাওয়ার ক্ষুধা) ভাব আজ আমাদের কত নিচে নামিয়ে দিয়েছে তা গভীরভাবে চিন্তা না করলে প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। পাকিস্তানি behavioral psychologist সাহিল আদিম ডোপামিন কে “নফসের ক্যামিকাল” বলেছেন। শাদ্দাদ ইবনু আওস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে,

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “সেই ব্যক্তি বুদ্ধিমান যে নিজের নাফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং মৃত্যুর পরবর্তী সময়ের জন্য কাজ করে। আর সেই ব্যক্তি নির্বোধ ও অক্ষম যে তার নাফসের দাবির অনুসরণ করে আর আল্লাহ্ তা’আলার নিকটে বৃথা আশা পোষণ করে।”

মজা ও শান্তি দুটো আলাদা জিনিস, মজার স্থায়িত্ব খুব কম। একটি প্রতিযোগিতায় ট্রফি জিতলে, অই ট্রফির প্রতি সাময়িক খুব আকর্ষণ থাকে, অল্পদিনের ব্যবধানেই আকর্ষণে ভাটা পড়ে, সুন্দর করে সাজানো সেলফে থাকলেও হয়ত আমাদের ক্রমাগত আনন্দ দিতে পারে না। কারণ ঐ ট্রফি আর আগের মত ডোপামিন নির্গত করতে পারে না। ডোপামিনে আমাদের মজা দিতে পারে, শান্তি নয়। প্রকৃত শান্তি পেতে আমাদের অক্সিটোসিন ও সেরাটোনিনের সেন্টার খুলতে হবে। পরবর্তীতে অক্সিটোসিন ও সেরাটোনিন নিয়ে লিখার চেষ্টা করব ইনশা আল্লাহ। আসুন ডোপমিন কম নির্গত হয় এমন কাজ বেশি করার চেষ্টা করি যেমন বই পড়া, অন্যের অধিকার পূরণে সচেষ্ট থাকা, সেক্রিফাইসিং মানসিকতা তৈরি করা, সামজিক কাজ করা ইত্যাদি। মজা নয় শান্তির পেছনে ছুটে চলা হোক আমাদের জীবনের প্রত্যয়।

 

লেখকঃ রফিকুল ইসলাম , শিক্ষার্থী, ডালিয়ান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ডালিয়ান, চীন ।

আরও পড়ুন