Ads

কোভিড-১৯: ভ্যাকসিন পরিস্থিতি ও এ সময়ের করনীয়

ড. হাফিজুর রহমান

বিশ্বজুড়ে করোনার তাণ্ডব চলছে। করোনা সংক্রমিত হয়ে বিশ্বব্যাপী আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান বাড়ছে। এই মুহূর্তে (মে ০৪, ২০২০ পর্যন্ত) বিশ্বে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৩৫ লাখ ৭১ হাজার ৬১৫ জন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার ১৩৪ জনের। বিশ্বের বরেণ্য বিজ্ঞানীরা এবং খ্যাতনামা বৈজ্ঞানিক সংস্থাগুলো করোনার ভ্যাকসিন তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে কয়েক ধরনের ভ্যাকসিন তৈরি করে মানব শরীরে প্রয়োগও করেছেন। সবচেয়ে সম্ভাবনাময় তিনটি ভ্যাকসিন, যা এই মুহূর্তে বহুল আলোচিত, তা হলো mRNA-1273, ChAdox1 ও Coronavac.
mRNA-1273 এই ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছে মডার্না কোম্পানি এবং যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থা যৌথভাবে। কোভিড-১৯ ভাইরাসের (সার্স-কোভ-২) জেনেটিক পদার্থকে পৃথক করে তৈরি করা হয়েছে এই ভ্যাকসিন। এটার পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে মানুষের শরীরে। শিগগিরই জানা যাবে এই ভ্যাকসিনের সার্থকতা। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ChAdox1 ভ্যাকসিন নিয়ে অনেক এগিয়ে গেছেন। শিম্পাঞ্জি থেকে নেওয়া হয়েছে সাধারণ সর্দিজ্বরের ভাইরাস (একই ধরনের করোনাভাইরাস) এবং এই ভাইরাসকে কেমিক্যাল দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। তারপর এটার সঙ্গে মেশানো হয়েছে কোভিড-১৯ এর ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন। এই ভ্যাকসিনেরও পরীক্ষা শুরু হয়েছে এবং শেষ খবরে জানা গেছে, এই ভ্যাকসিন বানরে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে। এটা খুবই সুখবর যে মানুষের শরীরেও এই ভ্যাকসিনের পরীক্ষা শুরু হয়েছে এবং ধারণা করা হচ্ছে, খুব শীঘ্রই জানা যাবে মানুষের ওপরে এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা। Coronavac ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছে চীনা সংস্থা সিনোভাক বায়োটেক। একটি নিষ্ক্রিয় প্যাথোজেনের ওপর ভিত্তি করে, এই ভ্যাকসিনের হাজারো শট সাদা-কমলা রঙের একটি প্যাকেজে সজ্জিত করা হয়েছে। সিনোভাকের দাবি, বানরের শরীরে অভূতপূর্ব সাড়া মিলেছে এই ভ্যাকসিনের। বানরের পর মানব শরীরেও কার্যকারিতা পরীক্ষার কাজ শুরু হয়েছে এবং মানব শরীরে এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে অনেকেই আশাবাদী।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন ১৮ মাসের মধ্যে করোনার ভ্যাকসিন আসবে, তবে এর কম সময়েও একটি কার্যকরী ভ্যাকসিন আসতে পারে। ততদিন আমাদের ধৈর্যধারণ করতে হবে এবং করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের নিয়মাবলী মেনে চলতে হবে। যেমন: জরুরী প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়া, বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, বাইরে গেলে মাস্ক ব্যবহার করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মুখে হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকা এবং সর্বোপরি দেহের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানো ইত্যাদি। এই নির্দেশনাগুলো সঠিকভাবে মেনেচলা অবশ্যই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তারপরও আসন্ন দিনগুলোয় আমরা যে কেউ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারি।
তাই আমাদের এখনই ভাবতে হবে, যদি আমরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হই, তাহলে আমাদের শরীরকেও কোভিড-১৯ রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত করতে হবে, যেন বিশ্বের অধিকাংশ করোনায় আক্রান্ত মানুষের মতো আমরাও দ্রুত সুস্থ হতে পারি। এজন্য করোনা সংক্রমন প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনেচলা এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে হবে। করোনাকালিন সময়ে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে নিম্নের বিষয়সমূহ মেনেচলা অত্যন্ত জরুরী, যাতে এ রোগের সংক্রমণ হলেও আমরা মৃত্যুঝুঁকি কমিয়ে দ্রুত সুস্থ হতে পারি।
