Ads

চলুন ফিরি স্কুল জীবনে

শেখ তৈমুর আলম

জীবনের সবচেয়ে কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হলাম যখন বলা হল যে অনেকের সাথে আমাকেও স্কুল জীবনের লেখা দিতে হবে ৷আমি স্কুলে পড়তাম এটা মনে করতে আমাকে মাঝে মাঝে গলদঘর্ম হতে হয় ৷যদি জানতাম জীবনের প্রান্ত সীমায় এসে শৈশবের স্মৃতি চারণ করতে হবে তাহলে আগে থেকে কাগজে কলমে শৈশবের ঘটনা গুলো লিখে রাখতাম।তারপরেও বলি—-‘যাহা বলিব সত্য বলিব সত্য বই মিথ্যা বলিব না ৷’ সত্যটা হল এই যে আমার মস্তিষ্কের যেস্থানে স্মৃতি ধারনের কোষ থাকার কথা সেই কোষগুলিই অনুপস্থিত ৷ফলে শৈশবের স্মৃতি চারণ এর জন্য যে চারণ ভূমি দরকার আমার তা নেই ৷এটা বুঝেছিলাম আরও পরে ৷

নওগাঁ শহরে আমার বাসা থেকে কালিতলা নামক জায়গা খুব কাছে ৷ একদিন সকালে দাড়িয়ে আছি হঠাৎ এক যোয়ান পোলা এসে বলল-“দোস্ত কেমন আছিস ?” অনেক দিন পরে তোকে দেখলাম ৷আমি ওর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে চুপ থাকলাম ৷ কিছুতে বুঝতে পারছিলাম না সে কিভাবে আমার বাল্যবন্ধু ৷ সে বুঝতে পেরে জোর দিয়ে বলল-“আমরা এক সঙ্গে আরজি নওগাঁ স্কুলে পড়তাম ৷”তাহলে বুঝতে পারছেন আমার স্মৃতিশক্তির কি দূরবস্থা !

আমার প্রথম ইশকুলে গমন নওগাঁ সেন্ট্রাল গার্লস হাই স্কুলে তবে হাতে খড়ি দিতে নয় বড় বোনেরসঙ্গে নিয়মিত অতিথী হয়ে ৷এরপর যখন একটু বড় হলাম তখন আব্বা হাট নওগাঁ প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করে দিলেন৷ সেই থেকে হাতে স্লেট পেনসিল নিয়ে মানুষ হওয়া শুরু ৷তবে মানুষ হওয়া নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে ৷ক্লাশে যখন স্যার থাকেননা তখন মজাটা আরো বেশী ৷এ ও,র সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি হুরহুরি বই ছুড়াছুড়ি এরপর আছে মাছ বাজারের চ্যাচামেচি ৷সবই ছিল শিশুমনের জীবনের অংশ ৷

ঐ সময়ে আর একটি নিয়ম ছিল ৷অংক ক্লাশের একটা বড় অংশ খোলা আকাশের নিচে হ,ত ৷অর্থাৎ শতকিয়া নামতা মানসঙ্ক এসব বাইরে হ’ত ৷একজন সুর করে বলত আর আমরা বাকিরা একসঙ্গে সুর ধরে শেষ করতাম৷সবার সঙ্গে আপনাআপনি পড়া হয়ে যেত ৷ বাড়িতে মায়ের বকা খেয়ে মুখস্ত করতে হ’ত না ৷কোন এক অনুষ্ঠানে কিংবদন্তি শিক্ষাবিদ

অধ্যাপক আবু সাঈদ বলেছিলেন খোলা আকাশের নিচে সাহিত্য আড্ডায় গুনীজনদের মূল্যবান বক্তব্যের আদানপ্রদানই প্রকৃত
বিশ্ববিদ্যালয় ৷ খোলা আকাশে নিচে এটাকে যদি শিশু আড্ডা আখ্যা দেয়া যায় তবে হতে পারে এটিও সেই সময়ের শিশুবিশ্ববিদ্যালয় ৷

বাইরের পড়া শেষ করে যে যার সিটে এসে বসতাম ৷যথাসময়ে লম্বা বেত হাতে অংক শিক্ষক সাত্তার স্যার এসেই সবাইকে অংক কষতে লেগে দিয়ে আমাকে ডাকতেন ৷স্যার ছিলেন কিছুটা বেটেখাটো কালো ৷চুল ছিল সজারুর মত খাড়া ৷ডেকেই বলতেন দ্যাখ দু,একটা পাকা চুল গজিয়েছে
বেছে দে ৷আমার আর আনন্দের সীমা থাকেনা ৷কারন অংক করতে হবেনা ৷এটা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা ৷ আর গুরু সেবার কারনে বোধহয়
আশির্বাদের ফল সরুপ প্রাইমারীর গন্ডি পার হতে পেরেছিলাম বলে আমার ধারনা ৷

