Ads

পড়ো, লেখো এবং দাওয়ার কাজ কর

ফাতেমা মাহফুজ

উত্তর গোড়ানের তিন তলা নীল রঙ্গের বাড়ি, সাধারণ স্ট্যাকচার। তেমন দামী বা লেটেস্ট মডেলের কোনো আসবাবপত্রে ঠাসা নয় বরং সাধারণ মানের জিনিসপত্র দিয়ে গোছানো ঘর। ঘরের এককোণে টেবিলে রাখা কম্পিউটার। হাতে স্মার্ট ফোন নয় বরং সাধারণ মানের মুঠোফোন। পরনে মামুলি একটা শার্ট আর লুঙ্গি। চোখে মুখে সাদামাটা ভাব। কথায় নেই কোনো অহংকার, নেই অজ্ঞতা কিংবা অন্যকে ছোট করার মানসিকতা। আছে বিজ্ঞতা এবং অভিজ্ঞতা। আমার দেখা এমনই ছিলেন সাবেক সচিব মরহুম শাহ আব্দুল হান্নানতিজিনি ইসলামী ও সাদামাটা জীবন যাপন করতেন।

উনার সাথে পরিচয় ২০১৪ সালে। এক দৈনিকে প্রকাশিত উনার লেখার বিপরীতে আমার কিছু আগ্রহ নিয়ে উনাকে মেইল করেছিলাম। আর ধরেই রেখেছিলাম – এতো ব্যস্ত মানুষ! আমাদের মতো সাধারণ লেখিকার মেইল হয়তো চেকই করবেন না! অথচ, অবাক! উনি বেশ আগ্রহের সাথে আমার মেইল পড়ে সন্তোষজনক উত্তর দিয়েছেন। এবং পরবর্তীতে যেকোনো সংশয়, হোক সেটা সামাজিক, ধর্মীয় বা রাজনৈতিক- উনি বরাবরই প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করতেন। 

উনাকে প্রশ্ন করলে কখনো বিরক্ত হতেন না, হোক সেটা মেইলে বা সরাসরি ফোনে। উনি চাইতেন- তরূণরা যাতে ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র-সবকিছুতে একটা নৈতিক, সত্য ও স্বচ্ছ্ব ধারণা নিয়ে এগিয়ে যায় এবং সেটার প্রচার ও প্রসার হয়। তাই শিক্ষিত ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গড়তে তিনি সবাইকে বই উপহার দিতেন।

ব্যক্তিগত পর্যায়েও যতবার চাচার সাথে দেখা হয় উনি আমাকে বই উপহার দিতেন। বিয়ের পর স্বামীকে নিয়ে ২০১৬ তে যখন উনার বাসায় যাই; উনার আন্তরিকতায় আমার স্বামীও মুগ্ধ। ‘আমার ভাতিজা’ বলে আমার স্বামীর দুটো গাল ধরে কপালে চুমু খেলেন। আমরা যেনো আত্মার আত্মীয়! আমার স্বামীকে গিফট করলেন- উনার লেখা মূল্যবান বই “ইসলামী অর্থনীতি- দর্শন ও কর্মকৌশল”। উনার আরো কিছু উল্লেখ্যযোগ্য বই হচ্ছে-“নারী- ইসলাম ও বাস্তবতা”, “উসুলুল ফিকাহ”, “আমার কাল, আমার চিন্তা” । 

উনার দেয়া গবেষণামূলক ও তথ্যবহুল বইগুলোর রিভিউ লিখলে লেখার কলেবর হয়ত আরো বড় হবে। তবে একটা বই এর কথা উল্লেখ না করে পারছি না। মিশরের বিখ্যাত লেখক ও বক্তা জামাল আল বাদাবীর লেখা- “ইসলামী শিক্ষা সিরিজ” বইটি। ইসলামী আকিদা, নৈতিকতা, খাদ্যাভাস, ভ্রাতৃত্ব, দাস প্রথা, নারীর মর্যাদা, বিয়ে ইত্যাদি জীবনঘনিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পুরোটাই প্রশ্ন উত্তর সম্বলিত একটি বই। বইটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করে বিআইআইটি (বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইসলামিক থ্যট)। এই প্রতিষ্ঠানটিও উনার হাতে গড়া। উনি বিআইআইটি’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।

চাচার একটা গুণ ছিলো, তাহলো- সময়ানুবর্তীতা। একবার এক মিটিং এ দেরিতে পৌঁছায়, আমাকে বললেন- “তোমরা এই বয়সে দেরি করে পৌঁছাও! অথচ আমি এক ঘন্টা আগেই এখানে এসেছি। বাসা থেকে সেই বুঝেই বের হতে হবে”। আসলেও তাই। তাছাড়া,আমার দেখা মতে কোনো কাজ; যা করা সম্ভব সেটাকে তিনি ফেলে রাখতেন না।

আমার প্রথম বইয়ের (বিয়ে-আবেগ ও বাস্তবতা) মুখবন্ধ লিখে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানাতে,পান্ডুলিপি নিয়ে উনার কাছে যাই। উনি পড়ে বেশ আগ্রহবোধ করেন আর বলেন- “আম্মু মণি! এটা প্রকাশ করে ফেলো, আমি একটা মুখবন্ধ লিখে দিবো’। যখনকার কাজ তখনই করে ফেলার তাগিদ উনার ছিলো।

উনার কাছে উনার কোনো প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ করলে তিনি শুনতেন, কখনো হঠকারিতা করতেন না। তেমনি একবার উনার কাছে অভিযোগ করায়, পরদিন উনি আমাকে ফোন দিয়ে বলেন-“আম্মা! তাদের সাথে আমার কথা হয়েছে…”। এমনই ছিলেন তিনি। অথচ, আমাদের সমাজে ব্যক্তি সমালোচনা তো দূরে থাক, কারো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে যেনো শত্রু হয়ে যেতে হয়!

সবশেষ উনার সাথে এই বছরের ১৩ মে, ফোনে কথা হয়। আমার অনুবাদিত বই ‘দাম্পত্য রসায়ন’ এর প্রশংসা করে বলেন-“আম্মা! আপনে দারূণ সাহসিকতা দেখিয়েছেন! তাছাড়া আমার বলা কথাগুলো মনে আছে”? জবাবে বললাম- ‘চাচা,সবই আমার সংগ্রহশালায় আছে’। উনি হাসলেন।
লেখাটি শেষ করছি একটা শ্লোগান দিয়ে, যেটা প্রায়ই উনি বিদায়ের সময় বলতেন-

Read, read, read; Write, write, write; Dawah, dawah, dawah!

লেখকের প্রকাশিত দুটি বইয়ের প্রচ্ছদ

লেখকঃ সাহিত্যিক ও কলাম লেখক

 

 

 

 

 

 

আরও পড়ুন-

মুর্শিদী-মারফতী কি বাঙালি সংস্কৃতি নয় ?

ইহুদিরা জ্ঞানে বিজ্ঞানে, মেধা ও মননে অপ্রতিরোধ্য ! এই মিথ ভাংতেই হবে

জেরুজালেমে রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে হযরত ওমর (রা:) এর অনুভূতি

আরও পড়ুন