Ads

বেহেশতে কেন পুরুষকে হুর দেয়া হবে ?

 ।। শারমিন আকতার ।।

কেন পুরুষকে বেহেশতে হুর দেয়া হবে? কঠিন প্রশ্ন ; এমন কঠিন এবং সংবেদনশীল একটা টপিক নিয়ে লিখতে বসেছি বলে নিজেরই  অস্বস্থি  লাগছে । সেদিন মুক্তমনা ব্লগে  একজন ব্লগারের আর্টিকেল পড়লাম ।  তার  আর্টিকেলে তিনি একটি প্রশ্ন তোলেন-

“কি চমৎকার! জান্নাত মানেই রমনী, অনন্ত যৌবন। কাউকে চিরকুমারী রমনীর লোভ দেখানো কি অশ্লীলতা নয়?”

তিনি একজন সাধারণ বা নাস্তিক ব্লগার যাই বলুন না কেন এমন একটা প্রশ্ন তুলেছেন যার সঠিক উত্তর আসলেই আমাদের সাধারণ মুসলিমদের অনেকেরই জানা নেই ।  কোরআনের বিরুদ্ধে তিনি এমন প্রশ্ন তুলেছেন বলে  আমার মনে হয় আমরা যারা কোরআনে বিশ্বাস করি তারা যদি এই বিষয়ে সঠিক জ্ঞান রাখি তাহলে জবাব দেয়ার চেষ্টা করা উচিৎ আর উপযুক্ত জবাব না থাকলে এড়িয়ে যাওয়াই ভাল। কারণ টপিকটা এমন সংবেদনশীল যে জ্ঞান না থাকলে এই বিষয়ে বেশি কথা বলতে গেলে সাদা জল ঘোলা করে ফেলার সম্ভাবনাই বেশি । আমারও এই বিষয়ে তেমন জ্ঞান নাই । তবে সেদিন ডাঃ শামসুল আরেফিনের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড-৩ বইটা পড়ে এই প্রশ্নের অসাধারণ উত্তর পেয়েছি । তাই আমার মনে হল বিষয়টা সংবেদনশীল হলেও নিজে যা জেনেছি তা অন্যদের জানানোর চেষ্টা করা উচিৎ ।

তবে আমি মনে করি আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন তিনি তার সৃষ্টি করা জীবের সম্পর্কে ভাল জানেন ।  তার জৈবিক, মানসিক ও সামাজিক চাহিদা বা প্রকাশটা কেমন তা তিনি ভালো জানেন ।  তাই একজন মুমিনের উপর কর্তব্য হচ্ছে, আল্লাহ তা’আলার শরীআতগত বিধি-বিধান ও তাকদীরগত বিধি-বিধানসমূহকে নির্দ্বিধায় মেনে নেয়া।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন- “মুমিনদের উক্তি তো এই—যখন তাদের মধ্যে বিচার-ফয়সালা করে দেয়ার জন্য আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের দিকে ডাকা হয়, তখন তারা বলে, ‘আমরা শুনলাম এবং আনুগত্য করলাম।’ আর তারাই সফলকাম।” (সূরা আন-নূর: ৫১)

আর যখন আল্লাহর বিধি-বিধান, হুকুম আহকাম সম্পর্কে কোনো মুমিনের কোনো প্রশ্ন থাকে, আর সে উক্ত বিধানের প্রকৃত অর্থ বা হেকমত তথা রহস্য না জানে, তখন তার উপর কর্তব্য হচ্ছে তা বলা, যা জ্ঞানে সুদৃঢ় ব্যক্তিগণ বলে থাকেন, তারা বলেন: “আমরাতো তাতে ঈমান এনেছি, সবই আমাদের রবের পক্ষ থেকে এসেছে।” (সূরা আলে ইমরান:৭)

তারপরও আমার মনে হয় আপনি, আমি; যারা খুবই সাধারণ মানের মুসলিম । আল্লাহর বিধান মেনে নিলেও যারা কোন  কিছুর পিছনে একটা যুক্তি খুঁজে ।  আপনার  মনে কি এমন কোন প্রশ্ন জাগে না   কখনও?  যেমন- “আল্লাহ কেন পুরুষদের হুর প্রদানের ওয়াদা দিলেন?” “পুরুষদের জন্য হুর থাকলে নারীদের জন্য কি থাকবে?”  জ্ঞানের অগভীরতার কারণে এইসব সংবেদনশীল প্রশ্নের সঠিক উত্তর আমরা খুঁজে পাই না। আসলে আমার মনেও এমন প্রশ্ন জাগে মাঝে মাঝে । কেন আল্লাহ কোরআনে এমন কথা বললেন?

আরও পড়ুন- শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী নারীর ক্ষেত্রে ডিভোর্স কেন বেশী হয়?