এরপর হাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পালা ৷ প্রাইমারী স্কুলের পাশে হাটনওগাঁ হাই স্কুল ৷কিন্তু আব্বা ওখানে দিলেন না ৷কেন দিলেন না তখন বুঝতে না পারলেও এখন বুঝি ৷দারিদ্র্যতা অভিশাপ হলেও অপরাধ নয় ৷

দারিদ্র পীড়িত বাবা তিন মাইল দূরে গ্রামে আরজি নওগাঁ হাই স্কুলে ভর্তি করালেন ৷সেই থেকে আমার হাই স্কুলের জীবন শুরু ৷শহর থেকে গ্রামে পড়তে যাওয়া আর কি ৷আমাদের সময়ে ঐ স্কুলের কোন ড্রেস ছিল না ৷যে যেভাবে পেরেছে গায়ে জামা চড়িয়ে এসেছে ৷

আমার দরদী মা আমাকে গোছল করিয়ে পায়জামা পরিয়ে দিতেন ৷তারপর দুদিকে পকেট ওয়ালা একটি হাওয়াই সার্ট গায়ে দিয়ে রাবারের সেন্ডেল পায়ে দিয়ে দিতেন ৷যথেষ্ট পরিমান সরিষার তেল মাথায় জাব্ জাব্ করে দিয়ে এক হাতে চিবুক ধরে আর এক হাতে পরিপাটি করে চুল আঁচড়িয়ে দিতেন ৷এরপর একগাদা বই হাতে দিতেন ৷সেসময় ব্যকপ্যড বা বই রাখার ব্যাগের কোন ব্যবস্থা ছিল না ৷ঘাড়ের উপর পাঁচ আঙ্গুল দিয়ে বই চেপে ধরে স্কুলের পথে রওনা দিতাম৷

ধুলিধূসরিত মাটির রাস্তা মারিয়ে ক্ষেত ভেঙ্গে ফসল পাড়া দিয়ে উচুনিচু গর্ত ডিঙ্গিয়ে তবে স্কুলে পোঁছাতাম ৷এত ধকল সামলে যখন স্যার পড়া ধরতেন তখন কোনদিন পারতাম কোনদিন পারতাম না ৷যেদিন পারতামনা সেদিন কান ধরে দাড় করিয়ে রাখত ৷মাঝে মাঝে বেন্চির নিচে মাথা ঢুকিয়ে
পশ্চাৎ অংশে বেত দিয়ে পিটাত ৷একবার সৌভাগ্যক্রমে আমি পড়া পারলাম কিন্তু পাশের ছেলেটি পারলনা ৷স্যারের নির্দেশে ওর কান দু,টি ধরে এমনভাবে মলে দিলাম যে সে ক্ষোভে দূ:খে অপমানে কাঁদতে শুরু করল ৷ এরপর সাতদিন ওর সঙ্গে একই রাস্তা দিয়ে আর যাইনি ৷ওটাই ছিল আমার জীবনের সেরা সাফল্য ৷

স্কুলে যাওয়ার পথে কিম্বা ফেরার পথে যদি বৃষ্টি নামত তাহলে জামা খুলে বই ঢেকে উদম গায়ে তিন মাইল রাস্তা দৌড়ে পার হয়ে যেতাম ৷কারন তখন গাড়ি ঘোড়ার এত বাহুল্যতা ছিলনা ৷ সেসময় মাঠে যথারীতি এসেম্বলি হ,ত ৷কিন্তু মেয়েরা লাইনে দাঁড়াতনা ৷মেয়েরা যাতে মাঠের ভিতর দিয়ে ক্লাশে না যেতে পারে সেজন্য দূরত্ব রেখে মাঠ কভার করে দাঁড়াতাম ৷আর মন উজার করে জাতীয় সঙ্গীত গাইতাম যার অর্থ আজও উদ্ধার
করতে পারিনি ৷রহস্য থেকেই গেছে।

নতুন প্রজন্ম হয়ত অনেকে জানে না ৷মুখে বলতে পারলাম না, তাই জ্ঞাতার্থে দু,লাইন লিখে দিলাম ৷ পাক ছার জমিন সাদবাদ
কিসুয়ারে হাছিন সাদবাদ তুনিশনে আজমে আলিশান আরযে পাকিস্তান মারকাজে একিন সাদবাদ ৷

সময়ের বিবর্তনে গ্রাম থেকে শহরে ফিরে এলাম৷ কিন্তু এমন এক স্কুলে ভর্তি হলাম যার নাম সহসা বলা একটু দূরহ ৷আমার বড় ভাই যখন পড়তেন তখন নাম ছিল করোনেশন হাই স্কুল,যখন আমি পড়তাম তখন নাম ছিল ইউনাইটেড হাই স্কুল, এখন নাম হয়েছে জিলা স্কুল ৷কোন নামে অবিহিত করব তা আপনাদের উপর ছেড়ে দিলাম ৷

আমি তখন ক্লাশ নাইনে ৷একদিন ক্লাশে বাংলা স্যার আসার আগে একজন ছাত্র ব্লাক বোর্ডে কার্টুন এঁকে নিচে লিখে দিল ” ডালিমের মা ডালিমের মা দেখেছ আমি না বাগ(ছারপোকা)মেরেছি ৷”বাংলা স্যার খুব স্টাইল করে স্বাতন্ত্র্য ভঙ্গিমায় কথা বলতেন এবং প্রত্যেক কথার শেষে হে উচ্চারণ করতেন ৷তিনি ব্লাক বোর্ড দেখে বললেন– কে লিখেছ হে ? আমার ঘরের কথা জানলে কেমন করে?

