Ads

এইচ বি রিতা’র পূণর্জন্ম

রোমেনা লেইস

পৃথিবী এক বিশাল জায়গা।মানুষ সেখানে এক বিষ্ময়কর সৃষ্টি ।কেউ জন্ম নিচ্ছে ।কেউ মৃত্যুবরণ করছে।প্রতি মূহুর্তেই ঘটছে কতো রকমের ঘটনা।প্রতিদিন মানুষের জীবনে ঘটছে নানা বৈচিত্রময় ঘটনা।মানুষ কখন জন্মাবে কতদিন বাঁচবে,সব কিছু অনিশ্চিত।একদিন সবাইকে মরতে হবে।কিন্তু কখন, কীভাবে কার মৃত্যু হবে কেউ তা জানে না।

রীতা জীবন সংগ্রামে অবিচল এক নারী। গত ২০১৯ বইমেলায় এসেছে তার প্রথম উপন্যাস ‘বিনু’। রীতা এক পোড় খাওয়া মেয়ে ।যার দিন রাত শুধু সংগ্রামের। নদীর ভাঙনের মতো অবশ্যম্ভাবী ভাঙন আসে যার জীবনে ।ঠেকানোর কোনো উপায় থাকে না।যার তিনপুরুষে কেউ ডিভোর্সের নাম না শুনলেও আপোষ না করে ডিভোর্স হয় তাঁর।নিউইয়র্কের ব্যস্ত জীবনে দুটি সন্তানকে বাবা ও মায়ের দায়িত্ব নিয়ে বড় করে।সিঙ্গেল মাদার রীতা ক্লান্তি হীন সংগ্রামে পাশে পায় শুধু মাকে।কঠিন সংগ্রামে ঝড় জল বরফ কোন কিছুই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি।

জীবনের সাদামাটা দিনকে রঙ ছড়ানোর জন্য লেখালেখি শুরু করে।স্কুল শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখাকে ভালবেসে ‘প্রথম আলোয়’ যোগ দেয়। রিপোর্ট করে। বন্ধু হিসেবে পায় কিছু মানুষকে ।

এছাড়াও জীবনে সবুজ সুন্দর কিছু বন্ধু পেয়ে যায় ।রীতাদেরও মন থাকে।বর্ষার অবিরাম বর্ষণ তাদের মনকে ভিজিয়ে দেয়।সেখানেও রংধনু ওঠে।বিবমিষা জাগে জীবনের প্রতি।মা আর সন্তানদের দেখভাল করতে করতে জীবনের ছত্রিশটি বসন্ত পার হয়ে যায়।ছোটখাট অসুখ বিসুখ পাত্তা না দিয়ে দিব্যি হাসিমুখে চলতে শিখে যায় রীতা ।

সক্রেটিস বলেছিলেন জীবনের রঙমঞ্চে সকলেই অভিনয় শিল্পী ।দিনরাত নানা ভূমিকায় অভিনয় করে চলেছে। রীতা কর্মক্ষেত্রে সফল,মায়ের ভূমিকায় সফল,সন্তান হিসেবে বুড়ো মাকে দেখে শুনে রাখে ।এক্ষেত্রেও সফল।আবার ‘প্রথম আলো’র সাংবাদিকও সে।

শুধু তাই নয় অফিসে প্রতি বৃহস্পতিবারে তার সরব উপস্থিতি তার উদ্যমী চলাফেরায় আপন ব্যাক্তিত্বে সবার কাছে প্রাণপ্রিয় হয়ে ওঠে। সে সকলের জন্য খাবার তুলে দেয়, চা ঢেলে দেয়।অক্লান্ত এক মেয়ে।কিন্তু রীতার ভেতরের রীতাকে আমরা কেউ চিনি না।তার হাসিমাখা মুখের আড়ালে যে মেঘের মত গাঢ় তমসা ভাসে তা সযতনে সে আড়াল করে রাখে। কারো কাছে কখনো প্রকাশ করে না।নিজের খাওয়া, নিজের প্রয়োজনে ডাক্তার দেখানো এগুলোতে অবহেলা ক্রমাগত চলতে চলতে বই মেলায় গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে ফেব্রুয়ারিতে।

