Ads

বেলা ফুরাবার কালে

আব্দুল্লাহ আরমান

৬২ বছর পার হয়েছে।শয্যাশায়ী অসুস্থ ও ভঙ্গুর শরীরটা বারবার জানান দিচ্ছে ওপারে যাওয়া এখন হাতে গোনা কয়েকটি দিনের ব্যবধান মাত্র। প্রচন্ড বুক ব্যথার সাথে নিঃশ্বাসের জটিলতাও বেড়েছে বেশ কিছুদিন হলো। কি রোগ তা বিস্তারিত জানি না, তবে ডাক্তার আমার কাছে কিছু একটা গোপন করছে! ডাক্তারের সাথে কথা বলার পর থেকে বড় ছেলেটার ভীষণ মন খারাপ। সময় পেলেই শিয়রে বসে ছলছল চোখ আর হাসিমুখে আমাকে স্বান্তনা দেয়। আমি যে বাবা,ওর শুকনো কৃত্রিম হাসির মাঝে লুকিয়ে থাকা কষ্টের স্পষ্ট বার্তা আমার চোখে ঠিকই ধরা পড়ে! আমার জন্য ওর এই ভালোবাসার অস্থিরতা দেখে শত কষ্টের মাঝেও হৃদয়ে একটুখানি শান্তির পরশ পাই!

শয্যাশায়ী হওয়ার পর থেকে সহধর্মিণীকে স্বপ্নে দেখছি বারংবার। হাসিমাখা মুখে প্রতিদিন এসে একই কথা বলে, “তাড়াতাড়ি আসেনতো, একসাথে খাব। আমি সেই কখন থেকে না খেয়ে বসে আছি….”।

ওর কথা মনে পড়লেই একাকীত্বের কৃষ্ণসাগরে গভীর থেকে গভীরে তলিয়ে যাই। কষ্ট-সুখ-মান-অভিমান-ঝগড়া করে তিন যুগেরও বেশী সময় পার করেছি একসাথে। তিন কবুল থেকে শুরু করে ওর কবরে দেয়া তিন মুঠো মাটির সাথে জড়িয়ে আছে হাজারো সুখ-দুঃখের স্মৃতি! পারিবারিক দ্বীনি বৈঠকে পরকাল বা মৃত্যু নিয়ে আলোচনা হলে ও মনটা ভীষণ খারাপ করে বলতো “আমার জীবদ্দশায় আপনাকে হারানোর কষ্ট যেন সইতে না হয়”! গভীর ভালোবাসা মাখানো এই বাক্যটা হয়তো আল্লাহ কবুল করেছেন। তাই আমার আগেই ওর আকস্মিক নীরব প্রস্থান হৃদয়ের গভীরে নিঃসঙ্গতার এক অনিরাময়যোগ্য ক্ষত তৈরী করেছে।

গত রমজানে এশার নামাজ পড়ে ও আমাকে বললো “কেন জানি বুকটা ধড়ফড় করছে। আমি খাবো না,আপনি খেয়ে নিন….”। আর কিছু না বলে- না খেয়েই বিছানার এক কোণে কাথা মুড়ি দিয়ে ঘুমালো। সেই যে ঘুমালো, তার অন্তহীন ঘুম আর ভাঙলো না। নিজ হাতে গোসল ও কাফন পরিয়ে সবার অগোচরে শেষবারের মতো ওকে আলতো জড়িয়ে কানে কানে বলেছি,“আল্লাহ সাক্ষী, আমি তোমার প্রতি আজীবন সন্তুষ্ট ছিলাম, এখনও আছি….।”
তবে মৃত্যুর পর প্রতিদিনই ও আমার ঘরে আসতো,আমার সাথে রাত জেগে গল্প করতো। নাতী-নাতনীদের এই কথা যতবার বলেছি ওরা হেসে কুটিকুটি হয়ে বলে ওটা নাকি হ্যালোসিনেশন। রাতে না ঘুমিয়ে ওদের দাদীর কথা ভাবি সেজন্য নাকি এমন হ্যালোসিনেশন হয়। সত্য-মিথ্যা যাই হোক, প্রতিদিন ওর দেখা তো মেলে, আমি এতটুকুতেই খুশী!