কিন্তু যখন  ডাঃ শামসুল আরেফিনের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড-৩ বইটা পড়ে শেষ করলাম তখন শুধু এই প্রশ্নেরই না মানুষকে দ্বিধায় ফেলে এরকম নানা ক্রিটিক্যাল প্রশ্নের সমাধান পেয়ে গেলাম ।  “আল্লাহ কেন পুরুষদের হুর প্রদানের ওয়াদা করেছেন?” তার একটা সুন্দর ব্যাখ্যা দাড় করিয়েছেন তিনি বিভিন্ন গবেষণা ভিত্তিক আর্টিকেলের রেফারেন্স দিয়ে । তিনি  তার ডাবল স্ট্যান্ডার্ড-৩ বইয়ে উল্লেখ করেন-

“নারীর মন আর পুরুষের মন এক না । তাদের প্যাশন ও ফ্যান্টাসি এক না ।  দুনিয়া দেখা,  বুঝা ও রিয়েক্ট করা এক না । একি ঘটনা তাঁরা দেখে ভিন্নভাবে, মনে রাখে ভিন্নভাবে, বোঝে ভিন্নভাবে এবং প্রতিক্রিয়া দেখায় ভিন্নভাবে ।  এসব প্রতিক্রিয়া হয়ে গেছে যখন তাঁরা মায়ের পেটে থাকে তখনই ।” (Ref. Endocrinology of the mammalian fetal testis by O’ Shaughnessy 2011, Ivell 2017)

 

তিনি আরও বলেন-

“পুরুষের মগজের ফাংশন কমপার্টমেন্টালাইজ, এনাটমিক্যালি না ফাংশনালি খোপ খোপ । একেক জায়গার কাজ নির্দিষ্ট । আর নারীর ব্রেইনে এই সীমারেখা অস্পষ্ট, ওভার ল্যাপিং । …। একটা কাজের জন্য পুরুষের একটা জায়গা একটিভ হয় আর নারীর ব্রেইনের নানা জায়গা একটিভ হয় । মানে নির্দিষ্ট জায়গা দিয়ে নির্দিষ্ট কাজ করে; কিন্তু নারীর মগজে ব্যাপারটা এত টা কাট কাট না, একটা কাজে ব্রেইনের অনেক জায়গা  একসাথে অংশ নেয় ।”

(ডাবল স্ট্যান্ডার্ড-৩, ডাঃ শামসুল আরেফিন পৃষ্ঠা -১১৪)

 

পুরুষ নারীর যৌনতা ভিত্তিক  চাহিদা ও প্রদর্শনের ভিন্নতার বিষয়ে বলতে গিয়ে বলেছেন-

“যৌনতা যেহেতু মনেরই অংশ । উভয়ের যৌনতাও আলাদা । পুরুষ যৌনতা আর প্রেম আলাদা করে ফিল করে; ভিন্ন ভিন্ন জায়গা দিয়ে । প্রত্যেকটা ফিল করার স্থান নির্দিষ্ট । একটা ব্রেস্ট বা ঠোটের ছবি দেখেও পুরুষ উত্তেজিত হয়ে কাম মেটাতে পারে, যে কামের মধ্যে প্রেমের কোন বালাই নেই । তাই পর্ণগ্রাফির ভোক্তা মূলত পুরুষ  (Ref. Malamuth,N. M (1996). Sexually explicit Media, gender difference, and evolutionary theory; Journal of Communication. 46(3), 8-13 ) (ডাবল স্ট্যান্ডার্ড-৩, ডাঃ শামসুল আরেফিন পৃষ্ঠা -১১৪)

 

“আর নারীর কাছে যৌনতা আলাদা কিছু না; বরং প্রেমরই একটা অংশ । প্রেমরই শেষ প্রান্ত বা চূড়া । প্রেম করতে করতে শেষে গিয়ে মিলন । কামকে সে প্রেম থেকে আলাদা করে ফিল করে না । ফিল করে একসাথে । এজন্য নারী চায় প্রিয় মানুষটির সাথেই অনেক সেক্স, আর পুরুষ চায় চেনা- অচেনা ভিন্ন ভিন্ন নারীর সাথে অনেক সেক্স ।  (Anne Moir and David Gessel,Brainsex. Page- 110)”

(ডাবল স্ট্যান্ডার্ড-৩, ডাঃ শামসুল আরেফিন পৃষ্ঠা -১১৪)

আরও পড়ুন- বেগম রোকেয়া ধর্মহীনা না ধর্মমনা?