১. ধূমপান ও মদপান ছেড়ে দেয়া: গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপান ও মদ্যপান শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয় এবং এই রোগের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়। তাই শরীরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার তাগিদেই ধূমপান ও মদ্যপান ছেড়ে দিতে হবে, এতে ফুসফুসের কার্য্যক্ষমতাও আস্তে আস্তে বাড়তে থাকবে।
২. রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণে রাখা: করোনায় আক্রান্ত হলে ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ডই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই এই রোগগুলো থাকলে এখন থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ সেবন এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে রোগগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৩. শাকসবজি ও ফলমূল বেশি করে খাওয়া: পুষ্টিজনিত ঘাটতি এবং দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টিহীনতা আমাদের দেহের সাধারণ রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমিয়ে দেয়। দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় সবুজ শাকসবজি, ফলমূল এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার দেহের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকে বাড়াতে সাহায্য করবে।
৪. প্রতিদিন ব্যায়াম করা: শরীরের রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখতে এবং ফুসফুসের কার্য্যক্ষমতা বাড়াতে প্রতিদিন বাড়ির ভেতর অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা, ব্যায়াম করা এবং ঘরের কাজ করা। এতে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ভালো থাকবে।
৫. মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখা এবং পর্যাপ্ত ঘুমানো: স্ট্রেস বা দুশ্চিন্তা আমাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকে কমিয়ে দিতে পারে। আবার দৈনিক সাত থেকে আট ঘণ্টার কম ঘুমালে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল হয়ে যেতে পারে। তাই দুশ্চিন্তা পরিহার করে মন ভাল রাখা এবং রাতে নিয়মিত ও পর্যাপ্ত ঘুমানো, এতে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ভালো থাকবে।
করোনাভাইরাস মহামারী রূপ ধারণ করেছে। বিভিন্ন পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আগামী এক থেকে দেড় বছরে বিশ্বের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। সম্প্রতি করোনা চিকিৎসায় জরুরি প্রয়োজনে ‘রেমডেসিভির’ নামক ওষুধ ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ওষুধ শরীরে থাকা ‘আরএনএ পলিমেরাজ’ নামের একটি এনজাইম বিকল করে দেয়, ফলে ভাইরাস সংখ্যাবৃদ্ধির জন্য তার জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল (আরএনএ) -এর অনুলিপি তৈরিতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। রেমডেসিভির প্রয়োগে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী জ্বর ও শ্বাসকষ্টের লক্ষণগুলো থেকে দ্রুত সেরে ওঠার প্রমান পাওয়া গেলেও ওষুধটি করোনাভাইরাস নির্মুলে কার্যকর কি না, তা দেখা হয়নি।
তাই যত দিন পর্যন্ত না একটি কার্যকরী ভ্যাকসিন আমার পাচ্ছি, ততদিন সবাইকে করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি সমূহ মেনে চলতে হবে এবং নিজের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে সচেতন হতে হবে। করোনায় আতঙ্কিত বা হতাশাগ্রস্থ না হয়ে, করোনা প্রতিরোধে আত্মবিশ্বাস ও মনবল বৃদ্ধি করতে হবে।

লেখক:
ড. হাফিজুর রহমান
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী ইনস্টিটিউট অব বায়োসায়েন্সেস
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (অধিভুক্ত)
ইমেইল: [email protected]

আরও পড়ুন