একটি ছেলে অন্যমনষ্ক ভাবে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল ৷স্যার বললেন-এই ছেলে দাড়াও ৷ তুমি না হে তোমার পাশের ছেলেটি ৷উফ্ তুমি না হে তোমার পাশে নীল শার্ট পরিহিত ঐ ছেলেটি ৷ হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি হে তুমি ! উঠে দাঁড়াও, সোজা হয়ে দাঁড়াও হে —-কোন দিকে তাকিয়ে ছিলেহে বের করে দেব কিন্তু ৷ একথায় একটি মেয়ে ফিক করে হেসে দিল ৷অমনি স্যার রেগে গিয়ে বলল–এই মেয়ে দাঁড়াও ৷ হাসছো কেন হে,লজ্জা করছে না? দাঁড়িয়ে রাখবো কিন্তু ! তোমরা বোধহয় জানোনা হে আমি ডক্টর মো:শহীদুল্লাহ্,র ছাত্র ছিলাম ৷শুধু তাই নয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নাটকের নায়ক ছিলাম হে ৷একজন ছাত্র উঠে বলল-স্যার আপনার মাথায় তো টাক ! স্যার বললেন- উফ্, তোমরা বুঝতে পারছোনাহে তখন আমি নায়ক ছিলাম ৷তখন আমার মাথায় প্রচুর চুল ছিল হে ৷চুল গুলো দক্ষিনা বাতাসে নায়কের মত উড়ত, বুঝেছ হে গর্দভ !এস এস সি ফরম ফিলাপের পর একদিন ভুলক্রমে স্যারদের চেয়ারে বসে পেপার পড়ছিলাম ৷অন্য এক বাংলা স্যার দেখতে পেয়ে তিনখানা বেত একত্র করে যে মারটা দিয়েছিল সেই আশির্বাদেই প্রাইমারীর মত এস এস সিও উৎরে গেলাম ৷নামের বিভ্রাট যে শুধু স্কুলেই ছিল তা নয়,এরকম বিভ্রাট কলেজেও ছিল ৷যে কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়তাম তার নাম ছিল বিএমসি কলেজ ৷ঐ কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন খ্যাতিমান এবং বলিষ্ঠ নীতি সম্পন্ন ৷যুগে যুগে কালে কালে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিছু কিছু দুষ্টু ছাত্র থাকে ৷তারা নীতিবান শিক্ষকদের উপর সব সময় রুষ্ট থাকে ৷

কলেজের করিডোরে এরকম কিছু ছাত্রের জটলার মধ্যে একজন বলে উঠল—শালার প্রিন্সিপ্যাল আমাদের নকল করতে দেয়না ৷ যেদিন প্রিন্সিপ্যালের মেয়েকে বিয়ে করব সেদিন দেখব জামাইকে কিভাবে নকল করতে না দেয় ! ঠিক ঐমূহুর্তে সবার অজ্ঞাতসারে স্যার এসে পিঠে টোকা দিতে থাকেন ৷বন্ধু ভেবে বার বার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল—আহ্ ইয়ার্কি করিসনাতো ! সবসময় ইয়ার্কি ভাললাগেনা ৷এবার স্যার বলল—চিন্তা করনা, ভাল করে লেখাপড়া কর নিশ্চয় তোমার সাথে বিয়ে দেব ৷

পিছনে তাকিয়ে দেখে প্রিন্সিপ্যাল, কার কথা কে শোনে মূহুর্তে করিডোর ফাঁকা ৷ ফাইনাল পরীক্ষা চলছে ৷ আমার অনতিদূরে ঐ কলেজের অংক শিক্ষক তার প্রাইভেট ছাত্রকে অংক বলে দিচ্ছে ৷হঠাৎ প্রিন্সিপ্যাল এসে ওঁর ঘাড়ে হাত দিয়ে বলল—ওই বাবর (স্যারের প্রাক্তন ছাত্র) বেড়া যদি ক্ষেত খায় ক্ষেত হবে কেমন করে ? বলাবাহুল্য এখন আর ঐকলেজের কোন অস্তিত্ব নেই ৷ঐ কলেজ পুরুষ থেকে মহিলায় রূপান্তরিত হয়ে বিএমসি মহিলা কলেজ নাম ধারণ করেছে৷ আমার কপাল ভালো ছিল,তাই মহিলা হওয়ার আগেই বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম ৷

লেখকঃ কবি ও সাহিত্যিক

আরও পড়ুন-

বয় VS গার্ল

 

 

আরও পড়ুন