অসুখটা আরও বেড়েছে, চোখ দুটোও এখন খুলতে পারি না! আজ সকালে ছোট মেয়েটা মাথার কাছে বসে সেকি কান্না! বছরখানিক আগেই ওর মা’কে হারিয়েছে। সেই ধাক্কা সামলিয়ে উঠতে না উঠতেই বাবাকে এ অবস্থায় দেখে তো কাঁদারই কথা! আমি চলে গেলে পাগলীটা যে বড্ড একা হয়ে যাব, ভাবতেই কলিজায় আঘাত লাগে! হাফেজা মেয়েটা আমার কী সুন্দর করে তেলাওয়াত করে! জীবনের শেষ ক্ষণে এসে ওর মিষ্টি গলায় আরেকটিবার সূরা আর-রহমান শুনতে খুবই ইচ্ছা করছে। কিন্তু ইচ্ছাটা প্রকাশ করার শক্তিটুকুও আজ আমার নেই…!

আমার ঘরে কয়েকদিন থেকে আত্নীয়-সজন, প্রতিবেশী,বন্ধুসহ অনেক চেনা-অচেনা কন্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি। হয়তো তারা শেষবারের মতো ‘জীবিত’ আমাকে দেখতে এসেছে। আচ্ছা, আমার প্রতি তাদের এই ভালোবাসা-এই অনুরাগ মৃত্যুর পরেও অটুট থাকবে তো? আমি ওপারে গেলে এই প্রিয় মানুষগুলো তাদের দোআয় আমাকে ভুলে যাবে নাতো!?

পারিবারিক কবরস্থানের সেই চিরচেনা মাটিতেই আমাকে দাফন করা হবে। বাঁশতলার স্যাঁতসেঁতে মাটিতে আমার নিথর দেহটা পোকামাকড়ের খাদ্য হতে যাচ্ছে ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয়, ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসে!

তবে কবরের অন্ধকারের চেয়ে আমার পঙ্কিলতায় পূর্ণ আমলনামা নিয়ে বেশি ভয়। যে প্রতিপালক আমাকে তার দিকে ফিরে আসার জন্য ৬০ বছরের অধিক সময় দিয়েছেন,কতটুকুই বা পেরেছি তার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে! উল্টো অবাধ্যতার কালো চাদরে ঢাকা ছিলো পুরোটা জীবন। তবে বান্দার কি ততটা পাপ করার সামর্থ্য আছে যতটা আল্লাহ ক্ষমা করতে পারেন?!

জান্নাত,সেই কাঙ্ক্ষিত জান্নাত। বড্ড মন চায় সেখানে একটুখানি জায়গা পেতে! তাইতো আশায় বুক বেঁধে মনে মনে একটাই দোআ জপিঃ اللهم إني أسألك الجنة أعوذ بك من النار
অর্থঃ হে আল্লাহ তোমার নিকট জান্নাত চাই, আরও চাই জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ!
হঠাৎ দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, প্রচন্ড কষ্টে বুকের পাঁজর যেন ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে, হৃদপিণ্ড সহ ভিতরের সবকিছু কে যেন টেনে বের করছে। অবর্ণনীয় কষ্ট ও ভয় নিয়ে আমি যেন অন্ধকার থেকে গভীর অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছি। কেঁদে কেঁদে হৃদয়ের গভীর থেকে উচ্চস্বরে বলতে লাগলাম “আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু…..

চিৎকার দিয়ে ঘুমটা ভেঙে গেলো,লাফ দিয়ে বসে পড়লাম। শরীরটা ভয়ে তখনও কাঁপছে, দেহে ঘামের স্রোত বয়ে যাচ্ছে, আমি দু’হাতে মুখ ঢেকে শিশুর মতো কাঁদছি আর দু-চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছে…..
সহধর্মিণী ঘাবড়ে গিয়ে বললো কি হয়েছে আপনার?!
বললাম,নাহ এখনো কিছু হয়নি,তবে যা হতে যাচ্ছে আমি মোটেও তার জন্য প্রস্তুত নই! জায়নামাজটা বিছিয়ে দাও, একটু মন ভরে কাঁদতে ইচ্ছে করছে  ।

লেখকঃ ইসলামী বিষয়ে কলাম লেখক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট

আরও পড়ুন-

সত্যিকারের পুরুষ চাই

আরও পড়ুন