এয়ারপোর্ট থেকে নেমে সোজা হসপিটালে যেতে হয়।লিভার কাজ করছে না ঠিকমতো ।তবুও ঔষধ খেয়ে খেয়ে জীবনের যুদ্ধ চলছিলো ।রীতা গত কয়েক মাস ধরে জটিল রোগ ‘এডাল্ট অনসেট স্টিল’স ডিজিজ’ এ ভুগছিলেন। চিকিৎসার জন্য বিশেষ ধরনের স্টেরয়েড নিতে হচ্ছিল তাকে। স্টেরয়েডের প্রভাবে কয়েক মাসে রীতার সারা শরীর ফুলে যায়। কিন্তু অসাধারণ জীবনীশক্তি ছিল তাঁর। অসুস্থতা সত্ত্বেও ‘প্রথম আলো’ কার্যালয়ে নিয়মিত আসতো রীতা । ‘প্রথম আলো’র যেকোনো অনুষ্ঠানে সক্রিয় থাকতো । বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত লিখতে। এমনকি হাসপাতালের স্ট্রেচারে শুয়েও ‘প্রথম আলো’র জন্য লিখেছে রীতা। কারণ সে কাজকে ভালোবাসতো।চিকিৎসক প্রয়োজন ছাড়া রীতাকে বাইরে যেতে নিষেধ করেছিলেন। কারণ ‘এডাল্ট অনসেট স্টিল’স ডিজিজ’ রোগে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়। তবু প্রচণ্ড মনোবল ছিলো রিতার।আর পরোপকারী ছিলো ।মৌসুমী নামে বাংলাদেশে এক মেয়ে দূরারোগ্য এই লিউপাস রোগে আক্রান্ত ছিলো ।রীতা তার জন্য একলক্ষ টাকা সংগ্রহ করে পাঠিয়েছিলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়।

জুলাই ফোর্থ ২০১৯ ।সারা আমেরিকায় আনন্দ উৎসব চলছে।আকাশ বাতাস আনন্দে মাতোয়ারা। আমেরিকার জন্মদিনের উৎসবে যখন সারা আমেরিকার মানুষেরা হৈ হুল্লোড় করছিলো তখন হঠাৎই বসের কাছে ম্যাসেজ আসলো-‘ইটস টাইম টু সে গুডবাই।আমার হাতে আর সময়  নেই ভাইয়া ।’

বিষন্নতা ঘিরে ধরলো পত্রিকা অফিসের সকলকে।যে যে পারলো ছুটে গেলো হাসপাতালে।শরীরের অবস্থা বড় বেশী নাকাল।সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে কোমায় চলে গেলো বিনু।পত্রিকার পাতা আর ভার্চুয়াল দেয়ালে ভেসে উঠলো -‘জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রীতা।’

ভেঙে পড়লো সকলে।লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করতে পারলেই কেবল বাঁচানো যেতে পারে।কৃত্রিম লিভার দিয়ে বাঁচানোর চিন্তা ভাবনা করছেন ডাক্তাররা।কারণ রীতার জন্য ম্যাচ করে এমন লিভার হাতে নেই।ডোনাররা যে লিভার ডোনেট করে যান তা পেতে রয়েছে বিশাল একশত তেত্রিশ জনের লাইন।ততোক্ষণ কী বেঁচে থাকবে নাকি প্রাণ বায়ু তার আগেই বেরিয়ে যাবে।সন্দেহ আর শঙ্কায় সময় যেন আর কাটে না।

ডাক্তাররা কৃত্রিম লিভার সংগ্রহ করার চেষ্টা করছেন।সেটি সংগ্রহ করতেও পাঁচ থেকে সাতদিন লাগবে।আর মিরাকল ঘটনা ঘটলো তখনই।
ম্যানহাটন এর মতো আলোকোজ্জ্বল নগরীতে বৈদ্যুতিক বিপর্যয় ঘটলো।আর সেখানকার এক হাসপাতালে থাকা এক ব্যাক্তি মারা গেলেন।যার পুরো শরীর ডোনেট করা ছিলো ।লিভার এর জন্য অপেক্ষার তালিকায় বিনু তেত্রিশতম।আর মিরাকল এখানেই-তেত্রিশতম সিরিয়ালে থাকা বিনুর সাথে ম্যাচিং হলো মৃত ব্যাক্তির লিভার।দ্রুত লিভার সংগ্রহ করে প্রতিস্থাপনও করা হলো। ১৬ ঘন্টার দীর্ঘ সার্জারী হলো।সাকসেসফুল সার্জারী। কোমায় চলে যাওয়া বিনু চোখ মেলেছে । এ যেন নবজীবন ।

এই পৃথিবীতে কে কতোদিন বেঁচে থাকবে তা কেউ জানে না।লাইফ সাপোর্টে থাকে যখন কেউ কিংবা কোমায় সে যে ফিরে আসবে আবার জীবনে তার গ্যারান্টি পাওয়া মুশকিল ।খুব কদাচিৎ কেউ কেউ ফিরেন।আমাদের রীতা যমের দুয়ারে কাটা দিয়ে ফিরে এসেছে । রীতা আবার ‘প্রথম আলো’ নর্থ আমেরিকা অফিসে আসবে।আলোকিত করবে চারপাশ।ওর ছেলেরা মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে হাসবে। রীতার মা রীতাকে বুকে জড়িয়ে ধরবেন পরম প্রাপ্তিতে।আমরা মহান সৃস্টি কর্তাকে ধন্যবাদ জানাই আমাদের রীতাকে পুণরায় জীবন ফিরিয়ে দেয়ার জন্য।

লেখকঃ কবি ও লেখক

আরও পড়ুন –

শুধু মুনিয়া নয়, আদিকাল থেকেই নারীরা সমাজে ভোগপণ্য

অন্তুকে ছাড়া আমি খুব অসহায়

আরও পড়ুন