বাস্তবে পুরুষের এমন আচরণ কেমন খারাপ মনে হলেও এর পিছনেও কিছু বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক যুক্তি আছে । ডাঃ শামসুল আরেফিন তার ডাবল স্ট্যান্ডার্ড-৩ বইয়ে বলেছেন-

“পুরুষের এই বৈচিত্রের চাহিদাও সেই প্রজাতি কন্টিনিউয়ের সাথে জড়িত । যত বেশি জায়গায় বীজ ছড়িয়ে দেয়া যায় ।  পুরুষ সম্পর্ক ও বৈচিত্র ফিল করে আলাদা করে । এজন্য দেখা যায় সব দিক দিয়ে তুষ্ট পুরুষও পরকীয়া করছে । বৈচিত্রের চাহিদা মেটাচ্ছে । এজন্য ইতিহাসে কোন সমাজে পুরুষকে একবিবাহে আতকে রাখা যায়নি । ”

(Ref. Walter Schield, Monogamy and Polygamy in Greece, Rome and World History, Standford University, June  2008)

(ডাবল স্ট্যান্ডার্ড-৩, ডাঃ শামসুল আরেফিন পৃষ্ঠা -১১৫)

 

পুরুষের হুর প্রদানের কারণ খুঁজে পেলেও নারীর ব্যাপারে এমন সুস্পষ্ট কোন ঘোষণা কেন নেই সে সম্পর্কে এবার জানার চেষ্টা করি । ৭ জানুয়ারি ২০১৮ তে বাংলা নিউজ টুয়েন্টি ফোরে প্রকাশিত  মুফতি মাহফূযুল হক তার “বেহেশতে পুরুষের জন্য হুর, নারীর জন্য কী?” নামক আর্টিকেলে বলেন-

“পুরুষদের প্রাপ্তিকে যেমন বিস্তারিতভাবে বলা হলো; নারীদের প্রাপ্তিকে তেমন বিস্তারিত বলা হলো না কেন? এর কারণ সম্ভবত এমন- যৌন বিষয়ে দুনিয়াতে পুরুষরা যথেষ্ট খোলামেলা। কিন্তু নারীরা প্রকৃতিগতভাবে রক্ষণশীল মনোবৃত্তির ও যথেষ্ট লাজুক। পুরুষদের প্রাপ্তির আলোচনাকে যেমন বিস্তারিত কোরআনে কারিমে করা হয়েছে, নারীদের প্রাপ্তিকে তেমন বিস্তারিত আলোচনা করলে নারীরা চরম লজ্জায় পড়ে যেতো কিংবা বিব্রতবোধ করত। হয়তো আল্লাহতায়ালা বিশ্ববাসীর সামনে নারীদের লজ্জায় ফেলতে চাননি, সবার সামনে তাদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চাননি- তাই নারীদের প্রাপ্তির বিস্তারিত আলোচনাকে সযত্নে এড়িয়ে গেছেন।”

আর ডাঃ শামসুল আরেফিন বলেন-

“হুর পুরুষের ফ্যান্টাসি, নারীর নয় । নারী তার প্রিয় মানুষটির সান্নিধ্য চায় অনেক সময় ধরে, বার বার । বহু লোকের সান্নিধ্য তার ফ্যান্টাসি না । বরং আস্থা–নিরাপত্তার সম্পর্কে যেমন বিয়েতে নারী মিলনে চরম তৃপ্তি পায় ৫ গুণ বেশি ।” (Murstein B.I. Love, Sex and Marriage through Ages ,1974)

(ডাবল স্ট্যান্ডার্ড-৩, ডাঃ শামসুল আরেফিন পৃষ্ঠা -১১৫)

আরও পড়ুন- পুরুষের পরিবর্তে নারীকে কেন ক্ষুদ্রঋণ দেয় এনজিওসমূহ ?

অবশেষে বলা যায় যে আল্লাহ আসলে নারী পুরুষ উভয়কেই পুরস্কৃত করবেন । তাই আল্লাহর হুর ঘোষণার এক দুই আয়াত নিয়ে এতো জল ঘোলা না করে বরং জান্নাতের পুরস্কারের মূলনীতি বলতে যেয়ে আল্লাহতায়ালা যা বলেছেন তার দিকে নজর দেই । আল্লাহ বলেছেন “সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে যা কিছু তোমাদের মন চাবে এবং যা কিছু তোমরা ফরমায়েশ করবে। এগুলো পাবে ক্ষমাশীল পরম দয়ালুর পক্ষ থেকে আতিথেয়তাস্বরূপ। ” –সূরা হা মিম সিজদা: ৩১

 

রেফারেন্সঃ

১। ডাবল স্ট্যান্ডার্ড-৩, ডাঃ শামসুল আরেফিন

২। মুক্তমনা ব্লগ

৩। বাংলা নিউজ টোয়েন্টি ফোর

 

বেহেশতে কেন পুরুষকে হুর দেয়া হবে ?

আরও পড়ুন